কর্মীদের উপর সব নির্ভর করে

‘শিল্পবিজ্ঞানই সবকিছু নির্ণয় করে’— এই পুরনো স্লোগান যে যুগের অবস্থার প্রতিফলন সে যুগে আমরা শিল্পযন্ত্রের অভাবে ভুগেছি, সে যুগ আজ অতীত। এই পুরনো স্লোগানের বদলে নতুন স্লোগান আজ আমাদের গ্রহণ করতে হবে, সেই নতুন স্লোগান হচ্ছে— ‘কর্মীদের গুণবত্তাই সবকিছু নির্ণয় করে’। এটিই এখন প্রধান ব্যাপার।

আমাদের দেশবাসী এই নতুন স্লোগানের বিরাট তাৎপর্য পুরোপুরি আয়ত্ত ও উপলব্ধি করতে পেরেছে, একথা বলা যায় কি? আমি কিন্তু তা বলি না। যদি তাই হতো, তাহলে জনগণের প্রতি, কর্মীদের প্রতি, শ্রমিকদের প্রতি যে ধরনের অসম্মানকর মনোভাব কার্যত হামেশাই প্রকাশ পেতে দেখা যায় তা  কখনোই সম্ভব হতও না। ‘কর্মীদের গুণবত্তাই সবকিছু নির্ণয় করে’— এই স্লোগানকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে আমাদের কর্মীদের প্রতি নেতাদের ব্যবহার বদলাতে হবে; কর্মীদের প্রতি তাদের ব্যবহার হওয়া উচিত একান্ত আন্তরিক, ‘ছোট’ কিংবা ‘বড়’ যে ধরনের কর্মীই হোক না কেন, যেকোনো ধরনের কাজেই তারা নিযুক্ত থাকুক না কেন, ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে তাদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে, প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে, প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের সাহায্য করতে হবে; প্রথম সাফল্যের পরিচয় দিবার সংগে সংগেই তাদের উৎসাহিত করে উচ্চপদে উন্নীত করতে হবে, ইত্যাদি। কিন্তু কার্যত কর্মীদের প্রতি-যে ব্যবহার করা হয় তা অনেক ক্ষেত্রেই প্রাণহীন, আমলাতন্ত্রসুলভ ও অসম্মানকর। এ হতে আমরা বুঝতে পারি, কেন কর্মীদের গুনাগুণ বিচারের পর তাদের ঠিক ঠিক পদে নিয়োগ না করে দাবার বোড়ের মতো যথেচ্ছভাবে তাদের ব্যবহার করা হয়। জনসাধারণ যন্ত্রপাতির কদর পুরোপুরিই বুঝতে শিখেছে এবং আমাদের মিল ও কারখানায় কত কলকব্জা আছে সে সম্পর্কে রিপোর্ট দিতেও তারা শিখেছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কত লোককে শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বা কত লোককে তাদের কাজের উপযোগী হতে হাতে কলমে শিক্ষার ব্যাপারে সাহায্য করা হয়েছে— সে সম্বন্ধে অনুরূপ আগ্রহের সাথে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন ঘটনার কথা আমি জানি না। এর কারণ কি? এর কারণ এই যে, আজও আমরা জনগণের, শ্রমিকদের ও কর্মীদের কদর করতে শিখিনি।

