কাশ্মীর হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরতম ভৌগলিক অঞ্চল

কাশ্মীর (ইংরেজি: Kashmir) হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরতম ভৌগলিক অঞ্চল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত “কাশ্মীর” শব্দটি কেবল বৃহত্তর হিমালয় এবং পীর পাঞ্জাল পর্বতমালার মাঝের কাশ্মীর উপত্যকাকে বোঝাত। এখন, কাশ্মীর রাজনৈতিকভাবে একটি বৃহত্তর অঞ্চলকে বোঝায় যেখানে ভারত শাসিত জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ অঞ্চল, পাকিস্তান-শাসিত আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিত-বালতিস্তান অঞ্চল এবং চীনা-শাসিত আকসাই চিন এবং ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্টের অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

কাশ্মীর ছিলো একটা স্বাধীন দেশ। এখন কাশ্মীরকে তিন টুকরাে করে দখলে রেখেছে ভারত, পাকিস্তান ও চীন। ভারতীয়রা ভাবে, কাশ্মীরের একটা অংশ পাকিস্তান বে-আইনিভাবে দখলে রেখেছে। কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাকিস্তানীরা ভাবে, ভারত গায়ের জোরে ছিনিয়ে নিয়েছে কাশ্মীরের একটা অংশ, যা ওদের-ই। কাশ্মীরের ভূমিপুত্র-কন্যারা ভারতীয়দের বলে ইন্ডিয়ান; পাকিস্তানের লোকদের—পাকিস্তানি। নিজেদের পরিচয় দেয় কাশ্মীরি বলে। কাশ্মীরিরা ভারত ও পাকিস্তানকে দখলদার ছাড়া কিছু মনে করেনি।[১]

ভারত-কাশ্মীর সম্পর্কের ইতিহাস হচ্ছে ভারতের বিস্তারবাদী নীতির শক্তিশালীকরণ এবং ভারতীয় শাসকদের গণহত্যার ইতিহাস। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশরা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান নামে দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয় তখনও কাশ্মীর আলাদা দেশ রয়ে গেছে। ভারতের সর্বশেষ ব্রিটিশ গবর্নর লর্ড মাউন্টব্যাটেন ঘোষণা দিলেন স্বশাসিত করদরাজ্য ইচ্ছা করলে ভারত পাকিস্তানের সাথে যেতে পারবে অথব্য আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে থাকতে পারবে। হরি সিং জানিয়ে দিলেন তারা স্বাধীন দেশ হিসেবে থাকতে চায়।

১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তান সশস্ত্র পাঠানদের ট্রেনিং দিয়ে ব্রিটিশ অফিসারদের পরিচালনায় কাশ্মীরে প্রবেশ করাতে থাকে। ঐ বাহিনী কাশ্মীরে হত্যাকাণ্ড ও লুঠতরাজ চালাতে থাকে। বারমুলায় ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা মহম্মদ শেরওয়ানিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এবং ২৬ অক্টোবর শ্রীনগর দখলের জন্য ঝিলম নদীর অপর পাড়ে পৌঁছায়।[২] ঐ অবস্থায় মহারাজা হরি শিং ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা শেখ আবদুল্লাহকে জেলখানা থেকে মুক্ত করতে এবং ভারতের অধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হন। ২৭ অক্টোবর থেকে ভারতীয় জনগণের শত্রু নেহরুর বাহিনী কাশ্মীরের উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে। কাশ্মীরের জনগণ কখনোই ভারতীয়দের অধীনতা মেনে নেয়নি।

আরো পড়ুন:  সেলুলার জেলের ফলক থেকে উধাও তিন শতাধিক বাঙালিসহ ৪৫৩ জন বিপ্লবীর নাম

পাকিস্তানের দখলীকৃত আজাদ কাশ্মীর এখনো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে আছে। যাদের নিজস্ব সংবিধান, পতাকা এবং প্রধানমন্ত্রী আছে, আছে রাজধানী। তবে আজাদ কাশ্মীরের নেতারা কিন্তু জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের সদস্যপদ চায় না, অর্থাৎ আজাদ কাশ্মিরের নেতারা পাকিস্তানের অধীনেই থাকতে চায়।

