সমাজতান্ত্রিক সমাজের শ্রেণি কাঠামোর প্রকৃতি

সমাজতান্ত্রিক সমাজের শ্রেণি দুই প্রধান ভাগে ভাগ হলও শ্রমিক শ্রেণি ও সমবায়ী কৃষক। পুঁজিবাদী সমাজে যে প্রলেতারিয়েত উৎপাদনের উপায় থেকে বঞ্চিত এবং পুঁজিবাদীদের নিকট নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রয়ে বাধ্য সেই প্রলেতারিয়েত সমাজতান্ত্রিক সমাজে নেই। বরং সমাজতন্ত্রে শ্রমিক শ্রেণি সমগ্র জনগণের সংগে উৎপাদনী উপায়ের মালিক এবং শোষণ থেকে মুক্ত। প্রলেতারিয়েতের এজনায়কত্ব কায়েম এবং উত্তরণ পর্ব শুরু হবার পর থেকে শ্রমিক শ্রেণির আপেক্ষিক গুরুত্ব ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বদলে যায় তাদের গুণগত গঠন, সংস্কৃতি ও শিক্ষার মান।

সমাজতন্ত্রে বৈরি শ্রেণি নেই, কেননা কলকারখানা, ভূমি, সবই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সম্পত্তি। সমাজতন্ত্রে শ্রেণিশোষণ বিলুপ্ত হয়। শুরু হয় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। সমাজতন্ত্র গঠনের প্রাথমিক কাজের গতিপথে ক্ষুদে কৃষি জোতের সমবায়ীকরণ, যৌথায়ন করা হয়; অর্থাৎ এক একটা ব্যক্তিগত ছোট সম্পত্তিগুলোকে পরিণত করা হয় যৌথখামারের সমস্ত সভ্যের এজমালি মালিকানায়। যৌথখামারকে রাষ্ট্র জমি দেয় দীর্ঘকাল ব্যবহারের জন্য। এইভাবে গড়ে ওঠে বড় বড় কৃষি উদ্যোগ, কৃষিকাজে ও পশুপালনে সাম্প্রতিক টেকনোলজি ও বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বের প্রয়োগ যেখানে সম্ভবপর। কৃষকদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক, শ্রম জীবনযাত্রা, সামাজিক প্রকৃতিতে সূচিত হয় আমূল পরিবর্তন। যৌথীকরণে গ্রাম মুক্ত হয় ধনী চাষির গোলামি ও শ্রেণিগত স্তরভেদ থেকে। উৎপাদনের উপকরণ ও উপায়ের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার সংগে সম্পর্কচ্ছেদ করে কৃষকেরা ক্রমশ পরিণত হচ্ছে এমন শ্রেণিতে যা সমাজতান্ত্রিক সমাজের সামাজিক মালিকানার সংগে সরাসরি জড়িত।

সমাজতান্ত্রিক দেশের সামাজিক কাঠামোয় একটা বড় স্থান থাকে মনীষীদের [Intellectuals]। প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব কায়েম এবং শোষক শ্রেণিদের উচ্ছেদের ফলে মনীষীরা পরিণত হয় সেই সামাজিক স্তরে যা সমস্ত শ্রমজীবীর চাহিদা মেটায়। মনীষীদের স্বার্থ হয়ে দাঁড়ায় শ্রমিক ও কৃষকদের স্বার্থ থেকে অবিচ্ছিন্ন। অর্থাৎ আগেকার বুর্জোয়া মনীষীদের পাশেই দেখা দেয় নতুন শ্রমিক-কৃষক মনীষী।   

সমাজতান্ত্রিক সমাজে মেহনতি শ্রেণিদের ভেতর, শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে, তথা তাদের সংগে বুদ্ধিজীবীদের, মানসিক শ্রমের লোকেদের পার্থক্য তখনও টিকে থাকে, কিন্তু সে প্রভেদ বৈরি নয়, কেননা সমস্ত সামাজিক গ্রুপের মূল ও প্রধান স্বার্থ অভিন্ন; সমস্ত জনগণই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংহতি ও বিকাশে, সমাজের আরো অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে, কমিউনিজম নির্মাণে স্বার্থত্যাগী।

আরো পড়ুন:  প্রলেতারিয়েত অষ্টাদশ শতক পরবর্তীকালের শ্রমশক্তি বিক্রিকারী শ্রমিক শ্রেণি

