রাষ্ট্র ও বিপ্লব
১৮৭১ সালে প্যারিস কমিউনের অভিজ্ঞতা, মার্কসের বিশ্লেষণ
১. কমিউনারদের প্রচেষ্টার বীরত্ব কোনখানে?
একথা সুবিদিত যে, কমিউনের মাস কয়েক আগে ১৮৭০ সালের হেমন্তে মার্কস প্যারিস শ্রমিকদের হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন যে, সরকার উচ্ছেদের চেষ্টা হবে হতাশার মূর্খতা। কিন্তু ১৮৭১ সালের মার্চে যখন শ্রমিকদের ওপর চূড়ান্ত লড়াই চাপিয়ে দেওয়া হল এবং মজুরেরা তা গ্রহণ করলো, যখন অভ্যুত্থান হয়ে দাঁড়ালো ঘটনা, তখন তার অশুভ দুর্লক্ষণাদি সত্ত্বেও বিপুলতম উল্লাসে মার্কস তাকে স্বাগত জানান। অকাল আন্দোলনকে পণ্ডিতি চালে নিন্দা করেননি মার্কস, যা করেছিলেন মার্কসবাদের রুশি বেইমান, শোচনীয় খ্যাতনামা প্লেখানভ; ১৯০৫ সালের নভেম্বরে শ্রমিক-কৃষকদের সংগ্রামে উৎসাহ দেওয়া লেখা লিখে ১৯০৫ সালের ডিসেম্বরের পর উদারনীতিকদের মতো উনি চেঁচান : হাতিয়ার ধরা উচিত হয়নি।
মার্কস শুধু তার ভাষায় স্বর্গাভিযানী কমিউনারদের বীরত্বে উচ্ছ্বসিত হননি। লক্ষ্যার্জন না হলেও মার্কস এই গণবৈপ্লবিক আন্দোলনটার মধ্যে দেখেছিলেন বিপুল গুরুত্বের একটা ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, বিশ্ব প্রলেতারীয় বিপ্লবের একটা অগ্র পদক্ষেপ, একটা ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, বিশ্ব প্রলেতারীয় বিপ্লবের একটা অগ্র পদক্ষেপ, একটা ব্যবহারিক পদক্ষেপ যা শত শত কর্মসূচি ও যুক্তির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ, তা থেকে রণকৌশলের শিক্ষা গ্রহণ, তার ভিত্তিতে নিজ তত্ত্বের পুনর্বিচার- নিজের জন্য এই কর্তব্য হিসাবে নিয়েছিলেন মার্কস।
কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে যে একটি মাত্র সংশোধন মার্কস প্রয়োজন মনে করেছিলেন সেটা তিনি করেন প্যারিস কমিউনারদের বৈপ্লবিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।
কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারের নতুন জার্মান সংস্করণের শেষ যে ভূমিকাটিতে উভয় রচয়িতারই স্বাক্ষর আছে তার তারিখ ১৮৭২ সালের ২৪ শে জুন। এই ভূমিকায় লেখকেরা, কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বলেছেন যে, ‘কমিউনিস্ট ইশতেহারের কর্মসূচি এখন স্থানে স্থানে অচল হয়ে গেছে।’
তাঁরা বলেছেন, ‘…..বিশেষ করে কমিউন প্রমাণ করেছে যে, তৈরি রাষ্ট্রযন্ত্রটা সোজাসুজি দখল করে তা নিজেদের উদ্দেশ্যে চালাতে শ্রমিক শ্রেণি পারে না…’
এ উদ্ধৃতি দ্বিতীয় উদ্ধৃতি চিহ্নের কথাগুলো লেখকেরা নিয়েছেন মার্কসের রচনা ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ থেকে।
এইভাবে, প্যারিস কমিউনের একটা মূল ও প্রধান শিক্ষাকে মার্কস ও এঙ্গেলস এতই বিপুল রকমের গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করেছিলেন যে, সেটাকে তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে একটা মূল সংশোধনী হিসেবে হাজির করেন।
