কল্পলোক বা কল্পরাষ্ট্র (ইংরেজি: Utopia) হচ্ছে এমন এক নিখুঁত সমাজ ব্যবস্থা যেখানে হিংসা, নিপীড়ন অথবা সম্পত্তি বলে কিছু থাকবে না। প্রাচীন গ্রিস থেকে কল্পলোক বা কল্পরাষ্ট্র প্রত্যয়টি এসেছে। ইউটোপিয়া কথাটির অর্থ হলো কোথাও নহে। তাই থেকে উদ্ভূত ইংরেজি ইউটোপিয়া কথার বাংলা প্রতিশব্দ কল্পলোক। সার টমাস মাের ‘ইউটোপিয়া’ (১৫১৬) শব্দটি চয়ন করেন। তিনি এমন এক নিখুঁত সমাজব্যবস্থা কল্পনা করেছিলেন যেটি হবে হিংসা, নিপীড়ন অথবা সম্পত্তিবিহীন। মোরের চিন্তায় এক আদর্শ সমাজের পূর্ণাঙ্গ কল্পচিত্র পাওয়া যায়। শব্দটি সেই থেকে চলে আসছে।
কল্পলোক প্রত্যয়টির অন্যতম প্রবক্তা কার্ল ম্যানহাইম বর্তমান ঐতিহাসিক সামাজিক অবস্থার রূপান্তরে পরিবেশগত এক কাল্পনিক ভাবনা হিসেবে শব্দটি ব্যবহার করেন। অনুরূপ যে-কোনও চিত্র বােঝাবার সুবিধার্থে এবং সমালােচনার সময় এটি ব্যবহৃত হয় যখন আদর্শ মানবচরিত্র অঙ্কনে তার বিরূপ প্রকৃতিসমূহ বাদ থাকে।
কল্পলোকিক সমাজতন্ত্র
কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসকে মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠা ও অগ্রসর করার জন্য বিভিন্ন রূপের কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী, ক্ষুদে বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রীসহ অপ্রলেতারীয় মতবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়েছিল। মূলত ফরাসি বিপ্লব পরবর্তীকালে কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রের (ইংরেজি: Utopian Socialism) উদ্ভব। সাঁ সিমোঁ, শার্ল ফুরিয়ে এবং রবার্ট ওয়েন ছিলেন কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা।[২]
প্রথম দিকের সমাজতন্ত্রী যেমন ফুরিয়ে ও রবার্ট ওয়েনকে মার্কস ও এঙ্গেলস কল্পনাবিলাসী আখ্যা দিয়ে সমালােচনা করেন এই বলে যে আদর্শ সমাজচিত্র কল্পনার সঙ্গে তার রূপায়ণের মধ্যে বাস্তব সঙ্গতি নেই। মার্কসীয় সমাজতন্ত্র বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত বলে দাবি করা হয়, তা ছাড়াও তাতে প্রকৃত সামাজিক অবস্থার সম্যক অবগতি এবং সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়ােজনীয় রূপান্তরের প্রশ্ন যথােচিত গুরুত্ব পায়। মার্কসীয় দৃষ্টিতে সমাজতন্ত্র হলো ঐতিহাসিক বিবর্তনধারায় অনিবার্য, নিছক তত্ত্বালােচনামাত্র নয়। ভবিষ্যতের জন্য আদর্শ পরিকল্পনার প্রয়ােজন নেই, চাই বর্তমান অবস্থা ও তার অন্তর্নিহিত নানান প্রবণতার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। মার্কসীয় চিন্তাতেও অবশ্য রাষ্ট্রের অবলুপ্তির ভাবনা কল্পরাষ্ট্রের গােত্রে পড়ে।
কল্পরাষ্ট্র চিন্তার সমালােচনা শুধু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দিক থেকেই করা হয়নি; বাস্তব রাজনীতি ও স্থিতাবস্থার পক্ষপাতী ও পরিবর্তনবিমুখ রক্ষণশীলেরাও তার সমধিক সমালােচনা করেন। কল্পরাষ্ট্র সমাজ নিখুঁত আদর্শ সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তােলার জন্য সচেতনভাবেই সমষ্টিবাদী। কল্পরাষ্ট্র ব্যবস্থার বিভিন্ন সমালােচনায় একথাও বলা হয় যে অশুভ পরিবেশ থেকে মুক্তি এবং আদর্শ সমাজের প্রতিষ্ঠাকল্পে এর সমর্থকেরা বিশ্বকে ক্রমান্বয়িতভাবে এক উচ্চতর স্তরে উন্নীত করার জন্য উৎসাহ দান করেন। সঠিক দৃষ্টিতে ‘কোথাও নহে’ হলো কল্পরাষ্ট্রের তত্ত্বগত চরিত্র; শিল্পসাহিত্যের জগতে এটি একটি মননক্রিয়া বিশেষ; সমাজবিজ্ঞানে প্রযােজ্য নয়; উদ্দেশ্য হল প্রশ্নসূচক ও সমালােচনাশীল চেতনাকে জাগিয়ে তােলা, রূপায়ণের জন্য সুস্পষ্ট কোনও নকশা তুলে ধরা নয়।
কল্পলোকবাদ
বহু সংস্কৃতি, সমাজ এবং ধর্মে, দূরবর্তী অতীতের কিছু কল্পকাহিনী বা স্মৃতি রয়েছে যখন মানবজাতি আদিম এবং সরল অবস্থায় বাস করত কিন্তু একই সাথে নিখুঁত সুখ এবং পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারত। সেই দিনগুলিতে, বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী আমাদেরকে জানায়, মানবতা এবং প্রকৃতির মধ্যে একটি সহজাত সাদৃশ্য ছিল। মানুষের চাহিদা কম ছিল এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিলো সীমিত। উভয়ই প্রকৃতির সরবরাহকৃত প্রাচুর্যে সহজেই সন্তুষ্ট হয়েছিল। তদনুসারে, সেখানে যুদ্ধ বা নিপীড়নের জন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না; বা কঠোর ও বেদনাদায়ক কাজের প্রয়োজনও ছিল না। মানুষ সরল ও পুণ্যবান ছিল। একটি নৃতাত্ত্বিক তত্ত্ব অনুসারে, শিকার-সংগ্রাহকের যুগ ছিলো প্রকৃত সমৃদ্ধিশালী সমাজ।
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৭৭।
২. অনুপ সাদি, “কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র”, সমাজতন্ত্র, ভাষাপ্রকাশ ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, পৃষ্ঠা ৩৭-৪৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।