মুঘল আমলের পরাধীন বাংলা হচ্ছে স্বাধীন সুলতানি আমল পরবর্তী ২০০ বছরের মুঘল শাসন

মুঘল আমলের উপনিবেশিক পরাধীন বাংলা (ইংরেজি: Bengal under Mughal Regime) হচ্ছে বাংলার ইতিহাসে স্বাধীন সুলতানি আমল পরবর্তী ২০০ বছরের উপনিবেশিক মুঘল শাসন। ১৫৩৮ থেকে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে আকবরের বাংলা জয় পর্যন্ত আটত্রিশ বৎসর বাংলা শাসনের ইতিহাসে আফগান বা পাঠান শাসনামল বলে পরিচিত। বাংলায় আফগান শাসনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শের খান সূর। আফগান শক্তির পুনরুত্থানের চাপে বাংলায় হােসেন শাহী শাসনের এবং দীর্ঘ ২০০ বছরের স্বাধীন সুলতানী শাসনের অবসান ঘটে।

হােসেন শাহী বংশের শেষ সুলতান মাহমুদ শাহকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে শের খান সুর চূড়ান্ত পরাজিত করে গৌড় অধিকার করেন। শের খান সূরকে গৌড় থেকে বিতাড়িত করার নিমিত্ত দিল্লীর মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সঙ্গে মাহমুদ শাহ সাময়িক জোট সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর এ কূটনৈতিক তৎপরতা সচল হয় নাই। বাংলায় আফগান শক্তি পুনরুত্থানের ফলে দিল্লীর মুঘল সম্রাট হুমায়ুন আতঙ্কিত হন। এর ফলে, আফগান-মুঘলদের মধ্যে পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। এ দ্বন্দ্বে আফগানরা বিজয়ী হয়ে ভারতের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হন। শের শাহ্ বাংলাকে কয়েকটি প্রশাসনিক এলাকায় বিভক্ত করেন। তাঁর আমলের বাংলার আর একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা হচ্ছে বরবক শাহ নামধারী একজন সুলতান স্বাধীন মুদ্রার প্রচলন করেন। ১৫৪২ থেকে ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে বরবক শাহ নামক একজন সুলতান রাজত্ব করেন শেরশাহের রাজত্বের মধ্যভাগে । তিনি বিদ্রোহী হন এবং স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। শেরশাহের পুত্র ও উত্তরাধিকারী ইসলাম শাহের রাজত্বকালে এই জেলা ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লীর অধীনে ছিল। তিনি শামসউদ্দীন মােহাম্মদ সূরকে বাংলার প্রশাসক এবং সােলায়মান কররানীকে বিহারের প্রশাসক নিযুক্ত করেন।

১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দে সামসউদ্দীন দিল্লীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সামসউদ্দীন শাহ গাজী উপাধি ধারণ করেন। সূর সেনাপতি হিমুর কাছে ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে শামসউদ্দীন কালপী নামক স্থানে পরাজিত ও নিহত হন। ভাটির জমিদার ঈসা খান ও সােলায়মান কররাণী বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। ইসলাম শাহ সূর ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর পরলােক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর সূর সাম্রাজেরও পতন শুরু হয়।

হুমায়ুনের বিরুদ্ধে কনৌজের যুদ্ধে শের শাহের অধীনস্থ সেনাধ্যক্ষ হিসাবে কররাণী আফগান বংশীয় তাজখান ও সােলায়মান খান কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সে জন্য পুরস্কারস্বরূপ শের শাহ তাদেরকে বিহারের খােয়াসপুর এবং গঙ্গা নদীর তীরের কয়েকটি গ্রামের জায়গীর দান করেন। অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায় অগ্রসর হয়ে তাজ খান ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় কররাণী বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরলােক গমন করেন। তাজ খানের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই সােলায়মান কররানী বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনিও একজন সুদক্ষ শাসক ছিলেন। পররাষ্ট্র নীতিতে তিনি দিল্লীর মুঘল সম্রাটের সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখেন। তাঁর বৈদেশিক নীতির ফলে মুঘল সম্রাট ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা আক্রমণ করেননি। এ বংশের সুলতানরা এ জেলাসহ সমগ্র বাংলাদেশ শাসন করেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্যের মূলে যাঁর অবদান অসামান্য ছিল, তিনি ছিলেন তাঁর মন্ত্রী লােদী খান। সমর ক্ষেত্রেও তিনি তৎকালীন সময়ে একজন বিখ্যাত সমর নায়ককে তাঁর সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে পেতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি এক বিরাট রাষ্ট্রের প্রসিদ্ধ লাভ করেন। উক্ত সেনানায়কের নাম কালাপাহাড়। তিনি একজন বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান নরপতি ছিলেন। ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে পিতার মৃত্যুর পর দাউদ কররাণী বাংলার সিংহাসনে বসেন। তাঁর দূরদর্শিতার অভাবের জন্য দিল্লী-বাংলার সম্পর্ক খুব খারাপ হয়। এর ফলে ১৫৭২ থেকে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালে মুঘল সেনাধ্যক্ষ মুনিম খান এবং দাউদ খান কররাণীর মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। দাউদ খান কররানী পরাজিত হন। তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাফল্যের জন্য মুনিম খান ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের নিকট থেকে ‘খান-ই-খানান’ উপাধি অর্জন করেন।