এটা খুবই বৈশিষ্ট্যসূচক যে, এই মূল সংশোধনীটাকেই সুবিধাবাদীরা বিকৃত করেছে এবং তার অর্থটা নিশ্চয় কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারের একশ জন পাঠকের মধ্যে নিরানব্বই জন না হলেও অন্তত নব্বই জনই জানেন না। এই বিকৃতিটা নিয়ে আমরা বিশদে বলবো পরে, বিকৃতি নিয়ে লেখা বিশেষ পরিচ্ছেদে। এখন শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, আমাদের উদ্ধৃতি মার্কসের এই বিখ্যাত উক্তিটির চলতি, স্থূল অর্থ ধরা হয় যেন এই যে মার্কস এখানে ক্ষমতা দখলের বিপরীতে ধীর বিকাশ ইত্যাদির কথায় জোর দিয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে, ব্যাপারটা একেবারে উল্টো। এখানে মার্কসের চিন্তাটা এই যে, তৈরি রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে সোজাসুজি দখল করায় সীমাবদ্ধ থাকা নয়, শ্রমিক শ্রেণিকে তা ভাঙতে হবে, চূর্ণ করতে হবে।
১৮৭১ সালের ১২ই এপ্রিল, ঠিক কমিউনের সময়েই মার্কস কুগেল-মানকে লিখেছিলেন :
‘…তুমি যদি আমার আঠারোই ব্রুমেয়ারের শেষ অধ্যায়ে চোখ বুলোও, তাহলে দেখবে যে আমি ঘোষণা করেছিলাম, ফরাসি বিপ্লবের পরের প্রচেষ্টা হবে আমলাতান্ত্রিক সামরিক যন্ত্রটাকে এতদিন যা হয়ে এসেছে সেভাবে হাত থেকে হস্তান্তরে বদল করা নয়, চূর্ণ করা, এবং এইটেই হল ইউরোপীয় ভূখণ্ডে সত্যকার যে-কোন গণবিপ্লবের প্রাথমিক শর্ত। এবং ঠিক চেষ্টাই করেছে আমাদের বীর প্যারিস কমরেডরা। [কুগেলমানের কাছে লেখা মার্কসের পত্রাবলি রুশ ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে অন্তত দুটি সংস্করণ, তার একটি আমার সম্পাদনায় ও আমার ভূমিকাসহ।]
‘আমলাতান্ত্রিক সামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে চূর্ণ করা’- এই কথাগুলির মধ্যেই রয়েছে বিপ্লবে রাষ্ট্র প্রসঙ্গে প্রলেতারিয়েতের কর্তব্যের প্রশ্নে মার্কসবাদের সংক্ষেপে প্রকাশিত প্রধান শিক্ষা। এবং ঠিক এই শিক্ষাটাকে একেবারে ভুলে বসা হয়েছে তাই নয়, মার্কসবাদের প্রচলিত কাউৎস্কি মার্কা ব্যাখ্যায় তা সোজাসুজি বিকৃত করা হয়েছে!
মার্কস আঠারোই ব্রুমেয়ার সম্পর্কে যে উল্লেখ করেছেন, তার প্রাসঙ্গিক অংশটা আমরা আগেই পুরোপুরি তুলে দিয়েছি।
মার্কসের উদ্ধৃত বক্তব্যের বিশেষ করে দুটি জায়গা লক্ষ্য করা চিত্তাকর্ষক হবে। প্রথমত, তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত সীমাবদ্ধ রেখেছেন ইউরোপীয় ভূখণ্ডে। ১৮৭১ সালের ক্ষেত্রে এটা বোধগম্য, তখন ইংল্যান্ড ছিল বিশুদ্ধ পুঁজিবাদী দেশের আদর্শ, কিন্তু সামরিক চক্র ছিল না, এবং বেশ খানিকটা মাত্রায় আমলাতন্ত্রও ছিল না। সেইজন্যই মার্কস ইংল্যান্ডকে বাদ দিয়েছেন, সেখানে তৈরি রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে চূর্ণ করার প্রাথমিক শর্ত ছাড়াও তখন বিপ্লব এমনকি গণবিপ্লব কল্পনা করা যেত ও সম্ভব ছিল।
এখন ১৯১৭ সালে, প্রথম সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধের যুগে মার্কসের এই সীমারোপটা খারিজ হয়ে যাচ্ছে। সমরচক্র ও আমলাতান্ত্রিকতার অনস্তিত্বের দিক থেকে গোটা পৃথিবীতে অ্যাঙ্গলো-স্যাকসন মুক্তির বৃহত্তম ও সর্বশেষ প্রতিনিধি ইংল্যান্ড ও আমেরিকা উভয়েই গড়িয়ে গেছে সবকিছুকে অধীনস্থ করা, সবকিছুকে দলিত করা আমলাতান্ত্রিক-সামরিক প্রতিষ্ঠানের সাধারণ ইউরোপীয় কদর্য, রক্তাক্ত জলায়। এখন ইংল্যান্ড আমেরিকা উভয় স্থানেই যেকোন সত্যকার গণবিপ্লবের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে তৈরি (১৯১৪-১৯১৭ সালে যা তৈরি হয়ে উঠেছে ইউরোপীয় সাধারণ সাম্রাজ্যবাদীসুলভ একটা নিখুঁত মাত্রায়) রাষ্ট্রযন্ত্রটার ভাঙন ও ধ্বংস।
