আমাদের গাঁয়ের উচুঁনিচু আলোয় ঝরে পড়ছে মহাকাল
গড়িয়ে গড়িয়ে বিস্তৃত মটরদানার মতো, তারপর
কেটে গেছে শতেক বছর অসীমের চারদিকে,
থেমে গেছে সূর্যের বেগ,
আমরাও হাটঁতে পারিনি কৃষ্ণগহ্বরের দিকে দিকে,
শুধু বারবার উল্টে পড়েছি, উঠে দাঁড়িয়েছি,
আবার ঝুপঝুপ উল্টেছি, গড়িয়েছি ফুটবলের মতো;
বৃষ্টিসিক্ত সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে দেখেছি
সেখানে ধূলিধূসরিত বাতাসের দেহে বাতাসীর
ঘ্রাণ মিশে তৈরি হচ্ছে সুবাস,
বহু দূরে সামুদ্রিক কোলাহলে উড়ছে নাগরিক শ্লোগান,
‘বান ডেকেছে বান ডেকেছে পাগলা ঘোড়ার বান’
আর রাজপথের পাশে ময়লা আচ্ছাদিত
গাছের পাতায় লেগেছে হলদে মৃত্যুর রঙ;
বাঁচার সুখ আর স্বপ্নের গর্তের গহ্বরে
কিছুদিন পরে দেখেছি মুমূর্ষু অংকুরোদগম;
পর্ণমোচী বৃক্ষ হতে পাতাগুলো উড়ে উড়ে
বিদেশি গাড়ির পেছনে পেছনে চলে গেছে
সীমান্তের ওপারে—ফলাফলঃ—
ধানখেতে মাঠখেতে পাতা পচে তৈরি হলো
অনেক অনেক যন্ত্রণাতিক্ত হৃদয়;
বিবেক করেছে পাচার এপার ওপার
শুধু বিবেকের রক্ত,
বিষে বিষে বিষাক্ত
কুমারী শরীর সেজেছে সুন্দর ফুটন্ত
অবয়বে পাকা আঙুরগুচ্ছের মতো,
ছেঁড়া ত্যানার সাথে হুহু হিম ঘুরে ঘুরে
হৃদয়ের কলরোলে হেনেছে আঘাত,
আমরাও করেছি আঘাত সীমান্তের দুই তীরে;
হোহো, হিহি হাসি হেসে কয়েকটি গোঁয়ার
চলে গেছে চলন্ত লিমুজিন থেকে
ঘৃণা ছুঁড়ে এক মধ্যবয়স্কা নারীর শাড়ির আঁচলে।
ফেরিঅলার মৎস্যকন্যা ঈশারায় ডাক দেয়
একটুখানি বাঁচার লোভে হালকা মেকাপে ডুবে,
কুম্ভকর্ণের বড়ি খেয়ে অশান্ত পাখিরা আজ
বেঘোরে ঘুমায় নিথর ড্রেনের বালিশে,
আধমরা মানুষেরা নববর্ষের পিকনিকে
শ্মশান আর গোরস্থানের মাঠে রাঁধছে নিজের মাথার মগজ,
কারাগারের বটগাছে অবিরত দুলছে প্রেমিকার ওড়না,
সেই ওড়না ভাগ করলো পাঁচ বছর করে শাসক দুজনা।
মৃত্যু আনয়নকারী চাবুকের কিংবা সংযুক্ত কাঁটার
সাথে সাতার কেটে যারা এঁকেছিলো শৈল্পিক গান,
বুলেট ও বোমার আঘাতে তারা নিঃস্ব রিক্ত জর্জরিত;
ঠেলাগাড়ি রিকসা টেনে তাদের ফুসফুস এখন
সারি সারি শুয়ে আছে রাস্তায়
সারি বাঁধা প্রেমিকার অনাবৃত কর্তিত বাহুর মতো।
শ্রমিকেরাও দেখছে আকাশে মহাকালিন নিস্তব্ধতা;
হঠাৎ সন্ধ্যায় কতিপয় মহাশক্তিধর এসে নিয়ে গেল
তাদের গারদ খানায়; ছোট্ট খুকির দল উদ্দীপিত ছাগল ছানার
মতো সন্তর্পণে ইতিহাসের ভুল মোড়ে ওম খোঁজে,
মর্মরের মতো মসৃণ রাজাধিরাজ বিমান বন্দরের মসৃণতায়
চোখ রেখে দেখে জনতার বুকের উপর তড়পায়
গণতন্ত্রের ছড়িও ফাঁদ; সুদুর নীহারিকাকে স্পর্শের মতো
মুক্তির স্বাদ পাবার আকাঙ্ক্ষায় কজন বেকার যুবক
স্মৃতির কলধ্বনির মতো কাগজে কলমে আঁকে পিরামিডের
মতো সাজানো দোকানের ফল,
হারিয়ে ফেলে রঙের বাজারে রঙিন ভেনাসের মূর্তি;
আর যারা গ্রামের পড়শি তাদের চোখে মুখে
ছুরির ফলার মতো ঢুকে বিভক্তি সীমান্তের বাজারে
এবং অনিয়মিত বেচাকেনা করে পাচারী নারী;
তাদের সংগে রয়েছে আমার নিয়মিত যোগাযোগ,
শুধু গভীর রাতে হঠাৎ ঘুমের মধ্যে টের পাই
অবয়বহীন আমি ভেসে ভেসে
চলেছি আমার খুলি ও কংকাল হাতে
নিয়ে শূন্যতার পথে বেঁচে থাকার সন্ধানে।
চিত্রের ইতিহাস: কবিতায় ব্যবহৃত অংকিত চিত্রটি পল গঁগাঁর (১৮৪৮-১৯০৩) আঁকা চিত্র তীরের সওয়ারিরা (Cavaliers sur la plage)। শিল্পী চিত্রটি আঁকেন ১৯০২ সালে। এখানে চিত্রটিকে কিছুটা ছেঁটে বাদ দেয়া হয়েছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।