শিম-এ আছে শরীরের বল বৃদ্ধিসহ নানা ভেষজ গুণাগুণ

এটা বর্ষজীবী লতানে গাছ। কোন কিছুকে অবলম্বন করে ওপরে ওঠে, সাধারণতঃ মাচা (মঞ্চ) ও ভারা বেধে দিলে তার ওপর লতিয়ে যায়। পাতা ত্রিপত্র বিশিষ্ট, আকারে দেখতে অনেকটা পারিভদ্রের (পালতে মাদার) পাতার মত কিন্তু পত্রবিন্যাস শাঁকালুপাতার মত। পুষ্পদণ্ড বহু, শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট এবং তাতে রক্তাভ, শ্বেতাভ ও গোলাপী রঙের ফুল ফোটে। শিম বহু, আকারের হয় এবং কয়েক প্রকার রঙেরও হয়ে থাকে; সাধারণতঃ ৫-৬ ইঞ্চি লম্বা ও এক থেকে দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত চওড়া হতে দেখা যায়। শিমে সাধারণতঃ ৫-৭টি বীজ থাকে। বর্ষান্তে বীজ রোপণ করা হয়, শরতে গাছ বেড়ে ওঠে, কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে ফল হয় ও তৎপরে শিম হতে আরম্ভ করে।

ভারতের প্রায় সর্বত্রই সবজি হিসেবে শিমের চাষ হয়ে থাকে, তবে সব প্রদেশেই একই সময়ে চাষ হয় না, কারণ এটা ঋতুকালাপেক্ষী। এর সংস্কৃত নাম শিম্বী, বাংলায় প্রচলিত নাম শিম ও হিন্দীতে সেম, নিষ্পব নামে পরিচিত। বােটানিক্যাল নাম Dolichos lablab Linn.  পরিবার Papilionaceae.[১]

শিম-এর গুণাগুণ:

শিম খেতে তো ভাল লাগে, এটি স্বাদে মিষ্টি কিন্তু খাওয়ার পর পরিপাকে শিম অম্ল বা টক রস উৎপন্ন করে। অনেকের মতে শিম খেলে শরীরের বল বাড়ে, মল পরিষ্কার হয়। কিন্তু সহজে পরিপাক হয় না বলে বায়ু সৃষ্টি করে। শিম শরীরের ভেতরের বিষ নষ্ট করে। কিন্তু সেই সঙ্গে দৃষ্টি শক্তির তেজ কমিয়ে দেয় বলেও অনেকের ধারণা।

আয়ুর্বেদ মতে, শিম গুরুপাক, শৈত্যগুণসম্পন্ন, পিত্তনাশক, কোষ্ঠ বায়ুপ্রকোপক, কটু ও মধুররসাঙ্কিা , অগ্নি, বল ও শুক্রক্ষয়কর এবং ব্রণ, জ্বর ও শ্বাস রোগকর। আরও বলা হয় যাঁদের হজম শক্তি দুর্বল তাঁদের পক্ষে শিম না খাওয়াই ভাল।

পুষ্টিগুণ:

শিমে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, গন্ধক আর লোহা আছে। ভিটামিন এ বেশিমাত্রায় এবং ভিটামিন সি অল্পমাত্রায় আছে । ফ্রেঞ্চ বিন বা ফরাসবিনের চেয়ে শিমের পুষ্টিমূল্য বেশি।

আরো পড়ুন:  আতঁমড়া গুল্ম-এর নানাবিধ ভেষজ প্রয়োগের নিয়ম

শিমের তরকারি রান্না করে খাওয়া যায় শিম বেশি পেকে গেলে শিমের বীজের ডাল রান্না করেও খাওয়া যায়। যোয়ান ফোঁড়ন দিয়ে রান্না করা শিমের তরকারি খেতে অতি সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর। শিম বায়ুকারক। শিমের তরকারি তেল দিয়ে রান্না করলে এই দোষ খানিকটা কমে।[২]

শিম-এর ভেষজ গুণাগুণ:

১. বাত দূর করতে: অনেকে বলেন বেশি শিম খেলে বাত হয় অর্থাৎ শিম বাতল বা বাত-ব্যাধি কারক। কিন্তু শিমের তরকারি যদি রসূন ফোড়ন বা রসুন বাটা দিয়ে রান্না করা যায় তাহলে শিমের এই দোষ আর থাকে না। রসুনের গুণেই বাতব্যাধির আশঙ্কা দূর হয়। সাদা শিম শরীরে বাত ও কফ সৃষ্টি করলেও বিষ নাশ করে। হলদেটে রঙের শিম সবচেয়ে বেশি উপকারী।

২. বায়ু দুর করে: শিম, পরিপাকে মধুর, শীতল অথাৎ শরীর ঠাণ্ডা করে, ভারি অথাৎ গুরুপাক, বলপ্রদ বা বলদায়ক, দাহক, কফকারক বা কফ বৃদ্ধি করে, বাহল অধৎ বাত ব্যাধিকারক, কিন্তু বায়ু ও পিত্ত দূর করে। ঘন সবুজ রঙের চওড়া শিম বায়ু দূর করে, গরিষ্ঠ বা গুরুপাক, শরীর গরম করে, কফ ও পিত্ত বাড়িয়ে তোলে, বীর্য হ্রাস করে, খিদে কমিয়ে দেয়, মলরোধ করে, ভারি কিন্তু রুচিকারক।

৩. রুচি বাড়ায়: বড় আকারের শিম রুচিকর, বাতল, অগিদীপক অথাৎ খিদে বাড়ায় এবং মুখের স্বাদ বাড়িয়ে তোলে। কালচে রঙের শিমের স্বাদ কষায়, পরিপাকে মধুর, রুচিকর, খিদে বাড়ায় এবং মল রোধ করে।