দ্বিতীয়ত, বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত মার্কসের অসাধারণ গভীর এই উক্তিতে যে, আমলাতান্ত্রিক-সামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রটার ধ্বংস হচ্ছে যেকোন সত্যকার গণবিপ্লবের প্রাথমিক শর্ত। মার্কসের মুখে গণবিপ্লবের এই কথাটা আশ্চর্য শোনায় এবং রুশি প্লেখানভপন্থী ও মেনশেভিকরা স্ত্রুভের এই যে অনুগামীরা নিজেদের মার্কসবাদী ভাবতে ইচ্ছুক, এরা মার্কসের এই উক্তিটাকে ‘মুখফসকানি’ বলে রায় দিতে পারেন। মার্কসবাদে তাঁরা এমনই হতভাগ্য-উদারনীতিক বিকৃতি ঘটিয়েছেন যে, বুর্জোয়া ও প্রলেতারীয় বিপ্লবের বৈপরীত্য ছাড়া আর কিছুই দেখেন না, তদুপরি এই বৈপরীত্যকে তাঁরা বোঝেন অসম্ভব নিষ্প্রাণ ধরনে।
বিশ শতকের বিপ্লবের দৃষ্টান্ত যদি নিই, তাহলে পর্তুগীজ ও তুর্কি উভয় বিপ্লবকে অবশ্য বুর্জোয়া বলে স্বীকার করতে হবে। কিন্তু এদের কোনটাই গণ নয়, কেননা জনগণ, তাদের বিপুল অধিকাংশ সক্রিয়ভাবে, স্বাধীনভাবে, নিজস্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবি নিয়ে এদের কোন বিপ্লবেই লক্ষণীয় মাত্রায় অবতীর্ণ হয়নি। উল্টোদিকে পোর্তুগীজ ও তুর্কি বিপ্লবের ভাগ্যে মাঝে মাঝে যে চমৎকার সাফল্য লাভ ঘটেছিল, ১৯০৫-১৯০৭ সালের রুশ বুর্জোয়া বিপ্লবে তা না ঘটলেও নিঃসন্দেহেই এটি ছিল সত্যিকার গণবিপ্লব, কেননা জনগণ, তাদের অধিকাংশ, সমাজের পীড়নে ও শোষণে দলিত সবচেয়ে গভীরের নিচুটা উঠে দাঁড়ায় স্বাধীনভাবে, বিপ্লবের সমস্ত গতিধারায় উৎকীর্ণ করে নিজেদের দাবি, ধ্বংসনীয় সাবেকি সমাজের জায়গায় নিজেদের মনমতো নতুন সমাজ গড়ার জন্য নিজেদের প্রচেষ্টার ছাপ।
১৮৭১ সালের ইউরোপীয় ভূখণ্ডে কোন একটা দেশেও প্রলেতারিয়েত জনগণের অধিকাংশ হয়ে ওঠেনি। আন্দোলনে সত্যসত্যই অধিকাংশকে টেনে আনা গণবিপ্লব হতে পারতো কেবল এমন বিপ্লব যাতে প্রলেতারিয়েত ও কৃষক উভয়েই রয়েছে। এই উভয় শ্রেণি দিয়েই তখন হতো জনগণ। উভয় শ্রেণির ঐক্য এই জন্য যে, আমলাতান্ত্রিক-সামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রটা তাদের নির্যাতন, দমন ও শোষণ করে। একে ভাঙা, একে চূর্ণ করাই ছিল জনগণের, তাদের অধিকাংশের, শ্রমিক ও অধিকাংশ কৃষকদের স্বার্থ, এই ছিল প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে গরিব চাষির স্বাধীন জোট গঠনের প্রাথমিক শর্ত। আর এ জোট ছাড়া গণতন্ত্র পাকা হয় না, সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন সম্ভব নয়।
সবাই জানেন, প্যারিস কমিউন ঠিক এই জোট বাঁধার দিকেই এগুচ্ছিল, যদিও অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ধরনের একগুচ্ছ কারণে লক্ষ্যার্জন করতে পারেনি।
সুতরাং সত্যকারের গণবিপ্লবের কথা বলে মার্কস পেটি বুর্জোয়ার বৈশিষ্ট্যর কথা এতটুকু না ভুলে (সে কথা তিনি বহুবার অনেক বলেছেন) ১৮৭১ সালের ইউরোপীয় ভূখণ্ডের অধিকাংশ রাষ্ট্রে শ্রেণিসমূহের বাস্তব সহসম্পর্কের কঠোর হিসাব নিয়েছিলেন। অন্যদিকে তিনি এই স্থির করেন যে, রাষ্ট্রযন্ত্রটা ভাঙার প্রয়োজন আসছে শ্রমিক ও কৃষকদের স্বার্থ থেকে, তাদের ঐক্যবদ্ধ করছে তা, পরগাছাটাকে সরিয়ে নতুন কিছু দিয়ে তার বদলি ঘটাবার সাধারণ কর্তব্য রাখছে তাদের সামনে। কিন্তু ঠিক কী দিয়ে?
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (এপ্রিল ২২, ১৮৭০ – জানুয়ারি ২১, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।