আরো পড়ুন:  জনগণ হচ্ছে নির্দিষ্ট কোনো ভূখণ্ডের অধিবাসী যাদের ভাষা ও সাহিত্য একই

সাইবেরিয়াতে এক সময় আমি নির্বাসনে ছিলাম। সেখানে একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। সময়টা ছিল বসন্তকাল। বরফ গলে নদীতে বান আসার সময় নদী স্ফীত হয়ে বিরাট আকার ধারণ করেছে, আর তারই স্রোতের টানে বড় বড় গাছ ভেসে যাচ্ছে। এই গাছ তোলার জন্য ৩০ জন লোক নদীতে যায়। সন্ধ্যার দিকে তারা গ্রামে ফিরে আসে, কিন্তু তাদের একজন সঙ্গীর খোঁজ মেলে না। যখন তাদের জিগ্যেস করা হয় ঐ লোকটির কী হয়েছে, তারা নির্লিপ্তভাবে জবাব দেয়ঃ ‘সে সেখানেই রয়ে গেছে।’ আমি প্রশ্ন করিঃ ‘সেখানেই রয়ে গেছে মানে?’ আগের মতই নির্লিপ্তভাবে তারা জবাব দিলঃ ‘এতে আবার প্রশ্ন করার কি আছে? সে ডুবে মরেছে?’ এর পরই একজন খুব ব্যস্তভাবে চলে যেতে যেতে বলেঃ ‘আমাকে এখনই যেতে হচ্ছে, ঘোড়াকে দানা পানি দিতে হবে।’ মানুষের চেয়ে জানোয়ারের প্রতি বেশি দরদ দেখাবার জন্য তাদের তিরস্কার করলে তাদের একজন জবাব দেয়ঃ ‘মানুষ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে যাব কেন? মানুষ তো আমরা পয়দাই করতে পারি। কিন্তু ঘোড়া… … একবার চেষ্টা করেই দেখুন না, একটা জন্মাতে পারেন কি না।’ অন্যান্য সকলে তাহার এই কথায় সায় দেয়।

এখানে যে ঘটনাটি উল্লেখ করলাম, তার তাৎপর্য হয়তো বেশি নয়, কিন্তু বৈশিষ্ট্য খুবই। আমার মনে হয়, জনগণের সম্পর্কে, কর্মীদের সম্পর্কে, আমাদের কোনো কোনো নেতার ওদাসিন্য, মানুষের কদর করতে তাদের অক্ষমতা, সুদূর সাইবেরিয়ার এই কাহিনী মানুষের প্রতি মানুষের অদ্ভুত মনোভাবের শামিল।

কাজেই আজ আমরা লোকের যে অভাববোধ করছি তা যদি কাটিয়ে উঠতে চাই, শিল্পযন্ত্রের উন্নতি সাধনে এবং পরিচালনায় সক্ষম যদি আমরা অধিক সংখ্যক পেতে চাই, তবে সর্বপ্রথম আমাদের শিখতে হবে মানুষের যথার্থ মূল্য দিতে, আমাদের সাধারণ লক্ষ্যের হিত সাধনে সক্ষম কর্মীদের কদর বুঝতে আজ আমাদের শিখতে হবে। আজ এটা উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা মূল্যবান ও চূড়ান্ত মূল্যবান হচ্ছে মানুষ, কর্মী। এটা উপলব্ধি করতেই হবে যে, আমাদের বর্তমান অবস্থাতে ‘কর্মীদের গুণবত্তাই সবকিছু নির্ণয় করে’। শিল্পে, কৃষিকর্মে, যানবাহনব্যবস্থায় ও সৈন্যবাহিনীতে আমরা যদি অনেক ভাল কর্মী পাই, তবে আমাদের দেশ হবে অপরাজেয়। সেরূপ কর্মী না থাকলে আমাদের দুপা থাকবে খোঁড়া হয়ে।

আরো পড়ুন:  জনতা এমন জনসমষ্টি যারা চিন্তাহীনভাবে, উত্তেজনার বশে উচ্ছৃঙ্খল ও হিংসাত্মক আচরণকারী

বিদ্যালয়ের বাহিরের ব্যবহারিক কাজকর্মের মধ্যে বাধাবিঘ্নের সাথে লড়াই করে ও বাধাবিঘ্ন জয় করেই কর্মীরা প্রকৃত কর্মী হিসেবে শিক্ষিত হয়ে ওঠে। যে সব কর্মী বাধাবিপত্তিতে ডরায় না, বাধার ভয়ে পালিয়ে থাকে না, বাধা পরাহত করে নিশ্চিহ্ন করতে যারা এগিয়ে গিয়ে লড়াই করে একমাত্র তারাই হচ্ছে যথার্থ কাজের লোক। বাধার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভেতর দিয়েই কেবল খাঁটি কর্মী গড়ে ওঠে। আমাদের সৈন্যবাহিনীতে যদি এই ধরনের খাঁটি কর্মী যথেষ্ট সংখ্যায় থাকে, তবেই আমরা হব অপরাজেয়।

বি. দ্র. এই নিবন্ধটি কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন– ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা. লি. ৩০-৩৩ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে। এখানে কর্মী কথাটি কর্মী ক্যাডার অর্থে ব্যবহৃত।

Leave a Comment

error: Content is protected !!