লোকসংগীত গ্রামীণ সংগীতের ধারা যা বিশ শতকের লোক পুনর্জাগরণের সময়ে উদ্ভূত

লোকসংগীত (ইংরেজি: Folk song) হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী লোক সংগীত এবং বিশ শতকের লোক পুনর্জাগরণের সময় থেকে উদ্ভূত ধারা। মূলত লোকগীতি, লোকবাদ্য ও  লোকনৃত্যের সমন্বিত রূপকেই লোকসঙ্গীত বলা যায়। লোকসংগীত হচ্ছে সেইসব গ্রামীণ গানসমূহ যেগুলো পরবর্তীকালে রেকর্ডের মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনমানসের কাছ থেকে উঠে আসে আধা শহুরে বা শহুরে জনমানসে।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে বহু মত বিনিময়ের পর আন্তর্জাতিক লোকসংগীত পরিষদ বা International Folk Music Council-Folk Song (যার বাংলারূপ লোকসংগীত) শব্দটির আমদানি ঘটায়। তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তারা এর সংজ্ঞা নিরূপণ করেন। সেগুলো হলো ঐতিহ্য, উদ্ভাবন ও নির্বাচন। ইংরাজিতে Continuity, Variation ও Selection। এই তিনটি বিষয়কে বিশ্লেষণ করলে এই দাড়ায় যে—Continuity অর্থাৎ ধারাবাহিকতার সঙ্গে ঐতিহ্য রক্ষার বিষয়টি জরুরি, Varation অর্থাৎ বৈচিত্র্যের মূল বিষয় হচ্ছে উদ্ভাবন এবং Selection শব্দের সঙ্গে গ্রামীণ জনমানসের গ্রহণ করার প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব পেয়ে যায় ।

Folk Song বা লোকসংগীতের এই সংজ্ঞা নির্ধারিত হবার পর তা দ্রুতগতিতে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের দেশে বিশেষ করে ভারতবর্ষে তখনকার সময় সব থেকে শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম আকাশবাণীর একান্ত চেষ্টায় এই Folk Song বা লোকসংগীত ক্যাপশানটি শহর থেকে গ্রাম গ্রামান্তরে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। খুবই অবাক হতে হয়, যে গ্রামীণ মানুষের মুখে এতদিন পল্লীগীতি, গ্রাম্যগীতি শব্দটি ছিল এক নিজস্ব অনুভূতির প্রকাশ—তা অতি সহজেই তাঁরা ত্যাগ করে মুখে তুলে নিলেন Folk Song, বা লোকসংগীত শব্দটি। আকাশবাণীসহ কিছু কিছু রেকর্ড কোম্পানি গ্রামের এই ধারাকে Folk Song বা লোকসংগীত লেভেল দিয়ে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতে কোনো রকম আর রাখঢাক রাখল না। গ্রামীণ ঐতিহ্যের বিভিন্ন ধারার গান যেমন লোকসংগীত ক্যাপশানে বের হতে শুরু করল তেমনি পাশাপাশি শুরু হয়ে গেল শহুরে বা আধাশহুরে জনজীবনে বেড়ে ওঠা মানুষদের লেখা কিছু গান—যা লোকসংগীত নামেই প্রচার করানোর চেষ্টা। অবশ্যই গ্রামীণ সুরকে আশ্রয় করে, কখনো সখনো গ্রামীণ ভাবধারার প্রকাশ কথাতেও। সংজ্ঞা নিরূপণ যাই-ই হোক; আমাদের একান্ত গ্রামীণ অনুভূতির সুপ্রাচীন ঐতিহ্য আস্তে আস্তে ঘরমুখী হতে শুরু করল এর ফলে।[১]

আরো পড়ুন:  ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের উৎপত্তি হয়েছে বেদ-পরবর্তীকালের ধ্রুপদী সংগীত থেকে

বাংলা লোকসংগীত

মূল নিবন্ধ: বাংলা লোকসংগীত গ্রামীণ জনগণের সংগীত ইতিহাসে রচিত গীত ও সংরক্ষিত ভাণ্ডার