কমিউনিস্ট পার্টি সামাজিক অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ ও সেগুলো অনুসরণ করে পার্টি সভ্য বাছাই ও নির্বাচন করে সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রাধান্যকারী ভূমিকা পালন করে। সমাজতন্ত্রের বিকাশ ও বাস্তবায়নের গতিপথে সামাজিক শ্রেণিগত বিন্যাস যথেষ্ট বদলে যায়। সমাজতান্ত্রিক সমাজের শ্রেণি পরিবর্তনের শুরুটা পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ পর্বের সাথে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। সমাজের শ্রেণি কাঠামোর বৈপ্লবিক রূপান্তরের জন্য প্রয়োজন হয় বেশ দীর্ঘকালীন একটি  উত্তরণ পর্বের, কেননা জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের জন্য সময় দরকার। বুর্জোয়া ও ক্ষুদে বুর্জোয়া ব্যবস্থাপনার অভ্যাস জয় করা যায় কেবল দীর্ঘ ও একরোখা সংগ্রামের মাধ্যমে।   

সমাজতান্ত্রিক সমাজের আরো বিকাশের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য ক্রমশ মুছে যাবে। বৈজ্ঞানিক টেকনিকাল বিপ্লবের দৌলতে কৃষি উৎপাদন পরিণত হবে শিল্পোৎপাদনের ভিন্ন রকমে। জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির দিক থেকে গ্রাম শহরের দিকে কাছিয়ে আসে। বর্তমানের বৈজ্ঞানিক টেকনিকাল অগ্রগতি সামাজিক বিন্যাস পরিবর্তনের সহায়ক। যত উন্নত হবে টেকনিক, যত ব্যাপকভাবে উৎপাদনে প্রযুক্ত হবে বিজ্ঞানের কৃতিত্ব, যত প্রসারিত হবে স্বয়ংক্রিয়তা ও যৌগিক যন্ত্রায়ন, ততই প্রয়োজন হবে উচ্চ যোগ্যতার শ্রম, কায়িক ও মানসিক শ্রম আসবে ততই কাছাকাছি। জনগণের শিক্ষার মান যত বাড়বে মেহনতিদের সংগে বুদ্ধিজীবী ও বাকি অংশের মধ্যে সীমারেখা মুছে যাবে।

শ্রেণিহীন সমাজ গঠনই হলও কমিউনিস্ট আন্দোলনের শেষ লক্ষ্য, কেননা এই সমাজেই দূরীভূত হবে অর্থনৈতিক অসাম্য, গড়ে উঠবে প্রত্যেকের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের পরিস্থিতি। লোকেদের মধ্যে পার্থক্য থাকবে কেবল গুণে, সামর্থ্যে, আকর্ষণ ক্ষেত্রে, জ্ঞানের মাত্রায় ইত্যাদিতে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত শ্রেণি থাকছে, ততদিন সমাজে প্রধান ভূমিকা নিচ্ছে ও নেবে শ্রমিক শ্রেণি, কেননা এ হলও সবচেয়ে ঘনবদ্ধ ও সংগঠিত শ্রেণি, কেননা সেই হলও সর্বাগ্রে সাম্যবাদী আদর্শের বাহক।

সমাজতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি ও সামাজিক গ্রুপের মধ্যে সম্পর্ক হলও সামাজিক- রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শীয় ঐক্যের সম্পর্ক। এই ঐক্য সমাজতন্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রাধান্য, কেননা সাম্যবাদ গঠনে সমস্ত জনগণের প্রয়াস ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হয় তাতে। এই দিক থেকে বিকশিত সমাজতন্ত্রের একটা চালিকাশক্তি হলো সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্য।

আরো পড়ুন:  নোনা শ্রমিক

তার মানে কিন্তু এই নয় যে সমাজতান্ত্রিক সমাজে বিরোধ নেই। নতুনের নির্মাণ প্রক্রিয়ায় সর্বদাই দেখা দেয় কিছু বিষয় অভাবিত এবং কিছু বিষয় অচলীভূত। এক ধরনের বিরোধ লোপ পেলেও সমাজের বিকাশ থেকে নতুন বিরোধ জাগতে পারে। এ বিরোধের চরিত্র বৈরী নয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজের বিকাশ ও সংহতি যত বাড়বে, যত বাড়বে সামাজিক সম্পদ, ততই গড়ে উঠবে বিরোধ নিরসনের অনুকূল পরিস্থিতি।*

সহায়ক গ্রন্থ:

১. আ. ন. ইয়াকভলেভ ও অন্যান্য, রাজনীতির মূলকথা, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৫, পৃষ্ঠা ৭৬-৭৮।

২. আ. ইয়ের্মাকোভা, ভ. রাত্নিকভ, শ্রেণী ও শ্রেণীসংগ্রাম, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৮৫- ৮৮।

* প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] লিখিত ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ৪৫-৪৭ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরেতে প্রকাশিত হলো।

রচনাকালঃ অক্টোবর ৩০, ২০১৪

আরো পড়ুন অনুপ সাদির প্রবন্ধ:  

১. সমাজতন্ত্র প্রলেতারিয়েতের মুক্তির মতবাদ

২.  কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র

৩.  সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির স্বরূপ বিশ্লেষণ

৪.  সাংস্কৃতিক বিপ্লব

Leave a Comment

error: Content is protected !!