অনশন (ইংরেজি: Hunger-strike) শব্দটির অর্থ হচ্ছে কোনো খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ না করা। এটি সাধারণ অর্থে উপবাসে থাকা। বিভিন্ন ধর্মে কোনো কোনো উপলক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য উপবাস করার নিয়ম দেখা যায়। এরূপ অনশন দ্বারা মানুষ মনের শান্তি লাভ করতে চায় এবং ধর্মের অনুশাসন লাভ করে। কিন্তু আধুনিককালে এর একটি রাজনৈতিক অর্থ বহন করে। বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে অনশনকে সংগ্রামের একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
ভারত উপমহাদেশ যখন ইংরেজ শক্তির শাসনে ছিল তখন ইংরেজ সরকার বিভিন্ন সময় স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে এবং কারাগারে বন্দীদের উপর নানারূপ নির্যাতন করার নীতি অনুসরণ করেছে। কারাগারে আবদ্ধ এরূপ বন্দী নিতান্তই অসহায়। বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে তার দৈহিক সংগ্রাম করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এমন অবস্থাতেও যে বন্দী তার বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের উপায় বের করতে পারে, তার দৃষ্টান্ত ভারতের কারাগারে আবদ্ধ স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মীগণ বহুবার স্থাপন করেছেন।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কারাগারে নিজেদের জন্য রাজনৈতিক ও মানবিক মর্যাদা আদায়ের জন্য এবং সরকার কিংবা কারাগার কর্তৃপক্ষের অন্যায় আদেশ ও আচরণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক উপায় হিসেবে খাদ্যগ্রহণ অস্বীকার করার নীতি গ্রহণ করেন। ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘদিন যাবত অনশন বা এরূপে স্বেচ্ছায় খাদ্য গ্রহণ না করে বন্দিশালায় বহু বন্দি মৃত্যুও বরণ করেছেন। তাঁদের সেই মৃত্যু দেশের ব্যাপকতর জনসাধারণের মাঝে আবেগের সঞ্চার করেছে এবং দেশের মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনে অধিকতর উদ্বুদ্ধ করেছে।
কারাগারের মধ্যে আবদ্ধ থেকেও নিজেদের জীবনদান করে রাজবন্দিরা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অগ্রসর করে দিয়েছেন। এরূপ ঘটনা ও জীবন দানের কাহিনীর মধ্যে লাহোর দূর্গে বন্দী বাংলার বিপ্লবী নেতা যতীন দাসের ১৯২৯ সনে ৬৩ দিনের অনশন এবং এই অনশনে তাঁর মৃত্যু একটি স্মরণীয় ঘটনা। কারাগারে অনশনে যতীন দাসের মৃত্যু ঐ সময়ে সমগ্র ভারতবর্ষকে আন্দোলিত করে তুলেছিল। কবি রবীন্দ্রনাথ যতীন দাসের মৃত্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করেছিলেন এবং জনসাধারণের প্রতিবাদসভায় যোগদান করেছিলেন। আন্দামান দ্বীপে কারারুদ্ধ রাজনৈতিক বন্দিরাও একাধিকবার সে যুগে অনশন ধর্মঘট করেছিলেন এবং তাতে জানা-অজানা বহু বন্দি মৃত্যুবরণ করেন।
পাকিস্তান শাসনামলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে শত শত রাজবন্দি আমরণ অনশন ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে ১৯৪৯-১৯৫০ সনে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অবলম্বিত ৫৮ দিনের অনশন ধর্মঘট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই অনশনে কুষ্টিয়ার শ্রমিক নেতা শিবেন রায় নিহত হন।
কারাগারের বাইরেও রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা অনশন করার দৃষ্টান্ত আছে। এরূপ অনশনের দৃষ্টান্ত প্রথম স্থাপন করে ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল নেতা মোহনদাস গান্ধী। সে অনেকবার ঘোষণা করে অনশন করেছে। কেবল ইংরেজ শক্তির কোনো নীতি বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে নয়। নিজের ‘আত্মাকে শুদ্ধ’ করার উদ্দেশ্যে বা দেশবাসীর কোনো অবাঞ্চিত আচরণের প্রতিবাদেও অনির্দিষ্টকালের বা আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়ে সে অনশন করেছে। বাংলাদেশের জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও গান্ধীর অনুসরণে বিভিন্ন সময়ে অনশন করেছেন। ভারতের বাইরে, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজবন্দিদের অনশন সাম্প্রতিককালে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে। ১৯৮২ সনে এরূপ অনশনে একাধিক রাজবন্দি মৃত্যুবরণ করেছেন।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২০২-২০৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।