লেনিন স্মরণে প্রবিষ্ট ছাত্রদের প্রতি উৎসর্গিত
বিষয়বস্তু হিসেবে লেনিনবাদের ভিত্তি খুবই ব্যাপক। এ সম্বন্ধে পুরোপুরি আলোচনা করতে গেলে সম্পূর্ণ একটা বই লেগে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি, অনেকগুলি বইই দরকার হবে। সুতরাং স্বভাবতই, আমার বক্তৃতার মধ্যে লেনিনবাদের সম্পূর্ণ আলোচনা থাকবে এমন আশা করা যায় না। বড়ো জোর, এতে লেনিনবাদের ভিত্তি সম্বন্ধে একটা মোটামুটি চুম্বক অংশ দেওয়া চলতে পারে। লেনিনবাদ সম্বন্ধে সাফল্যের সঙ্গে আলোচনা করতে গেলে যে মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দরকার তা লিপিবদ্ধ করার জন্য_ এই সংক্ষিপ্ত চুম্বক অংশ দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
লেনিনবাদের ভিত্তি ব্যাখ্যা করার অর্থ কিন্তু এ নয় যে, আমরা লেনিনের বিশ্বদর্শনের ভিত্তি ব্যাখ্যা করব। লেনিনের বিশ্বদর্শনের ব্যাখ্যা করা আর লেনিনবাদের ভিত্তি ব্যাখ্যা করা এক কথা নয়। লেনিন ছিলেন মার্কসবাদী সুতরাং মার্কসবাদই ছিলো তাঁর বিশ্বদর্শনের ভিত্তি। কিন্তু তা থেকে মোটেই মনে করা চলে না যে, লেনিনবাদের অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কসবাদের ভিত্তি কী তার ব্যাখ্যা দিয়ে শুরু করতে হবে। লেনিনের মতবাদ ব্যাখ্যা করার অর্থ এই যে, লেনিনের গ্রন্থাবলীতে যা কিছু নতুনত্ব আর বৈশিষ্ট্য আছে, মার্কসবাদের সাধারণ কোষাগারে লেনিন যা দান করেছেন, যা স্বভাবতই শুধু তাঁরই নামের সঙ্গে জড়িত_ তারই ব্যাখ্যা করা। আমার বক্তৃতাতে একমাত্র এই অর্থেই আমি লেনিনবাদের ভিত্তি কথাটা ব্যবহার করব!
এখন দেখা যাক লেনিনবাদ আসলে কী?
কেউ কেউ বলেন, লেনিনবাদ হচ্ছে রুশ দেশের বিশেষ অবস্থায় মার্কসবাদের প্রয়োগ। এই সংজ্ঞার মধ্যে কিছুটা সত্য আছে বটে কিন্তু সত্যের সবটুকু আছে একথা কিছুতেই বলা চলে না। লেনিন অবশ্য রুশদেশের বিশেষ অবস্থায় যথেষ্ট নৈপুণ্যের সঙ্গেই মার্কসবাদকে প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু লেনিনবাদ বলতে যদি কেবল রুশদেশের বিশেষ অবস্থায় মার্কসবাদ প্রয়োগ করাই বোঝাত, তবে এটা নিছক জাতীয় ব্যাপার হতো_ শুধু মাত্র জাতীয় ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ থাকত; এটা হতো নিছক রুশদেশের ব্যাপার, শুধুমাত্র রুশদেশের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু আমরা জানি লেনিনবাদ শুধু রুশ দেশের ঘরোয়া ব্যাপার নয়_ এ হলো আন্তর্জাতিক ব্যাপার, এর মূল রয়েছে সমগ্র আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যে। সেই জন্যই আমার মতে, এই সংজ্ঞাটি হয়েছে নিতান্ত একপেশে।
আর একদল বলেন, উনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকে মার্কসবাদে যে বৈপ্লবিক ভাবধারা ছিলো তার পুনরুজ্জীবনই হলো লেনিনবাদ। পরবর্তী আমলে এই মার্কসবাদই নাকি নরমপন্থী, বিপ্লব-বিরোধী আকার ধারণ করেছিল। মার্কসের চিন্তাকে নরমপন্থী আর বিপ্লবী_ এই দুভাগে ভাগ করার এই স্থূল, নির্বোধ চেষ্টার কথা আমরা যদি ছেড়ে দেই, তবে এই অসম্পূর্ণ, অসন্তোষজনক সংজ্ঞার মধ্যেও সামান্য কিছু সত্য আছে বলে আমাদের স্বীকার করতে হবে। সত্যটা হলো এই যে, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদীরা মার্কসবাদের যে বিপ্লবী ভাবধারাকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল, লেনিন সত্যই তাঁকে আবার পুনরুজ্জীবিত করেছেন। তবু সত্যের এটা সামান্য অংশ মাত্র। লেনিনবাদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সত্যটুকু হলও এই যে, লেনিনবাদ শুধু মার্কসবাদকে পুনরুজ্জীবিত করেছে তাই নয়, আরও অগ্রসর হয়ে গেছে_ পুঁজিবাদ এবং শ্রমিকদের শ্রেণিসংগ্রামের নতুন অবস্থায় মার্কসবাদকে আরও পরিবর্ধিত করেছে।
শেষ পর্যন্ত তাহলে লেনিনবাদ বলতে কি বোঝাল?
