দুধ খাওয়ার ১৬টি উপকারিতা ও দুগ্ধজাত খাদ্য প্রস্তুত পদ্ধতি

দুধ শরীরকে নীরোগ রাখে প্রাচীনকাল থেকেই দুধ মানুষের প্রিয় পানীয়। শাস্ত্রে দুধকে বলা হয়েছে পৃথিবীর অমৃত। দুধ রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়িয়ে দিয়ে শরীরকে রোগমুক্ত রাখে। দুধে ভিটামিন সি ছাড়া শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় আর সব রকমের পোষকতত্ত্বই আছে। সেইজন্যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত দুধকে সম্পূর্ণ আহার বলে মনে করা হতো। এখন যদিও দুধকে সম্পূর্ণ আহার বলে মনে করা হয় না এবং অতিরিক্ত দুধ খাওয়া শরীরের পক্ষে ভাল বলেও মনে করা হয় না, তবু দুধ যে খুবই পুষ্টিকর এ সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই।

অসুস্থ লোকেদের পক্ষে এবং শিশুদের পক্ষে টাটকা গরুর দুধ খাওয়া ভাল। মায়ের দুধের পরেই সব রকমের দুধের মধ্যে গরুর দুধই শ্রেষ্ঠ। টাটকা ফোটানো দুধ সকলেই খেতে পারেন। কিন্তু যাঁদের গ্যাস হয় এবং হজমশক্তি ভাল হয় না তাদের জন্য  শুঠ, এলাচ, পিপুল, দারচিনি প্রভৃতি হজমকারক। মশলা মিশিয়ে ফোটানো দুধ খেলে উপকার পাবেন। অসুস্থ লোকেরা যে দুধ খাবেন তা কখনোই ঘন করা উচিত নয়।

যদিও দুধ বেশি ফোটালে দুধের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায় এবং দুধ হজম করা শক্ত হয়ে দাঁড়ায় তবুও দুধের বায়ুপ্রকৃতি কম করবার জন্যে এবং জীবাণুশুন্য করবার জন্যে দুধ কাচা না খেয়ে ফুটিয়েই খাওয়া উচিত। ছোট বাচ্চাদের এবং যাঁদের হজমশক্তি দুর্বল তাদের তিন ভাগ দুধে একভাগ জল মিশিয়ে দেওয়া উচিত।

দুধ ফুটিয়ে খুলে রেখে ঠাণ্ডা করলে সর পড়ে। এই সরই হলো দুধের মালাই। দুধের মতো মালাইয়ের  অনেক গুণ আছে। মালাই আয়ুর্বেদের মতে গরিষ্ঠ, শীতল, বীর্যবৃদ্ধি করে বা কামোদ্দীপক অথাৎ কাম বাড়িয়ে দেয়, বলবৃদ্ধি করে, তৃপ্তি দেয়, পুষ্টিকর, স্নিগ্ধ, কফ কারক ও ধাতুবর্ধক। পিত্ত, বায়ু, রক্তপিত্ত এবং রক্তের দোষ নাশ করে।

দুধ ঘন করে ফুটিয়ে রাবড়ি খোয়া ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এগুলো সবই কামোদ্দীপক ও বীর্য বৃদ্ধি করে, পুষ্টিকর , বল বৃদ্ধি করে, কফ সৃষ্টি করে, মনের তুষ্টি করে বায়ু ও পিত্ত নাশ করে।

চিনি বা মিশ্রি মেশানো দুধ কফকারক কিন্তু বায়ু নাশ করে। এই দুধও বীর্যবর্ধক, বাত, পিত্ত, কফ অর্থাৎ ত্রিদোষ নাশক। গুড় মেশানো দুধ মুত্রকৃচ্ছ্রতায় বা প্রস্রাব কম হওয়া উপকার দেয় কিন্তু কফ ও পিত্ত বাড়িয়ে দেয় ।

নানা রকম রোগ সারাতে ও সুস্থ থাকতে দই, ছানা, মাখন, ঘি, ঘোল ইত্যাদি সব কিছুই খাওয়া হয়। এগুলো সবই দুধ থেকে তৈরি। আমাদের অভিজাত মিষ্টিগুলো যেমন সন্দেশ রসগোল্লা, পাস্তুয়া অবাঙালিদেয় কলাকন্দ, গুলাবজামুন সবই তৈরি হয় দুধ দিয়ে বা দুধজাত পদার্থ দিয়ে।

আরো পড়ুন:  স্বাস্থ্য বিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব হচ্ছে স্বাস্থ্যনীতি, স্বাস্থ্যবিধি, স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়ম ও চর্চা সম্পর্কে জানা

