আধুনিক বাংলা গান আধুনিককালে প্রচারিত ও প্রসারিত বাংলা গানের এক বিশিষ্ট ধারা

আধুনিক বাংলা গান (ইংরেজি: Modern Bangla song) হচ্ছে আধুনিককালে প্রচারিত ও প্রসারিত বাংলা গানের একটি বিশিষ্ট ধারার সৃষ্টি। এর নাম থেকেই বোঝা যায় এটির জন্ম ও প্রসারের কাল হচ্ছে আধুনিক কাল। বাংলা গানের, যুপ থেকে যুগে অগ্রগতির ইতিহাসে, অনেকগুলি বিবর্তনের স্তর পেরিয়ে আধুনিক বাংলা গান তার স্বকীয়ত্ব ও প্রতিষ্ঠাভূমি পেয়েছে।

বাংলা গানের স্তর পরম্পরাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলা গানের আদি পবে ছিল চর্যাপদের গান, তারপর কীর্তন (খণ্ডকীর্তন ও পদাবলী কীতন)। তারপর শ্যামাসংগীত ও রামপ্রসাদী-মালসী জাতীয় গান, তারপর পাঁচালী-তর্জা-হাফ আখড়াই-টপ্পা-কবিগান-রামায়ণ গান- টপ কীতন যাত্রাপালার গান প্রভৃতি আঠারো আর উনিশ শতকের গানের পর্যায় পেরিয়ে বাংলা গান বিশ শতকের দ্বারপ্রান্তে এসে উপনীত হলো। তখন থেকে শুরু হলো বাংলা গানের নতুন পর্যায়। একদিকে প্রাচীন বাংলা গানের আদলে রচিত ধ্রুপদ ও খেয়াল-ভঙ্গিম নানা রাগাশ্রিত গান রচিত হতে লাগলো, অন্যদিকে পুরনো সুরের সঙ্গে নাগরিক জীবনধারালভ কিছু কিছু চটুল ও ‘জংলী সুরের আমেজ মিশিয়ে তৈরী হলো থিয়েটারের গান, কিন্তু সেটাই বাংলা গানের পরিবর্তনের একমাত্র চিহ্নিতব্য ধাপ নয়, তার চেয়েও অনেক বেশী বিশিষ্টতা জ্ঞাপক বড় রকমের পরিবর্তন ঘটলো অন্য কয়েক প্রকার অভিনব সুরসৃষ্টির মধ্যে। আধুনিক বাংলা গান এর অব্যবহিত পূৰ্বদৃষ্টান্ত রূপে এইসব অনবদ্য সংগীত রচনাকেই নির্দেশ করতে হয়।[১]

বলা বোধ করি প্রয়োজন যে, রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদ কাজী নজরুল রচিত গানই হলো ওই অনবদ্য সংগীত সম্পদ। এই অসামান্য সৃজনী-সাহিত্য-প্রতিভাবিশিষ্ট সরকার পঞ্চক যে কত দিক দিয়ে বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করে গেছেন তা বলে শেষ করা যায় না। বিশেষত এই ক্ষেত্রে রবীন্দ্রসংগীতের কোন তুলনা হয় না। অপর চার জনের গানও কম উল্লেখ্য নয়। সত্যিকথা বলতে গেলে, বাংলা গানের এই পাঁচ বিশিষ্ট সংগীতকাব্যের সম্মিলিত বাণী ও সুর সৃষ্টির সুসমৃদ্ধ ঐতিহই যাকে আজকের পরিভাষায় বলা হয় ‘আধুনিক বাংলা গান’ তার আর্বিভাব সম্ভব করে তুলেছে।

আগে থেকেই আমাদের সংগীতে কোরাস গান ছিল—রবীন্দ্রনাথ—দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদ নজরুল সফলেই কোরাস গান রচনা করে যৌথ বা বৃন্দ গানের জগতের বা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। অগণিত মানুষের বেদনাকে কথা দিয়েছে যৌথগান। কোরাস গান থেকে গণসংগীতের উত্তরণ জাগরণের দ্যোতক।

আরো পড়ুন:  ছিল চাঁদ মেঘের ওপারে, বিরহীর ব্যথা লয়ে বাঁশরীর সুর হয়ে, কে গো আজ ডাকিল তারে

আধুনিক বাংলা গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি আধুনিক বাংলা গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করতে চেয়েছে। বাংলা গান তাই হয়েছে কবিতার সমতুল্য। স্বাভাবিকভাবেই এই গানে এসেছে প্রকৃতি, প্রেম এবং রাজনীতি চেতনা।

আধুনিক বাংলা প্রকৃতিপ্রেমের গান

আধুনিক বাংলা গানে প্রকৃতি এসেছে দারুণভাবে। ফুল, পাখি চাঁদের ব্যবহার বাংলা গানে বাড়াবাড়ি রকম ব্যবহার করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম, এটি ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেনের চলচ্চিত্রে ফুল পাখি চাঁদ যেন গানের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ।

