ছাদ বাগান তৈরি এবং ফুল ও সবজি চাষের বিস্তারিত পদ্ধতি

আধুনিক নগর সভ্যতার যুগে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে শহর। এই প্রসারণের ফলে এবং শিল্পনগরীর বৃদ্ধি হওয়ার ফলে বিত্তশালীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সেই ধনী ব্যক্তিরা বাড়িতে ফাঁকা জায়গায় বা ছাদ বাগান তৈরি করার কথা ভাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ ফুলের বাগানের কথা চিন্তা করতেই পারে না। কারন তারা নিজেদের বাসস্থান তৈরি করতে যে জমি ক্রয় করতে পারে তা খুব সামান্য। সেখানে অতিরিক্ত বাগান করার জন্য ফাঁকা জায়গা থাকে না।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বড় বড় শহরে পরিকল্পনা ছাড়া বহুতল ভবন নির্মান হচ্ছে। শহরতলীতেও ঘরবাড়ির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, সামান্য ফাঁকা জমি রাখা সাধারণ মধ্যবিত্ত লোকের অসাধ্য ব্যাপার হয়ে পড়েছে। শহরে এখন জমি শুধু দুর্মূল্যই নয়, দুষ্প্রাপ্যও বটে। ব্যস্ত নাগরিক জীবনে সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি ঘুচাতে একটা ফুল বা বাহারী গাছের মধ্যে নান্দনিক নৈসর্গিক শোভা খুঁজতে মানুষ তাই বাড়ীর ছাদকে কাজে লাগিয়ে সেখানে সুন্দর বাগান করার প্রয়াস চালাচ্ছে।

এই চলমান প্রাত্যহিক যান্ত্রিক জীবনে কেবলমাত্র বাড়ির ছাদে, বেল্কোনিতে ফুল চাষ বা সবজি বাগান করে মানুষ কিছুটা আনন্দ পেতে পারে। শহরের বাড়ীতে একমাত্র ফাঁকা স্থান বলতে ছাদ; তাই সেটা ব্যবহার করে সুন্দর ছোট্ট একটা ফুলবাগান বা টাটকা সবজি জন্য বাগান তৈরি করা যায়। তাছাড়া দিন দিন আমরা যেভাবে গাছপালার সবুজ মনোরম পরিবেশ হারাচ্ছি ও পরিবেশ দূষণ করছি তা থেকে কিছুটা রক্ষা পেতে নিজের বাড়ির ছাদকে কিছু সবুজ রাখা ভালো। ঘরোয়া বিভিন্ন অনুষ্টানে ফুল সহজে পাওয়ার জন্য অনেকেই বাড়ির ছাদে বাগান করার দিকে ঝুকে পড়ে।

আবার যথেষ্ট কীটনাশক ব্যবহারের ফলে বাজারের তথাকথিত টাটকা সবজী খাওয়া প্রায় হুমকির সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাষীরাও এখন যথেষ্ট কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার করে বাজারে ফুল ও সবজি বিক্রি করছে। কারণ অধিকাংশ চাষীরাই এইসব বিষাক্তক কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার করার পরই ফুল, ফল ও সবজিতে বাজারে নিয়ে আসছে। কিন্তু ঔষধ ব্যবহারের পর নিয়ম মতো ১০-১৫ দিনের মধ্যে কোনো ফসলই গাছ থেকে তুলে খাওয়া উচিত নয়।

আরো পড়ুন:  জলাশয়ে বাগান করার জন্য সহজ ও সঠিক পদ্ধতি

এইসব কথা আমরা অনেকেই ভাবি, তাই নিজেদের মতো করে আজ অনেকেই বাড়ীর ছাদের স্বল্প পরিসরে নিজেদের ফুল, ফল তথা সবজী বাগান করার ইচ্ছা পোষন করছে। যদিও ছাদে বাগান করার ব্যাপারে অনেকের অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ছাদে বাগান করলে ছাদ তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখা দরকার, আমাদের পাকা বাড়ীর ছাদের ঢালাই সাধারণতঃ ৪ ইঞ্চি কংক্রীটের হয় এবং এর ক্ষমতা প্রতি বর্গফুটে প্রায় ১২০ পাউণ্ড। সুতরাং ছাদে বাগান করলে, টবের গাছের ভারে ছাদ কিছুতেই নষ্ট হতে পারে না বা অচীরে ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই নিভয়ে ছাদে যে কোনো বাগান ( সবজি বা ফুল, ফল ) করা যাবে। জলছাদ থাকলে এবং বৃষ্টির পানি ছাদে না জমতে দিলে টবের মধ্যে ফুল, সবজি গাছ লাগিয়ে অতি সহজেই বাগান করা যাবে। গ্রীষ্মকালে ছাদের বাগান বাড়ীকে ঠাণ্ডা রাখবে। আজকাল ছাদে শুধু, ফুলই নয়, কলা, পেয়ারা, নারিকেল, নানাধরণের সবজি, ডালিম, লেবু, প্রভৃতি গাছও লাগান হচ্ছে। বহুতল বাড়ীর ছাদে লন তৈরী করেও নান্দনিক শোভা বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে।

