পালংশাক বর্ষজীবী গুল্ম, ভারতের প্রায় সর্বত্রই চাষ হয়; বর্ষাতে এটির চাষ ভাল হয়। ৩/৪ মাস পরে এর বীজ পেকে যায়, সাধারণের কাছে এই গাছের বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এর আদি জন্মস্থান কোথায় সেটা নিয়ে মতভেদ আছে, তবে অনেকের মতে এটির জন্মস্থান নাকি আফ্রিকা।
ঔষধার্থে ও আহার্যে সমগ্র গাছই ব্যবহার হয়। এর পাকা বীজ থেকে চর্বিজাতীয় তেল পাওয়া যায়। এটির বোটানিক্যাল নাম Spinacia oleracea Linn., এর আর একটি প্রজাতি আছে, সেটার নাম Spinacia tetrandra Roxb., পরিবার Chenopodiaceae[১]
পালং শাকের উপকারিতা:
শাকের রাজা পালং অনেকেই বলে। আমাদের দেশে প্রাচীন কাল থেকে পালং শাক খাওয়া হয়ে আসছে। পালং শাকের অনেক গুণ। পালং শাক অনেক অসুখ সারায়। শরীরের ভেতরকার অর্থাৎ কিডনি বা গলরাডারের পাথর গলিয়ে বের করে দেয় এইতেই পালং শাকের সবচেয়ে বড় গুণ। ফুসফুসের অসুখেও পালং শাক উপকারী। প্রায় সব শাকেই ক্ষার পদার্থ (অ্যালক্যালি) বেশি আছে বলে অর্থাৎ ক্ষারজ বলে শরীরের বেশি উপকার করে।
আন্ত্রিক রোগে বা অন্ত্রের অসুখে, পেটের অসুখে, একটানা পেটের অসুখে ইত্যাদিতে পালং শাক খেলে উপকার পাওয়া যায়। টমেটোকে বাদ দিলে অন্য সব তরিতরকারির মধ্যে পালং শাকই সবচেয়ে বেশি শক্তিবর্ধক । পালং শাকে লোহা ও তামা আছে।
এই শাক জন্ডিস রোগীর পথ্য। এই শাকে শরীরে রক্ত বাড়াবার গুণ বেশি আছে; শুধু রক্ত বৃদ্ধিই করে না রক্ত-শুদ্ধিও করায় অর্থাৎ রক্তের দোষ নাশ করে, হাড় মজবুত করে। সত্যি কথা বলতে কি পালং শাকের টাটকা সবুজপাতা হলো জীবনীশক্তির মূল। যদি আর্থিক অসুবিধের জন্যে বাচ্চাকে বেশি দুধ না খাওয়ানো যায় তাহলে ডাক্তারের পরমর্শ নিয়ে অল্প পরিমাণে যতটা সহ্য করতে পারে টাটকা পালং শাকের রসও খাওয়ানো যেতে পারে, সেই সঙ্গে অবশ্য দুধও খাওয়াতে হবে।
গুণগত দিক থেকে দেখতে গেলে পালং শাক ভাজা, পালং শাকের চচ্চড়ি সব তরকারির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পালং শাক রান্নার ব্যাপারে কয়েকটি কথা পরে বলা যাবে। এই শাক প্রশ্বাসের কষ্ট দূর করে পিত্তের পক্ষে উপকারী, কফের কষ্ট দূর করে, জমে থাকা মল মুক্ত করে। এই শাক শীতল।
বিখ্যাত বৈদ্য সুশ্রুতের মতে পালং শাক রুক্ষ এবং পিত্ত ও কফে পক্ষে হিতকর। পালং শাক রুচি বৃদ্ধি করে, প্রস্রারের মাত্রা বৃদ্ধি করে। শোথ বা শরীর ফোলা রোগের পক্ষে উপকারী, সব রকম ব্যাধি নিবারণ করে শরীরে সামঞ্জস্য বিধান করে ও মন শাক্ত রাখে। তাড়াতাড়ি হজম হয়।
পালং শাক-এর ভেষজ গুণ:
১.অন্ত্রের সমস্যা দূর করতে: শরীরের অন্ত্র সচল রাখে এবং অন্ত্রের ভেতরে জমে থাকা মল বের করে দেয়। ডায়বেটিসের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী।
২. লিভার সুস্থ্য রাখে: পালং শাকের বীজও মল নিষ্কাশনে সাহায্য করে, শরীর ঠাণ্ডা রাখে। লিভারের অসুখ জনডিস ও পিত্তের রোগ উপশম করে। কফ ও শ্বাসের রোগেও উপকারী।
৩. কৃমি ও মূত্রের সমস্যা দূর করে: পালং শাকের বীজের ঘন তেল কৃমি ও মূত্রের রোগে সুফল দেয়।