আরো পড়ুন:  বাংলার জনগণের দিল্লি বিরোধিতা হচ্ছে এক হাজার বছরের শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস

মুঘল সেনাধ্যক্ষ মুনিম খান তানডা থেকে কিছু মুঘল সৈন্য আফগানদের দমনের জন্য ঘােড়াঘাটে পাঠান। ঘােড়াঘাটে অবস্থানরত আফগান সৈন্যরা পরাজিত হয়ে কোচবিহারের দিকে পলায়ন করে। কোচবিহারের রাজা নারায়ণ দাউদ খান কররাণীর বিরুদ্ধে আকবরের মুঘল অভিযানের সময় সহায়তা করেন। অন্যান্য এলাকায়ও আফগানরা পরাজিত হয়, কিন্তু দাউদকে পরাজিত করা মুঘলদের পক্ষে তাড়াতাড়ি সম্ভব হয়নি। আফগান জায়গীরদার ও হিন্দু রাজারা মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরােধ সৃষ্টি করে। সােলায়মান কররাণীর ভ্রাতুস্পুত্র জোনায়েদ কররাণীর অভ্যুদয়ের ফলে মুঘলদের অবস্থা আরও খারাপ হয়। দাউদ যখন উড়িষ্যায় আশ্রয় গ্রহণ করেন, তখন জোনায়েদ একদল আফগান সৈন্য নিয়ে বিহারের ঝাড়খণ্ডে আগমন করেন। মুঘল সেনাধ্যক্ষ মুনিম খান ও তােডরমল তানডা ত্যাগ করে উড়িষ্যার দিকে অগ্রসর হন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে মার্চের তিন তারিখে আফগান ও মুঘলদের মধ্যে তুকারায়ের বা মুঘলমারীতে এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধের ফলে আফগানরা খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। তুকারায়ের যুদ্ধের পর মুনিম খান পুনরায় ঘােড়াঘাট দখলের জন্য সামরিক তৎপরতা পরিচালনা করেন। কারণ, আফগান সেনাধ্যক্ষ কালাপাহাড়, বাবু মানকলি ও অন্যান্য আফগান প্রধানরা কোচবিহার থেকে ঘােড়াঘাটে সমবেত হয়ে মুঘল সেনানিবাস দখল করেন। উক্ত স্থান থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে মুনিম। খান তানডা প্রত্যাবর্তন করেন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল দাউদ কররাণী মুঘল সম্রাট আকবরকে বাংলা ও বিহারের সম্রাট হিসাবে স্বীকার করেন এবং মুঘলদের অধীনস্থ সামন্তে পরিণত হন। মুনিম খান তানডা ফিরে আসেন এবং ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর পরলােক গমন করেন। মুনিম খানের মৃত্যুর ফলে মুঘল সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। ইতিমধ্যে দাউদ কররাণী কটকের সন্ধি ভঙ্গ করে এ জেলাসহ উত্তর ও পশ্চিম বাংলা পুনরুদ্ধার করেন এবং তানডায় অনুপ্রবেশ করেন। ভাটির জমিদার ঈশ্বর খান পূর্ব বাংলা থেকে মুঘল নৌ-বাহিনীকে বিতাড়িত করেন। মুঘল সৈন্যরা বাংলাদেশ ত্যাগ করে বিহারে আশ্রয় গ্রহণ করে।

আরো পড়ুন:  বঙ্গ দেশের পশ্চিমদিকের ভূখণ্ডটি পশ্চিমবঙ্গ যা বর্তমানে দিল্লির অধীন একটি অঙ্গরাজ্য

