সাধারণ দৃষ্টিতে জনগণ (ইংরেজি: People) শব্দটির অর্থ হলো যে নির্দিষ্ট কোনো ভূখণ্ডের অধিবাসী যাদের ভাষা ও সাহিত্য একই এবং বিশেষ এক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থাকে। যেসব ব্যক্তির আচার ব্যবহার, বেশভূষা, মূল্যবােধ ও সংস্কৃতি প্রায় অভিন্ন, তারা সমষ্টিগতভাবে সেখানকার জনগণ হিসাবে পবিচিত। সমষ্টিগতভাবে এই বৈশিষ্ট্যগুলি সমাজবন্ধনের প্রকৃত সূত্র, জাতি গঠনের প্রধান উপাদান।[১] সাধারণভাবে এই অর্থে, কোনো রাষ্ট্র বা দেশের সমস্ত জনসংখ্যাকে জনতা বলা হয়। কিন্তু বর্তমানকালে জনতা শব্দের একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে।
পুঁজিবাদী দৃষ্টিতে জনগণ
একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিবাসীরা সেখানকার সরকার তথা রাষ্ট্রের যেমন অধীন, আবার তারাই হলো তার নিয়ন্ত্রণকারী। তাই আব্রাহাম লিঙ্কনের মতানুসারে বলা হয় ‘সরকার জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য’। আধুনিক প্রত্যয় অনুসারে জনগণই হলো সার্বভৌমত্বের উৎস। গণতন্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত ভোটের উদ্দেশ্য হলো জনগণের অভীপ্সা নির্ণয়। রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ও কর্মপন্থার পিছনে বৈধতা নিরূপণ করে জ•গণ। জনগণই হলো মার্কসবাদী মতানুসারে জনগণতান্ত্রিক সরকারের স্রষ্টা।[১]
বামপন্থী দৃষ্টিতে জনগণ
মার্কসবাদী রাজনীতিক তত্ত্বে জনগণ দ্বারা সমগ্র জনসংখ্যাকে বুঝানো হয় না। মার্কস জনগণ বলতে কোনো দেশ বা সমাজেই সেই জনসংখ্যাকে বুঝিয়েছেন যে জনাংশ তার অর্থনীতিক এবং ঐতিহাসিক অবস্থানের কারণে সমাজকে বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নততর ভবিষ্যৎ অবস্থায় নিয়ে যেতে সক্ষম। মার্কসবাদের মতে সমাজে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেওয়ার পূর্বকালেই মাত্র জনসংখ্যা এবং জনতা সমার্থক ছিল। কিন্তু সমাজে শোষক এবং শোষিত শ্রেণীর উদ্ভব হওয়া থেকে যে কোনো যুগে কিংবা দেশে জনতা বলতে জনসংখ্যার শোষিত অংশকে বুঝায়।[২]
সমাজের বিকাশের কোনো একটা বিশেষ সামাজিক অবস্থার মধ্যে যখন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত হয় তখন জনসংখ্যার সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসেরও পরিবর্তন ঘটে। এক যুগে কিংবা এক পর্যায়ে যে জনতা শোষিত বলে পরিগণিত হয়েছে, পরবর্তীযুগে সে জনতা আর শোষিত না থাকতে পারে। এমন পরিবর্তিত অবস্থায় জনতা বলতে পূর্বের চেয়ে ভিন্নতর জনাংশকে বুঝাবে। এই বিচারের ভিত্তিতে সামন্তবাদী যুগে অগ্রসর শক্তি হিসাবে জনতার মধ্যে বিকাশমান পুঁজিবাদী শ্রেণীও ছিল। কিন্তু পুঁজিবাদী পরিবর্তন সম্পন্ন হওয়ার পরে পুঁজিবাদী শ্রেণী পরিপূর্ণরূপে শোষক এবং সামগ্রিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিতে পরিণত হওয়াতে জনাংশের এই অংশকে আর জনতার অন্তুর্ভুক্ত করা চলে না।
এই যুগে জনতা হচ্ছে বৈপ্লবিক চেতনাসম্পন্ন সর্বাধিক পরিমাণে শোষিত, কারখানার শ্রমিক এবং তার সহযোগী শোষিত গরিব কৃষক ও মধ্যবিত্ত। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণীহীন সমাজ সৃষ্টির সূচনায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনসংখ্যা আর জনতা পুনরায় সমার্থক হয়ে দাঁড়াবার সম্ভাবনা প্রাপ্ত হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অর্থনীতিকভাবে কোনো শোষক শ্রেণীর অস্তিত্ব নেই। তাই সেখানে জনতা বলতে সমাজের সমস্ত অধিবাসীকেই বুঝায়।
দ্রষ্টব্য: জাতি, জাতি-রাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ, জাতিত্ব, রাষ্ট্র
তথ্যসূত্র
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ১০৯।
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩০৬।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।