লেনিনবাদ হলো সাম্রাজ্যবাদ এবং শ্রমিক-বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ। আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, লেনিনবাদ হলো সাধারণভাবে শ্রমিক-বিপ্লবের মতবাদ ও রণকৌশল এবং বিশেষভাবে এ হলো শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের মতবাদ ও রণকৌশল। বিকশিত সাম্রাজ্যবাদের যখন জন্ম হয়নি, সর্বহারারা যখন বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, শ্রমিক-বিপ্লব যখন আশু এবং অবশ্যম্ভাবি হয়ে উঠেনি সেই প্রাক-বিপ্লব যুগে (আমরা এখানে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের কথাই বলছি) মার্কস আর এঙ্গেলস তাঁদের কার্যকলাপ চালাতেন। আর মার্কস আর এঙ্গেলসের শিষ্য লেনিন তাঁর কাজ চালিয়েছেন বিকশিত সাম্রাজ্যবাদের যুগে, শ্রমিক-বিপ্লবের বিকাশের যুগে_ যখন শ্রমিক-বিপ্লব একটি দেশে ইতিমধ্যেই জয়যুক্ত হয়েছে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে চূর্ণ করে, শ্রমিক শ্রেণির গণতন্ত্রের সোভিয়েত তন্ত্রের যুগের সূত্রপাত করেছে।
এই কারণেই লেনিনবাদ হলো মার্কসবাদের আরো বিকশিত রূপ।
লেনিনবাদের অসাধারণ সংগ্রামশীল, অসাধারণ বৈপ্লবিক চরিত্রের উপর সাধারণত জোর দেয়া হয়ে থাকে। এটা খুবই ঠিক। কিন্তু লেনিনবাদের এই বৈশিষ্ট্যের মূলে রয়েছে দুটি কারণ। প্রথমত, লেনিনবাদ শ্রমিক-বিপ্লবের মধ্য থেকেই উদ্ভূত সুতরাং তার ছাপ এর উপর না পড়ে পারে না; দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই এ বৃদ্ধি পেয়েছে, শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে সংগ্রাম চালাতে হলে এই সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো সেদিনকার মতো আজও অতি অবশ্য প্রয়োজন। একথা ভুললে চলবে না যে, একদিকে মার্কস-এঙ্গেলস আর অন্যদিকে লেনিন_ এঁদের মধ্যে রয়েছে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদের একাধিপত্যের সম্পূর্ণ এক যুগ এবং এই সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম লেনিনবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিলো না।
বি দ্রঃ জে ভি স্তালিন রচিত লেনিনবাদের ভিত্তি ও সমস্যা গ্রন্থের এই ভূমিকাটি স্তালিন কর্তৃক ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকে সেভর্দলভ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতাবলী থেকে গৃহীত এবং নবগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক অনুদিত ও ন্যশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রকাশিত। এখানে সেপ্টেম্বর ২০০৮-এর চতুর্থ মুদ্রণ থেকে নেয়া হলেও দুএকটি শব্দ ও বানান পরিবর্তন করা হয়েছে।
জোসেফ ভিসারিওনোভিচ স্তালিন বা যোসেফ স্তালিন বা জোসেফ স্ট্যালিন (১৮ ডিসেম্বর, ১৮৭৯- ৫ মার্চ ১৯৫৩) সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মানে এবং একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দীর্ঘতম সাফল্যের ইতিহাস রচনা করে গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ তথা বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম যোসেফ ভিসারিওনোভিচ সোসো, স্তালিন নামটি তিনি ১৯১০ সালে ‘লৌহমানব’ অর্থে ধারণ করেন। তাঁকে মানবেতিহাসের মহত্তম নেতা ও জনগণের শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করা হয়।