এবারে আয়ুর্বেদ মতে দুধের গুণাগুণ হলও দুধ সুমধুর, স্নিগ্ধ, বায়ু ও পিত্ত হরণ করে, সারক অর্থাৎ মল ও বায়ু নিঃসারণ করে, তৎক্ষণাৎ বীর্য উৎপাদন করে, শীতল, সকলের পক্ষে ভাল, সকলকে বাঁচিয়ে রাখে, পুষ্টিদায়ক, বল বৃদ্ধি করে, বুদ্ধি বৃদ্ধি করে, মৈথুনশক্তি বাড়িয়ে দেয়, যৌবন ধরে রাখে, আয়ু বৃদ্ধি করে, সামর্থ্য বাড়িয়ে দেয়, ভাঙা হাড় জুড়তে সাহায্য করে এবং রসায়ন। রসায়ন অর্থে শরীরের সপ্তধাতু অর্থাৎ রস, রক্ত, মেদ, মজ্জা মাংস, অস্থি ও বীর্যের (শুক্র) পুষ্টি করে। জীর্ণ জ্বর অর্থাৎ পুরোনো জ্বর, মানসিক রোগ, শোষ বা ক্ষয় রোগ ও সাইনাস, মুর্চ্ছা, ভ্রম, পেটের অসুখ (গ্রহণী), জন্ডিস (পাণ্ড), দাহ, তৃষা, হৃদরোগ, শূল, বায়ুগুল্ম, উদাবর্ত, মলমূত্র ও বায়ু রোধক রোগ,  অর্শ, রক্তপিত্ত, যোনিরোগ, গর্ভস্রাব প্রভৃতি রোগে উপকার দেয়।

গরুর দুধের গুণ সম্পর্কে আয়ুর্বেদে বলা হয়েহে দুধের সব গুণ তো এতে আছেই তাছাড়াও আরও বিশেষ গুণ হলো স্তন্যবর্ধক অর্থাৎ এই দুধ পান করলে যাঁরা মা হয়েছেন তাঁদের বুকের দুধ বেড়ে যায়। যে সব বয়স্করা নিয়মিত গরুর দুধ পান করেন তাঁদের বুড়ো বয়সের কোনো অসুখে কষ্ট পেতে হয়। গরুর দুধের আর একটা বিশেষ গুণ হলো এই দুধ রেচক অথাৎ মল পরিষ্কার করায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্যে কষ্ট দূর করে।

সুশ্রুতের মতে, গরুর দুধ, স্নিগ্ধ, ভারী, রসায়ন, রক্তপিত্ত হরণ করে, শীতল, মধুর, জীবনীয় এবং বাত ও পিত্ত নাশক। চরকের মতে, গরুর দুধ সুস্বাদু, শীতল, মৃদু, সিগ্ধ, ভারী, মন প্রসন্ন করে।

সাধারণত তিন রকমের দুধেরই আমাদের দেশে চলন আছে। গরু, মহিষ এবং ছাগলের দুধ। মহিষের দুধের চেয়ে গরুর দুধ বেশি উপকারী  কারণ মহিষের দুধ ভারী ও হজম করা শক্ত। তবে মহিষের দুধের একটা বিশেষ গুণ আয়ুর্বেদে বলা হয়েছে। এই দুধ নিদ্রাকারক অর্থাৎ মহিষের দুধ খেলে ঘুম পায়। ছাগলের দুধ সবচেয়ে সুপাচ্য বলে মনে করা হয়; যে সব বাচ্চারা পেটের অসুখে ভুগছে তাদের খাওয়ালে উপকার পাওয়া যাবে।

গরুর দুগ্ধ সম্পর্কে আয়ুর্বেদে আরও বলা হয়েছে যে ধায়েোষ্ণ বা সদ্য দোহন করা গরম টাটকা দুধ, যা বল বৃদ্ধি করে, হালকা, শীতল, অমৃততুল্য, অগ্নি প্রদীপ্ত করে অথাৎ খিদে বাড়িয়ে দেয়, ত্রিদোষ (কফ, পিত্ত, বাত) নাশ করে।

আরো পড়ুন:  সাল্টু বা এমোনিয়াম সালফেট এবং ইউরিয়া সার ব্যবহৃত হচ্ছে খাদ্য নরম করতে

হাকিমি বা ইউনানি মতে দুধে আছে পাচক বা খাবার হজম করার সক্ষমতা, বীর্য উৎপাদন করে, মন ও মস্তিষ্ককে প্রসন্ন রাখে, শরীরকে নরম রাখে ও পুষ্ট করে, চেহারা সুন্দর করে, বুদ্ধি বৃদ্ধি করে এবং জন্ডিস, মূর্চ্ছা রোগ, অর্শ, ক্ষয় রোগ এবং বৃদ্ধাবস্থার অসুখে উপকার দেয়।

সুস্থ থাকতে দুধের প্রয়োগ:

১. দুধকে গরম অবস্থায় মন্থনী বা ডাল সেদ্ধ করবার কাঁটা হলেও চলবে তা দিয়ে একটু মন্থন করে নিয়ে খেলে হালকা হয়। এই ভাবে মন্থন করা হালকা দুধ মৈথুন শক্তি বাড়িয়ে দেয়, জ্বর সারিয়ে দেয়,পিত্ত আর কফ নাশ করে।