৪. শ্বাস নালীর সমস্যা দূর করে: পালং শাকের বা পালং বীজের কাথ গলা (কণ্ঠ) ফুসফুস, শ্বাসনালিকার কষ্ট ও শরীর জ্বালা করে এমন জ্বরেও খাওয়ানো হয়।
৫. গলা জ্বালা দূর করে: এই সমস্যায় পালং শাকের রস দিয়ে কুলকুচি করে আরাম পাওয়া যায়।
৬. কিডনির পাথর গলে যায়: পালং শাকের ক্বাথ বা রস খেলে কিডনির পাথর গলে গিয়ে প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়।
৭. ফোড়া সারে: পালং পাতা পিষে নিয়ে পুলটিক্স তৈরি করে বাঁধলে কাঁচা ফোড়া বা গাঁঠ তাড়াতাড়ি পেকে যায়। ফোড়া বা গাঁটের জন্যে যদি জ্বর আসে তাও সেরে যায়।
৮. রাতকানা রোগ সারাতে: সেই জন্যে অসুখ বা অনেকদিন রোগে ভোগবার পর পালং শাক খেতে দেওয়া হয়। এছাড়া পালং শাকের শেকড় ঘিয়ে ভেজে খেলে রাতকানা রোগের উপকার হয় এমনও অভিমত আছে।
৯. ত্বকের সমস্যা সারাতে: পোড় ঘায়ে, ক্ষতস্থানে, ব্রণতে বা কালশিরা পড়লে টাটকা পালং পাতার রসের প্রলেপ লাগালে উপকার পাওয়া যায়।
১০. পেটের অসুখ দূর করতে: পালং-এর বীজ শরীরে ঘাম সৃষ্টি করে, স্নিগ্ধতা বাড়ায়, পেটের অসুখ, একটানা পুরনো পেটের অসুখে উপকার দেয়।
১২. রক্ত শুদ্ধ করে: পালং শাক রক্ত পরিষ্কার করে, রক্ত বৃদ্ধি করে, চোখে জ্যোতি ফুটিয়ে তোলে, মুখের লাবণ্য বাড়িয়ে দেয়।[২]
১৩. শ্লেমার দাস্ত: যাঁরা শ্লেষ্ম-প্রধান প্রকৃতির, তাঁদের পক্ষে পালং শাক খুবই উপকারী। যাঁরা বাত-পিত্ত-প্রধান প্রকৃতির, তাঁদের যদি আগন্তুক কারণে শরীরে কফের আধিক্য হয় যেমন—জল ঘাটলে, রোদ লাগালে, পেট গরম হলে বা ঠাণ্ডায় বেড়ানো প্রভৃতির ফলে, তাঁদের কিন্তু দেখা যায়— দান্ত পরিষ্কার হয় না, এটা প্রকৃতির এমনই স্বভাব। এক্ষেত্রে পালং শাক আন্দাজ ৫০ গ্রাম অল্প একটু, সিদ্ধ করে জলটা ফেলে দিয়ে পুনরায় ৩/৪ কাপ জল দিয়ে ভালভাবে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে সেই জলটা খেলে পায়খানাটা পরিষ্কার হয়, জমাট কফ আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে।
১৪. মাথা ঘোরা কমাতে: যেকোন আগন্তুক কারণে মাথা ঘোরায়, যেমন কাঁচা সুপুরী বা সুপারী গাছের মাথী কিংবা ধুতরার বীজ অথবা সিন্ধি, তাড়ি, তামাক, জর্দা প্রভৃতি খাওয়ার পর মাথা ঘুরছে বা বমি হচ্ছে। এক্ষেত্রে পালং শাকের রস ৪/৫ চা-চামচ অল্প গরম করে অথবা আন্দাজ ৫০ গ্রাম পালং শাক অল্প সিদ্ধ করার পর জলটা ফেলে দিয়ে পুনরায় ৩/৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে খাওয়ালে মাথা ঘোরা ও মত্ততা দুই-ই কমে যায়।
১৫. হাঁপ ধরায়: অনেকের অল্প কারণেই হাঁপ ধরে, এটা অনেক কারণে হয়— বুকের দুর্বলতায়, মেদবৃদ্ধিতে, মূত্রকৃচ্ছতায় ও শর্করামেহ প্রভৃতিতে; সেসব ক্ষেত্রের বিশেষ লক্ষণ পায়খানাটা কষে যায়, তাঁরা যদি পালংশাক উপরিউক্ত পদ্ধতিতে সিদ্ধ করে সেই জলে অল্প মরিচ ও লবণ দিয়ে খান, তাহলে হাঁপটা আর ধরে না। আমাদের রোজকার খাওয়ার পালং শাকের সংস্কৃত ভাষায় অনেক শ্রুতি মধুর নাম আছে- সুপত্র, স্নিগ্ধপত্রা, দুরিতা, চিরিতচ্ছদা।[১]
১৬. পাথুরি রোগে: পালং শাকের উপকারিতা সম্বন্ধে ভিন্ন মতও শোনা যায়। অনেকের মতে বেশি পালং শাক খেলে মূত্রাশয়ে পাখরি সৃষ্টি হয় বা পাথর জমে।