৪. বিছের কামড় আরাম: বিছে কামড়ালে শিম পাতার রস লাগালে আরাম পাওয়া যায়।

৫.বুকের দুধ বাড়ায়: অনেকে বলেন শিম মল রোধ করে আবার অনেকের মতে মল নিঃসারণ করে। অনেকের মতে এটি খেলে গ্যাস বৃদ্ধি হয়। কিন্তু শিমের একটি বিশেষ গুণ হল স্তন্যবর্ধন করা । স্তন্যবর্ধক হিসেবে শিম মেয়েদের কাছে আদরণীয়। যে সব মেয়েরা বাচ্চাদের দুধ খাওয়ান শিম খেলে তাঁদের বুকের দুধ বাড়বে।

আরো পড়ুন:  সাদা ঢেকিয়া ভেষজ গুণসম্পন্ন ফার্ন

৬. জ্বর: এই জ্বর কিন্তু পিত্তশ্লেষ্ম না হলে শিমের বীজের ব্যবহার করবেন না। অর্থাৎ যে জ্বরে জিভে একটা চটচটে প্রলেপ পড়ে থাকবে, মাঝে মাঝে ঝিমুনি, অরুচি, অথচ পিপাসা, আবার মাঝে মাঝে শীত করবে। এই রকম উপসর্গ দেখলে শিমের বীজ বালিতে ভেজে, ভেঙ্গে, খোসা বাদ দিয়ে চূর্ণ করে নিতে হবে; সেই চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় এক কাপ গরম জলে ভাল করে নেড়ে মিশিয়ে নিয়ে দিনে অন্ততঃ ৩ বার খেতে হবে।

৭. অগ্নিমান্দ্যে: অগ্নিমান্দ্য অনেক কারণেই হয়, আর অনেক রকমও হয়। তবে যে অগ্নিমান্দ্যে বমি বমি ভাব, আর যে রসের খাদ্য (টক, তিতা ও মিষ্টি খেয়ে সেই রসেরই আস্বাদে ভরা ঢেকুর ওঠে আর দেহটা ভারী হয়ে থাকবে, সেই অজীর্ণে শিমবীজ চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম সকালে বৈকালে ২ বার আধ কাপ গরম জলসহ খেলে অগ্নিমান্দ্যটা কমে যাবে এবং শরীরটা সামলে যাবে।

৮. রক্তস্রুতিতে: নাক দিয়ে রক্ত পড়া, এটা সাময়িকও হয় এবং ঊধর্বগত রক্তপিত্তের লক্ষণ থাকলেও হয়। যাই হোক, ওসময় শিমবীজ চূর্ণ (এটা ভাজা নয়) সকালে ও বিকালে দু’বার ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় ঠাণ্ডা জলসহ খেলে রক্তস্রুতি বন্ধ হয়ে যাবে।

৯. সম্ভোগের অপূর্ণতায়: এক্ষেত্রে শিমের বীজ রাত্রে দুধে ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকালে সেগুলির খোসা তুলে ফেলতে হবে। দুধটা ফেলার দরকার নেই, ওর সঙ্গে আরও খানিকটা দুধ ঢেলে দিতে হবে। তারপর ওই শিমের বীজগুলি শিলে বেটে ওটাকে গাওয়া ঘিয়ে ভেজে নিতে হবে। একটু লালচে আভা হলে নামাতে হবে। তারপর বীজের দ্বিগুণ মাত্রায় চিনি মিশিয়ে পাক করে নামাতে হবে। এর সঙ্গে একটা জায়ফল চূর্ণ মেশাতে হবে। এই হালয়া এমন পাক হওয়া উচিত যেন নষ্ট না হয়। প্রত্যহ ৫ গ্রাম মাত্রায় দুধসহ একবার অথবা দুইবার সকালে ও বিকালে খেলে চাহিদাটা মিটে যাবে। ৫-৭ দিন খাওয়ার পর এটার অনুভূতি হয়।

আরো পড়ুন:  ভাঁট বা ঘেঁটু গাছের নয়টি ভেষজ গুণাবলি ও প্রয়োগ

১০. অন্যান্য: এ গাঢ় সবুজ রঙের শিমের চেয়ে সাদা শিম পথ্য হিসেবে ভাল। বলা হয় সাদা শিম শ্লেষ্ম, বাত, পিত্ত ও ব্রণদোষ নাশ করে। চুন ও শিম পাতার রসের প্রলেপ লাগালে কানের লতির বা কর্ণমূলের ফোলা সারে এবং গলায় প্রলেপ লাগালে গলার ব্যথা কমে। ব্যবহার্য অংশ-পাতা, বীজ ও মূল।[১][২]

CHEMICAL COMPOSITION

Dolichos lablab 1. Analysis of green material :- (a) Moisture 79.9%, (b) Organic matter 17.8%, (c) Ash 2.3%, (d) Nitrogen 0.71%, (e) lime 0.43% (f) Potash 0.3%, (g) Phosphoric acid 0.18%. 2. Analysis of dry pulse:(a) Moisture 9.6%, (b) Protein 24.9%, (c) Fat 0.8%, (d) Mineral matter 3.2%, (e) Fibre 1.4%, (f) Carbohydrates 60.1%, (g) Calcium 0.066%, (h) Phosphorus 0.45%. 3. The chief protein of the bean is globulin, dolichosin.[১]

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৪, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ১৪৮-১৫০।

২. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা,১১৬-১১৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!