খুব সহজেই ছাদে টবের সাহায্যে বছরভর মৌসুমী ফলের চাষ করা যায়। কিছু ভাল জাতের গোলাপ, বাহারী চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, গ্ল্যাডিওলাস, প্রভৃতি বনেদী ফুল ; গ্রীষ্মের জিনিয়া, গেলাডিয়া, নয়নতারা, সামার সাইপ্রেস বা কোচিয়া ট্রাইফোলিয়া, পিটুনিয়া (বেড়িং), কোরিওপসিস, কসমস, স্যালভিয়া, টিথোনিয়া ; বর্ষায় দোপাটি বা বালসাম, গ্লোব এ্যামারান্থ বা ব্যাচেলার্স বাটন, মোরগ ঝুঁটি (cocks comb), এ্যামারাথ, জিনিয়া, গাঁদা, স্যালভিয়া, সূর্যমুখী প্রভৃতি রংবাহারী ফুলের চাষ করা যায়।

প্রচলিত একটি ধারণা আছে, শীতকালই হচ্ছে প্রকৃত অর্থে ফুল চাষ করার মৌসুম। কিন্তু এটা ভুল ধারনা। এ সময় প্রায় ৫০-৬০ রকমের ফুল চাষ করা চলে। এদের বিভিন্ন জাত এবং রঙ হিসেব করলে প্রায় ২০০-২৫০টির মতো ফুল একসঙ্গে বাগানে করা সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু বাড়ীর বড় ছাদে টবে অনেক ধরনের ফুল এক সঙ্গে চাষ করা সম্ভব। গ্রীষ্মকালে ও বর্ষায় অসংখ্য জাতের বাহারী ফুল একই ভাবে চাষ করা যাবে। ছাদের টবগুলিতে পাইপের সাহায্যে জল দেওয়া খুবই সহজ। এছাড়া বাগানে গাছ ফুলচুরি, গবাদি পশুর উৎপাত, শামুক-কেচো ও অন্যান্য রোগ-পোকার উৎপাত আছেই। ছাদের ফুলবাগানে এসব ঝামেলা নেই বললেই চলে। তাছাড়া বড় গাছের ছায়া বা শিকড়ের উৎপাতে ছাদের গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হবে না, প্রয়োজন মাফিক জল, সার, পরিচর্যা, পর্যাপ্ত খোলামেলা আলো-বাতাস, সূর্যালোক প্রভৃতি সব কিছুরই এখানে সুবিধা রয়েছে।

আরো পড়ুন:  বাগানের জন্য উদ্ভিদ নির্বাচনের পদ্ধতি

ছাদের ফুলবাগানের নক্সা এমন ভাবে করতে হবে, যাতে ছাদের অবস্থান এবং আকার অনুযায়ী বিভিন্ন সাইজের বাহারী মৌসুমী ফুল গাছ টবে লাগিয়ে সাজানো যায়। নতুন বাড়ী তৈরীর সময় তাই এদিকটার কথা ভেবে প্যারাপিটের উপর এবং পাশে গুল্মজাতীয় বাহারী ফুলের টব বসাবার জন্য আলাদাভাবে কংক্রিটের ঢালাই করে নেওয়া যাবে। বিভিন্ন মৌসুমী ফুল গাছ ছাড়া কিছু; বৈচিত্র্যময় বাহারী পাতাবাহারও টবে লাগাতে হবে। স্থপতিবিদদের পরামর্শে ছাদে পলিথিনের শীট বিছিয়ে তার উপর ৬-৭ ইঞ্চি মাটি বিছিয়ে লন তৈরীও করা যাবে। আজকাল ছোট ছোট ফ্রেমের মত জায়গায় দুর্বা ঘাস অন্যত্র তৈরী করে সুবিধামত ছাদে জোড়া লাগিয়ে নেওয়া যাবে। ছাদ বাগান বাড়ির পরিবেশকে মনোরম করে রাখে। বাড়িতে বহমান বাতাসকে নির্মল রাখে।

তথ্যসূত্রঃ

১. বলাইলাল জানা: ক্যাকটাস ও ফুলচাষ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তকপর্ষৎ, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ মার্চ ১৯৮৮, পৃষ্ঠা, ১৬৫-১৬৭।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া।

Leave a Comment

error: Content is protected !!