আনাক্সাগোরাস সক্রেটিসের পূববর্তী যুগের অন্যতম গ্রিক দার্শনিক

আনাক্সাগোরাস বা এনাক্সাগরাস বা এ্যানাক্সগোরাস (ইংরেজি: Anaxagoras, ৫০০-৪২৮ খ্রি.পূ.) সক্রেটিসের পূববর্তী যুগের অন্যতম গ্রিক দার্শনিক। এই যুগের অপর গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে থেলিস, এনাক্সিমেনিস এবং এনাক্সিমেণ্ডারের নাম বিখ্যাত। আদি গ্রিক দার্শনিকদের বৈশিষ্ট্য ছিল জীবন এবং জগতের ব্যাখ্যায় বাস্তবতাবোধ। এনাক্সাগোরাসের দর্শনেও এই বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে পরিপূর্ণ বস্তুবাদের বদলে তাঁর দর্শনে ভাববাদেরও প্রকাশ দেখা যায়।

এনাক্সাগোরাসের মতে বস্তুপুঞ্জ সংখ্যাহীন মূল বস্তুনিচয়ের দ্বারা গঠিত। বস্তু বা অস্তিত্বের অন্তর্ভূক্ত বস্তুনিচয়ের মধ্যে সাদৃশ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। একটির সঙ্গে অপরটির কোনো মিল নেই। আদিতে সত্তা স্থির ছিল। সেই স্থির অস্তিত্বে ‘নাউসের’ অনুপ্রবেশে অস্থিরতা এবং আবর্তের সঞ্চার হয়। এই আবর্তের ফলেই বিশ্ব চরাচরে অসংখ্য অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছ। এনাক্সাগোরাস যাকে ‘নাউস’ বলেছেন, তাকে মন বলা চলে। সক্রেটিসের পূর্বে সৃষ্টির মূলে মনের মৌলিক ভূমিকার কথা এনাক্সাগোরাসের ন্যায় অপর কেউ বলেন নি। নাউসের কারণেই এক বস্তু অপর বস্তু থেকে পৃথক হয়েছে। এবং বস্তুর প্রকারভেদ ঘটেছে। মন সমগ্র সত্তার সৃষ্টির কারণ হলেও মন কোনো অস্তিত্বের সঙ্গেই অভেদ আকারে সম্পৃক্ত নয়।

এনাক্সাগোরাসের মতে আদি সত্তার মধ্যেও সংখ্যাহীন অস্তিত্ব রয়েছে। তার কারণ, কোনো অস্তিত্বই অনস্তিত্ব থেকে উদ্বূত হতে পারে না। সে জন্য প্রত্যেকটি উদ্ভূত অস্তিত্বই অপর অস্তিত্বই অপর অস্তিত্বের মধ্যে নিহিত। মাথার চুল নিশ্চয়ই যা চুল নয় তা থেকে উদ্ভূত হতে পারে না। সে অবস্থা থেকে চুলের উদ্ভব তার মধ্যে চুলের বৈশিষ্ট্য অবশ্যই নিহিত আছে।

এনাক্সাগোরাস মনে করতেন, পৃথিবী আকারে চেপ্টা এবং বায়ুর সমুদ্রে ভাসমান। চাঁদ আলো দেয় বটে-কিন্তু সে আলো সূর্য থেকে সে পায়। সূর্য, চন্দ্র, তারা এ সবগুলি উত্তপ্ত পাথর। কোনোটার আকার বড়, কোনোটার আকার ছোট। আমাদের চেতনার মূলে রয়েছে পরস্পরবিরোধী অবস্থার সম্পর্ক। কারণ একটি সদৃস অবস্থা আর একটি সদৃশ অবস্থাকে আলোড়িত করে তুলতে পারে না। আমরা যখন ঠাণ্ডা বোধ করি, তখন আমাদের শরীরের ভিতরের অবস্থা উঞ্চ এবং বাইরের অবস্থা ঠাণ্ডা বলেই আমরা শরীরের ভিতরে ঠাণ্ডা বোধ করি।

আরো পড়ুন:  এপিকিউরাস প্রাচীন গ্রিসের বস্তুবাদী দার্শনিক

এনাক্সাগোরাসের দর্শনের উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে বুঝা যায়, তিনি প্রধাণত বস্তুবাদী ছিলেন। প্রাকৃতিক জগতের ব্যাখ্যায় অতিপ্রাকৃতিক কোনো শক্তিরই তিনি উল্লেখ করেন নি। সৃষ্টির মূল শক্তি মনকেও এনাক্সাগোরাস সূক্ষ্ম এবং বিশুদ্ধ বলে কল্পনা করেছেন। ঐশ্বরিক অস্তিত্ব অস্বীকারের জন্য এনাক্সাগোরাসকে নাস্তিক বলে মনে করা হতো। তিনি দেবতাদের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না-এই অভিযোগ এথেন্সের তৎকালীন সরকার এনাক্সাগোরাসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। জীবন রক্ষার্থে এনাক্সাগোরাসকে এথেন্স থেকে পালায়ন করতে হয়।

‘প্রাকৃতিক জগৎ’ সম্পর্কে এনাক্সাগোরাস যে পুস্তক রচনা করেন তার কিছু অংশ অবলুপ্তির হাত থেকে রেহাই পেয়ে পরবর্তী যুগের জ্ঞানান্বেষণে আলোকবর্তিকার কাজ করেছে। এনাক্সাগোরাস আইওনিয়া দ্বীপের ক্লাজোমিনীর অধিবাসী বলে পরিচিত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬৪ সালে তিনি আইওনিয়া পরিত্যাগ করে এথেন্স আগমন করেন এবং দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর এথেন্সে জীবন-জগৎ-অঙ্কশাস্ত্র-জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি সম্পর্কে তাঁর অভিমতের ব্যাখ্যা করেন। পেরিক্লিস এবং ইউরিপাইডিস তাঁর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। অনেকে মনে করেন যে, দর্শন-গুরু সক্রেটিসও এক সময়ে এনাক্সাগোরাসের শিষ্য ছিলেন।

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৫৫-৫৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!