মুঘল সম্রাট আকবর মুনিম খানের মৃত্যুর খবর পেয়ে বৈরাম খানের ভাগ্নে খান জাহান হােসেন কুলি খানকে বাংলার প্রশাসক ও সেনাপতি নিযুক্ত করেন। সম্রাট আকবর রাজা তােডরমলকে হােসেন কুলী খানের অধীনস্থ সেনাধ্যক্ষ নিয়ােগ করেন। তাঁদের নিয়ােগের ফলে বাংলায় দ্রুত পট পরিবর্তন হয়। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই রাজ-মহলের নিকটে মুঘল ও আফগানদের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুঘল বাহিনীর কাছে দাউদ পরাজিত ও বন্দি হন। মুঘল সেনাপতিরা দাউদ কররাণীকে হত্যা করে। রাজমহলের যুদ্ধের ফলে বাংলায় মুঘল শাসন শুরু হয়। খান জাহান তানডায় রাজধানী স্থাপন করেন। মুঘল সেনাধ্যক্ষের নিকট কিছু জমিদার পরাজিত হন এবং অনেকে আত্মসমর্পণ করেন। অল্প কিছুদিন পর জমিদাররা আবার স্বাধীন হন। এর ফলে, মুঘল শাসনাধীনে শুধুমাত্র বাংলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলই অবশিষ্ট থাকে।

বাংলার পরাধীন যুগ

১৫৭৪ থেকে ১৭২৭ পর্যন্ত মােট ৪০ জন মুঘল শাসনকর্তা বাংলাদেশ শাসন করেন। তাঁদের মধ্যে মানসিংহ (১৫৯৪-১৬০৬ খ্রিস্টাব্দ), ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩ খ্রিস্টাব্দ), শাহজাদা মুহাম্মদ শুজা (১৬৩৯-৬০ খ্রি.), মীর জুমলা (১৬৬০-৬৩ খ্রিস্টাব্দ), শায়েস্তা খান (১৬৬৪-৬৮, ১৬৭৯-৮৮ খ্রিস্টাব্দ) এবং মুর্শিদকুলী খান (১৭১৭-২৭ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ। দিল্লীর দুর্বলতার দরুন মুঘল সম্রাটের নিযুক্ত সুবে বাংলার শেষ শাসনকর্তা মুর্শিদকুলী খান প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন নরপতির মতাে এ দেশের শাসনকর্তা। মুর্শিদকুলী খান (১৭১৭-২৭ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ। তাঁর চার উত্তরাধিকারী সুজাউদ্দীন খান (১৭২৭-৩৯ খ্রিস্টাব্দ), সরফরাজ খান (১৭৩৯-৪০ খ্রিস্টাব্দ), আলীবর্দী খান (১৭৪০-৫৬ খ্রিস্টাব্দ) এবং সিরাজউদ্দৌলা (১৭৫৬-৫৭ খ্রিস্টাব্দ) স্বাধীন নবাব ছিলেন। স্যার যদুনাথ সরকার বলেন ‘মুঘলরা বাংলাদেশের জন্য শান্তি ও প্রগতির এক নব যুগের সূচনা করে। এর ফলে, উত্তর-ভারত এবং উত্তর ভারতের স্থলপথের মধ্য দিয়ে যথা এশিয়ার দেশসমূহের সঙ্গে বাংলাদেশের যােগসূত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাবকালে এই যােগসূত্র এক বার ছিন্ন হয়। বাংলার শাসনকর্তারা দিল্লীর অধীনতা অস্বীকার করায় এ যােগসূত্র আবারও ছিন্ন হয়েছিল। এর ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল থেকে উক্ত সাম্রাজ্যের অন্যতম সুশাসিত প্রদেশ সুবে বাংলায় অসংখ্য রাজ-কর্মচারী, পণ্ডিত, ধর্মপ্রচারক, বণিক, শিল্পী ও সৈন্যদের দলে দলে আগমন ঘটতে থাকে । ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংরেজ শাসন আমলে যে নবজাগরণ দেখা দেয় আড়াইশত বছর আগেই নিঃসন্দেহে তার ক্ষীণ সূচনা দেখা দিয়েছিল । এ সবই ছিল মুঘল যুগের শান্তির ফলে, যে ফল সত্যিকারভাবেই গৌরবজনক।’

আরো পড়ুন:  প্রাচীন বাংলার ইতিহাস হচ্ছে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ দুই হাজার বছর সময়

তথ্যসূত্র:

১. অজয় কুমার রায়, ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস, টাঙ্গন, দ্বিতীয় সংস্করণ আগস্ট ২০১৮, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৫-৩১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!