কার্য-কারণবাদ কাকে বলে?

কার্য-কারণবাদ (ইংরেজি: Causality) দর্শন শাস্ত্রের একটি শব্দ। দুটি বস্তু বা ঘটনার মধ্যকার অনিবার্য সম্পর্ককে কার্যকারণ সম্পর্ক বলে অভিহিত করা হয়। দুটি ঘটনার যেটি পূর্বে সংঘটিত হয় তাকে কারণ এবং যেটি তার ফল হিসাবে পরে সংঘটিত হয় তাকে কার্য বলে। কার্য-কারণ সম্পর্ক দুটি ঘটনা বা বস্তুর সম্পর্ক হলেও কার্য ও কারণ হিসাবে দুটি ঘটনা বিশ্বের অপরাপর ঘটনা থেকে বিযুক্তভাবে সংঘটিত হয় না। উপলব্ধির সুবিধার জন্য আমরা দুটি ঘটনাকে অপরাপর ঘটনা থেকে বিযুক্তভাবে ভাবার চেষ্টা করি। কিন্তু আসলে যে ঘটনাকে কার্য বলে অভিহিত করা হচ্ছে সে একই সময়ে অপর ঘটনার কারণ এবং যাকে কারণ বলে অভিহিত করা হচ্ছে সে অপর ঘটনার কার্য বা ফল হিসাবে সংঘটিত হচ্ছে।

বস্তুর সমগ্র বিশ্বচরাচর কার্য কারণের সামগ্রিকসূত্রে আবদ্ধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণ হিসাবে হিটলারের কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু সে হিটলার জার্মানীর তৎকালীন অর্থনৈতিক-সামাজিক রাষ্ট্রীয় অবস্থারই কার্য বা ফল। আবার বিংশ শতকের পুঁজিবাদী দুনিয়ার অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণেই জার্মানীর সেই সামাজিক অর্থনৈতিক রাষ্ট্রীয় অবস্থার সৃষ্টি। তাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণ কেবল হিটলার নয়। একটি কার্যের সামগ্রিক কারণ তাই একটি নির্দিষ্ট কারণের চেয়ে বৃহত্তর। কোনো ঘটনার নির্দিষ্ট কারণ তার সামগ্রিক কারণের ভিত্তিতেই উপলব্ধি করা সম্ভব। কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে সামগ্রিক কারণ উপলব্ধি করে আমরা জীবন যাপন করি নে। একটি ঘটনার নির্দিষ্ট কারণকেই আমরা স্থির করার চেষ্টা করি।

ঘটনামাত্রেরই কারণ আছে কিংবা কারণমাত্রেরই ফলাফল আছে। কথাটা স্বতঃসিদ্ধ হলেও দর্শনে কার্যকারণের কথা একটি মৌলিক বিষয়। প্রাচীন ভারতের বৈশেষিক দর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক ইউরোপের অজ্ঞেয়বাদী হিউমের দর্শনেও কার্যকারণের সমস্যা বিশেষ আলোচনার বিষয় বলে বিবেচিত হয়েছে।

অন্যান্য সমস্যার ন্যায় কার্যকারণের সমস্যার আলোচনারও দুটি ধারণা দেখা যায়। একটি হচ্ছে ভাববাদী ধারা; অপরটি বস্তুবাদী। ভাববাদী মতে ঘটনায়-ঘটনায় কিংবা বস্তুতে-বস্তুতে কার্যকারণের সম্পর্ক আমাদের মনের কল্পনার বিষয়। কার্য-কারণবাদ সম্পর্ক কোনো বস্তু বা ঘটনা নয়। সুতরাং কার্যকারণ সম্পর্ক দৃশ্য নয়। আমরা বস্তুকে দেখি, কিন্তু বস্তুতে বস্তুতে সম্পর্ককে দেখি নে। আমরা আগুণ দেখতে পারি। আমরা ধোঁয়া দেখতে পারি, কিন্তু আগুন ও ধোঁয়ার মধ্যে কার্যকারণ রয়েছে বা আগুন ধোঁয়ার কারণ এবং ধোঁয়া আগুনের কার্য  বা ফল এটা আমরা দেখতে পারি নে। হিউম এই যুক্তিতে কার্যকারণ সম্পর্কের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে চেয়েছেন।

আরো পড়ুন:  বংশগতি কাকে বলে?

দার্শনিক ইমানুয়েল কাণ্ট একদিকে কার্য-কারণ সম্পর্কের বাস্তবতাকে অস্বীকার করেছেন, আবার অপরদিকে তাকে আমাদের জ্ঞানের অন্যতম অপরিহার্য সূত্র  বা মাধ্যম বলে  আখ্যাত করেছেন। তাঁর মতে অন্যান্য মূলসূত্রের ন্যায় কার্য-কারণ সম্পর্কের ধারণা আমাদের একটি অভিজ্ঞতা-পূর্ব জন্মগত ধারণা।

বস্তুবাদী দর্শন, বিশেষ আধুনিককালের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন, কার্য-কারণবাদ সম্পর্কের ভাববাদী ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করে। এই মত অনুযায়ী মানুষের জ্ঞানলাভের পদ্ধতি হচ্ছে মানুষের সাথে বস্তুর সাক্ষাৎ সম্পর্কের অভিজ্ঞতার নিয়ত বিকাশমান প্রক্রিয়া। বাস্তব ঘটনাকে মানুষ আদিকাল থেকে প্রত্যক্ষ করেছে। মানুষ হিসাবে এই  অভিজ্ঞতার পথেই ঘটনার সম্পর্কের কার্যকারণরূপ সে উপলব্ধি করেছে এবং আবিস্কার করেছে। কার্যকারণ যে, বস্তু জগতের প্রতিটি অণুর সঙ্গে অপর অণুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-ঘটনা মানুষের কল্পনার  বিষয় নয়। আর এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে বস্তুর কার্যকারণ সম্পর্ক। একটি আলপিন আমার আঙুলে বিদ্ধ হয়েছে। এটি প্রত্যক্ষ ঘটনা। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়াতে আঙুল থেকে রক্ত নির্গত হচ্ছে এবং আমি ব্যথা বোধ করছি। বিশ্বচরাচরের বস্তুজগতে বস্তুতে বস্তুতে কোনো ফাঁক বা শূন্যতা নেই। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সতত সম্পর্কে বস্তু-জগৎ আবদ্ধ এবং ক্রিয়াশীল।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ১০৫-১০৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!