পালং শাক-এর পুষ্টি গুণ:
বৈজ্ঞানিক মতে এই শাকে ভিটামিন এ, বি, সি, ই আছে। প্রোটিন, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ক্লোরিন আর লোহা আছে। পালং শাক শরীরে রক্ত বাড়ায়। পালং শাকে প্রোটিন উৎপাদক অ্যামিনো অ্যাসিড বেশি পরিমাণে আছে। এর সবুজ পাতায় এমন গুণ আছে যে খেলে শরীরের বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে। বুদ্ধি বা মেধা বাড়াতেও সাহায্য করে। আমরা রোজ যে ভাল খাই তার প্রোটিনের মধ্যে অ্যামিনো অ্যাসিড নেই। সেইজন্যে ডালের মধ্যে পালং শাক দিয়ে রান্না করলে রোজকার খাদ্য তালিকায় অ্যামিনো অ্যাসিডের মাত্রা বাড়বে।
অনেকে বলেন পালং শাকের আদি জন্মভূমি ভারত। আয়ুর্বেদ মতে পালং শাক মধুর, শীতল, নাক মুখ থেকে রক্তপড়া (রক্তপিত্ত) বন্ধ করে, বিষের দোষ নাশ করে, মলরোধ করে, (অনেকের মতে মলকারক), ত্রিদোষ অথাৎ বাত, কফ ও পিত্তের নাশক। কেউ কেউ আবার বলেন বাত হলে পালং শাক খাওয়া ভাল নয়।
খাওয়ার নিয়ম:
১. পালং শাক ভাজায় জল দেবেন না পালং শাকের জলেই যেন তা সেদ্ধ হয়ে যায়। প্রয়োজন হলে বা সেদ্ধ না হলে খুব অল্প পরিমানে জল দেবেন। রান্নার পর যেন বাড়তি জল ফেলে না দেওয়া হয়। জল ফেলে দিলে সেইজলেই শাকের পোষক বা উপকারিতা বেরিয়ে যাবে।
২. পাঁচমিশালি তরকারির সঙ্গে মিশিয়ে পালং শাক, শিম পালঙের চচ্চড়ি অর্থাৎ পালং শাকের ডাঁটা ও নরম বীজ সহ খেলে পালং শাকের উপকারিতা তত পাবেনই সেইসঙ্গে অন্য তরকারির গুণ এবং ভিটামিনও যুক্ত হবে।
৩. ডালের প্রোটিনে অ্যামিনো অ্যাসিড নেই কিন্তু পালং শাকে আছে। কাজেই ডালও পালং শাক মিশিয়ে রান্না করলে তা শরীরের পক্ষে বেশি উপকারী।
টক পালং শাকের উপকারিতা:
টক পালং বা চুকা পালং শাককে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় চুক্রিকা বা চুক্রক। এই শাক দেখতে সাধারণ পালং শাকের মতোই কিন্তু টক আস্বাদযুক্ত অথাৎ খেতে টক। এই শাক বা কফ ও পিত্ত (ত্রিদোষ) নাশ করে। সহজে হজম হয়, খাওয়ার রুচি বাড়ায়। বায়ুজনিত অস্বস্তি বা গুল্ম বা বায়ুগোলক দূর করে, বিষ নাশ করে, মল রোধ করে।
চিনির রস মিশিয়ে খেলে পিত্তের আধিক্য সারাবার পক্ষে বেশি উপকারী। দাঁতের ব্যথা সারে বমি বন্ধ হয়, খিদেও বাড়ে। চুকো পালং-এর রসের প্রলেপ লাগালে বিছের কামড়ের বিষ দূর হয়। ব্যথা সেরে যায়। রস গরম করে কানে সেই রসের ফোঁটা দিলে কানের ব্যথা সারে। টক পালঙের বীজ ঘিয়ে ভেজে খেলে আমাশার উপশম হয়।[২]
CHEMICAL COMPOSITION
Spinacia olenacea (Linn)
1. Spinach contains :- Water 88.47%; (b) Nitrogenous matter 3.49%; (c) Fat 0.58%; (d) Sugar 0.10%; (e) Nitrogen free extractive 4.34%; (f) Ash 2.09%; (g) Fibre 0.93%. 2. Anhydrous spinach contains:(a) Nitrogen 4.94%; (b) Carbohydrates 37.93%.[১]
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৪, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ৮৬-৮৭।
২. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা,১৩১- ১৩৪
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।