বাংলা লোকসংগীত (ইংরেজি: Folk music of Bengal) হচ্ছে বাংলা সংস্কৃতির সূচনাপর্ব থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত গ্রামীণ জনগণের সংগীত বিষয়ক আনুষঙ্গিক ঘটনাপ্রবাহের ইতিহাসে রচিত, গীত এবং সংরক্ষিত সংগীতভাণ্ডার। গ্রাম ও শহরের মানুষের সাথে গ্রামীণ গানের যোগাযোগের পথেই মূলত অষ্টাদশ শতকে গ্রামীণ গীতি নিয়ে ভাবনাচিন্তার বিকাশ ঘটতে শুরু হয়।

পল্লিগীতি

ফলশ্রুতিতে গ্রাম্যগীতি বা পল্লীগীতির বিস্তারলাভ ঘটতে থাকে দিনের পর দিন। কলের গানের কালে স্পর্শ কাতরতায় লোকসংগীতের স্থান ছিলো তুঙ্গে। অন্যান্য গানের তুলনায় লোকসংগীতের বিক্রি ছিলো আশাপ্রদ। লোকসংগীতের প্রধান ধারাটি পল্লীগীতি নামে পরিচিতি পেয়েছিল। পল্লী বাংলার ভাবমূর্তি সৃষ্টি করে লোককবিগণ তৎপর থাকতেন গান রচনায়।

বিশ শতকের ত্রিশের দশকে শচীন দেব বর্মণ, আব্বাস উদ্দীন, নায়েব আলী, মমতাজ আলী, গিরিন চক্রবর্তী, পরেশ দেব, আবদুল লতিফ, আবদুল হালিম চৌধুরী, অনন্তবালা বৈষ্ণবী, হরিমতী, কল্যাণী দাস, লাবণ্যলেখা পাসকেল, প্রমদা, কমলা ঝরিয়া, কুসুম গোস্বামী, ধীরেন দাস, বীণা চৌধুরী প্রমুখ শিল্পীদের গাওয়া পল্লিগীতি ঘরে ঘরে সমাদৃত হয়েছিল। পাঁচের দশকে আবির্ভাব ঘটে নির্মলেন্দু চৌধুরী, পূর্ণদাস বাউল, অমর পাল ও বিষ্ণুপদ দাসের। এদের প্রত্যেকেই আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলার লোকসংগীতকে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।[২]

বাংলা লোকসংগীত শুধু রেকর্ডের মাধ্যমেই বা কেন বলি, আকাশবাণী বা ঢাকা রেডিয়োর মাধ্যমে বিশ শতকে এই গান সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে বাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এইভাবে এক অঞ্চলের গানের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে অন্য অঞ্চলের মানুষ খুব সহজেই। যা আগে কখনোই এভাবে সম্ভব হয়ে ওঠে নি।

বাংলা লোকসংগীতের সীমানা ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে যে সমস্ত শিল্পীর কণ্ঠ কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তাঁদের মধ্যে—আব্বাসউদ্দীন, নায়েব আলী, গিরীন চক্রবর্তী, গৌরী কেদার চক্রবর্তী, অনন্তবালা, সুরেন চক্রবর্তী, মিস্ হরিমতিসহ আরো অনেক অনেক শিল্পীর অবদান আমরা কখনোই ভুলতে পারি না। পল্লীবাংলার বিভিন্নধারার প্রচলিত গান উঠে আসে জনসমক্ষে যা আজও আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে যায়। বিশেষ করে তার কথার সরলতা এবং সুরের সাবলীলতা গ্রাম থেকে শহুরে মানুষের মন ছুঁয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। যার ফলস্বরূপ আমরা বড়ো জায়গায় বা উচ্চশিক্ষিত সমাজে গ্রামীণগীতি বা পল্লীগীতিকে প্রতিষ্ঠা পেতে দেখি। এর ফলে শিক্ষিত সমাজ পল্লীগানের অনুরাগী হয়ে ওঠেন বিশেষভাবে।

আরো পড়ুন:  ভাটিয়ালি গান হচ্ছে বাংলাভাষী অঞ্চলের বাংলা লোকসংগীতের একটি জনপ্রিয় ধারা

তথ্যসূত্র:

১. সুধীর চক্রবর্তী; বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৬০০-৬০৩।
২. দিনেন্দ্র চৌধুরী, গ্রাম নগরের গান (১৮০০-২০০৫) লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০০৯, পৃষ্ঠা ১১৬-১১৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!