কাশ্মীর কোনোদিনও স্বাধীন হবে না। কুর্দিস্তানের কথা স্মরণ করুন। কুর্দিরা চার দেশে বিভক্ত। কাশ্মীরিরাও তাই হচ্ছে। প্রধান সমস্যা, নিপীড়িতেরা গত দুশ বছরের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী অভিজ্ঞতাকে আমলে নিচ্ছে না।

কাশ্মীরে শ্রেণিসংগ্রাম চলছে। কিন্তু তা প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব অভিমুখী নয়। যার ফলে কাশ্মীরের স্বাধীনতা এখন অনেকটাই অবাস্তব। সোভিয়েত পতনের পরে কেবল পূর্ব তিমুর এবং দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হয়েছে। দুটো দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ খ্রিস্টান। পৃথিবীতে আর কক্ষনোই জাতীয়তাবাদী স্বাধীন দেশ, ২-১টা ব্যতিক্রম বাদে, হবে না।

কাশ্মীরে কি কোনো কমিউনিস্ট আছে? ফিলিস্তিনে কমিউনিস্ট পার্টি কতটুকু শক্তিশালী? কাশ্মীর গত ৭০ বছরে দর্শন-চিন্তায় কতটুকু এগিয়েছে? কাশ্মীর এবং হিমাচল প্রদেশ থেকে সিপিএম বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ২০১৫-তে চণ্ডিগড় এবং শিমলায় কোনো সিপিএম দেখিনি।

১৯৯৯ সালে জ্যোতিবসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে বলেছিলেন যে, “সেনাবাহিনীর প্রতি আমাদের পূর্ণ অঙ্গীকার ও সমর্থন আছে।”[৩] সিপিআই (এম) ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সেনাবাহিনীর সকল গণহত্যাকে সমর্থন করেছে। আমারো কাছে তাই মনে হচ্ছে, কাশ্মীর স্থায়ীভাবে ফিলিস্তিনের মতো হয়ে যাবে। এটিও রাখাইনের মতোও হতে পারে।

স্বাভাবিকভাবেই, আগ্রাসনের পরবর্তী ধাপ হিসেবে ভারত যে কাশ্মীরের জমি দখল করে সেখানে বহিরাগতদের বসতি গড়ে তুলতে পারে, এই আশঙ্কার সঙ্গত কারণ আছে। প্যালেস্তাইনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং জেরুজালেম অঞ্চলে এই একই কৌশলে ইজরায়েল কীভাবে জনসংখ্যার বিন্যাস পালটে ফেলেছে, সেই ইতিহাস সবারই জানা। এই মুহূর্তে, সেই সম্ভাবনার পথে একটিই সাংবিধানিক অন্তরায় আছে — ৩৫এ ধারা। স্বায়ত্তশাসনের এই শেষ চিহ্নটিকে বাঁচিয়ে রাখা তাই কাশ্মীরের মানুষের কাছে স্বাধীনতার লড়াই এবং ভারতীয় আগ্রাসনের মুখে জমি-জীবিকা ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়েরই অঙ্গ।

আরো পড়ুন:  ভারতে পুনরাগমন --- পাবলো নেরুদা

তথ্যসূত্র:

১. প্রবীর ঘোষ, কাশ্মীরে আজাদির লড়াই একটি ঐতিহাসিক দলিল, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ অক্টোবর ২০১০, পৃষ্ঠা ১০
২. চিন্মোহন সেহানবীশ গণেশ ঘোষ ও অন্যান্য, মুক্তির সংগ্রামে ভারত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা দ্বিতীয় সংস্করণ ডিসেম্বর ২০১০ পৃষ্ঠা ২০৩
৩. প্রবীর ঘোষ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!