২. গরু বা ছাগলের টাটকা দুধের ফেনা বা ঝগ খেলে অনেক সুফল পাওয়া যায়। এই ফেনা খুব উপকারী। অন্যান্য অনেক উপকারিতার সঙ্গে এই ফেনারও আছে মৈথুনশক্তি বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। পেটের অসুখ ও খিদে না হওয়া এবং পুরানো জ্বরে উপকারি।

৩. জ্বাল দেওয়া গরুর দুধ খেলে হেঁচকি ওঠা বন্ধ হয়।

৪. গরুর দুধে ঘি, শুঠ অর্থাৎ শুকনা আদা, কালো আঙুর মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে খেলে পুরানো জ্বর বা জীর্ণজ্বর সেরে যায়।

৫. গরুর দুধকে গরম থাকতে মিশ্রি ও গোলমরিচের গুঁড়া  মিশিয়ে খেলে সর্দির উপশম হয়।

৬. একশো গ্রাম দুধে অর্ধ চামচ শুঠের বা শুকনা আদার গুড়ো মিশিয়ে আঁচে বসিয়ে খোয়ার মতো খুব গাঢ় করে নিন। রাতে শোয়ার আগে এর সঙ্গে চিনি মিশিয়ে খেলে পিত্ত বিকার দূর হবে।

৭.গরম দুধে চিনি মিশিয়ে খেলে শরীর পৃষ্ট হয়, বল ও বীর্য বৃদ্ধি হয়।

৮. অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে ক্লান্তি হলে দুধকে গরম অবস্থায় খেলে ক্লান্তি কমে যাবে। যাঁরা বেশি পরিশ্রম করেন তাঁদের জন্যে গরম দুধ হলো পরম ওষুধ।

৯. দুধের খোয়ায় চিনি মিশিয়ে খেলে আধকপালে মাথা ব্যথা বা মাথা ধরা সারে।

১০. অল্প একটু গরুর দুধ নিয়ে, তাতে পাঁচ গুণ জল মিশিয়ে জ্বাল দিন। যতক্ষণ পর্যন্ত না জল শুকিয়ে যাচ্ছে আঁচে বসিয়ে রাখুন। এরপরে ঠাণ্ডা করে খেলে রক্তপিত্ত সেরে যাবে।  

১১. গরুর দুধে সম-পরিমাণ জল মিশিয়ে জল শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত জ্বাল দিন। তারপরে সেটা খেলে আমাশয় উপশম হয়।

১২. গরম গরুর দুধে ঘি, চিনি বা গুড় মিশিয়ে খেলে মূত্রকৃচ্ছতা বা প্রস্রাব কম হওয়া সমস্যা দূর হয়।

আরো পড়ুন:  মহুয়া সাপোটাসি পরিবারের মধুকা গণের ভারতবর্ষ ও এশিয়ার চিরসবুজ বৃক্ষ

১৩. গরুর দুধে তুলায় ভিজিয়ে নিয়ে তার ওপর ফটকিরির গুড়া ছড়িয়ে দিয়ে চোখের বন্ধ পাতার ওপর রাখলে চোখের ব্যথা সারে ।

১৪. দুধের মালাই দশ মিনিট ধরে মুখে মালিশ করুন । পরে দশ মিনিট আর মুখ ধুবেন না। তার পরে বেসন দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। মুখের ত্বক উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

১৫. গরুর টাটকা দোহা দুধে একটু ঘি মিশিয়ে এবং তার সঙ্গে একটু মিশ্রি মিশিয়ে খাওয়ালে বাচ্চাদের হাম, বসন্ত, জলবসন্তর জন্যে যে জ্বর হয় সেই জ্বরে উপকার পাওয়া যায়।

১৬. বলা হয়ে থাকে সকালে খালি পেটে অল্প গরম দুধে ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে খেলে শরীর পুষ্ট হয়, খিদে বাড়ে, শুক্র বৃদ্ধি হয়। দুপুরে এইভাবে খেলে খিদে বাড়ে, বল বৃদ্ধি হয়, কফ ও পিত্ত নাশ হয়, রাতেও ঠিক এইভাবেই খেলে চোখের উপকার হয়।  

এখন শহরে তো টাটকা গরুর দুগ্ধ প্রায় পাওয়াই যায় না। সকলেই নানান ডেয়ারির প্লাস্টিকের মোড়কে ভরা দুধকে খেয়ে থাকেন। পাস্তুরাইজ করা অর্থাৎ জীবাণু নষ্ট করা এই দুধও মোটামুটি শরীরের পক্ষে ভাল। এইজন্যে ভাল যে এতে ঘি বা মাখন জাতীয় পদার্থের একটা সমতা রাখা হয়। যেটা খাটালের দুধে ঠিক মতো হয় না। এখনকার নিউট্রিশনিস্ট বা পুষ্টিতত্ত্ববিদদের মতে আগেকার মতো দুধকে পরিপূর্ণ আহার বলে মনে করা না হলেও এতে যে অনেক গুণ আছে এবং এটি যে একটি শ্রেষ্ঠ পানীয় এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা, ২৭-৩১।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Thamizhpparithi Maari

Leave a Comment

error: Content is protected !!