আধুনিক বাংলা প্রেমের গান

কালের হিসেবে ‘আধুনিক বাংলা গান’ নাম গ্রহণকারী সংগীতের জয়যাত্রা শুরু হয়েছে তিরিশের দশক থেকে। সেই গানগুলো মূলত আধুনিক বাংলা কবিতার সমান্তরাল হিসেবে আবির্ভূত হয়। বাংলা কবিতায় যেমন প্রেম প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, তেমনি বাংলা গানে আসে প্রেম অনুষঙ্গের জোয়ার। নজরুল সংগীত দেখা যাবে প্রেম, ভালোবাসা, ফুল, পাখি, চাঁদ, তুমি আমির আধিক্য। ফলে আধুনিক গান যেন হয়ে যায় নর নারীর প্রেমের সাথে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের চলচ্চিত্র বাংলা প্রেমের গানকে শিখরে তুলে দেয়।

ফুল পাখি চাঁদের বিকল্প খুজতে গিয়ে চল্লিশের দশক থেকে বিবিধ নূতন নূতন পরীক্ষা ও নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এ গান একটি সংহত রূপ লাভ করেছে। বাণীর দুর্বলতা, একঘেয়েমি আর রুচি বদলের তাগিদে গান রচনায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। বিশ শতকের চারের দশকের শেষ প্রান্ত থেকে গণনাট্য সংঘের সফল বিস্তার একদিকে যেমন বাংলা গানের সংস্কৃতিকে বহুমুখীতায় ব্যাপ্ত করেছে, অন্যদিকে বহু প্রতিভা বিকাশেও বিরাট ভূমিকা পালন করেছে।[২]

বিপ্লবী সংগীত, প্রতিবাদী গান এবং গণসংগীত

বিপ্লবী গান (ইংরেজি: Revolutionary songs) হচ্ছে এমন রাজনৈতিক গান যা বিপ্লবের পক্ষ অবলম্বন করে বা বিপ্লবের প্রশংসা করে। এগুলি মনোবল বাড়ানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রচার বা আন্দোলনের জন্য ব্যবহৃত হয়। সর্বাধিক পরিচিত বিপ্লবী গানের মধ্যে রয়েছে “লা মার্সেইয়েজ” এবং “আন্তর্জাতিক”। অনেক প্রতিবাদী গানকে বিপ্লবী হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে – বা পরবর্তীকালে একটি সফল বিপ্লবের পরে বিপ্লবী গান হিসাবে মহাত্যকৃত হতে পারে। অন্যদিকে, একবার বিপ্লব প্রতিষ্ঠিত হলে প্রতিবাদের গানের কিছু দিককে প্রতিবিপ্লবী হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। বিপ্লবী গানগুলি প্রচারণার একটি উল্লেখযোগ্য অঙ্গ।

আরো পড়ুন:  বাংলাদেশের সঙ্গীত পূর্ববঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের হাজার বছরের সংগীতের ধারা

মূল নিবন্ধ: বিপ্লবী গান হচ্ছে রাজনৈতিক গান যা বিপ্লবের পক্ষাবলম্বন ও বিপ্লবের প্রশংসা করে

গণসংগীত সুরের কলাকৌশলে বিশেষ আবদ্ধ নয়, কথা বা শব্দ বা বাণীই এর প্রধান দিক। বিশ শতকের চল্লিশের দশকে সংগীত রচনা আর সুর সংযজনার একটি সম্পূর্ণ নতুন ক্ষেত্রে পদক্ষেপ করেন কয়েকজন নবীন স্রষ্টা-সলিল চৌধুরী, পরেশ ধর, হেমাঙ্গ বিশ্বাস। এই তিন সুরকার বাংলা গানে গণ-সংগীতের পথিকৃৎ। নিপীড়িত-শোষিত শ্রেণীর অগণিত মানুষের বঞ্চনা-ক্ষোভ-বেদনাকে কথা ও সুরে অভিব্যক্তি দানকারী যে যৌথগান, গণসংগীত তার পথিকৃত্যের গৌরব শেষোক্ত তিনজনকেই দিতে হয়। কোরাস গান থেকে গণসংগীতের উত্তরণকে ভাবের দিক থেকে দেখতে গেলে বলতে হয় এই রূপান্তর জাতীয়তার অভীপ্সা থেকে সমাজতন্ত্রের অভীপ্সার অভিমুখী, মধ্যবিত্ত শ্রেণির দেশপ্রেমের আকুতিকে ছাপিয়ে সর্বহারা শ্রেণির জাগরণের দ্যোতক।[১]

গণসঙ্গীত জনপ্রিয় হলে আনন্দিত এবং আশান্বিত হবারও কথা, কিন্তু হওয়া যাচ্ছে না দুটি কারণে। এক : গণসঙ্গীতের মধ্যে ভেজাল ঢুকছে এবং দুই, গণসঙ্গীত শিল্পীদের আচরণে বৈপরীত্য। আমরা এখন এ ব্যাপারে স্থির নিশ্চিত যে গণসঙ্গীতের সঙ্গে অন্য সব সংগীত শ্রেণীর যে স্বাতন্ত্র্য তা শুধুই এর সংগ্রামী অস্তিত্বের জন্যই নয়, এর বাণী এবং সুরের সহজিয়া ভাবের জন্যও অর্থাৎ খেটে খাওয়া অশিক্ষিত-নিরক্ষর মানুষদের সঙ্গীত এটি। এখন দেখা যাচ্ছে খুব দ্রুত এক শ্রেণীর লােক এই সঙ্গীতের বাহক হয়ে উঠছেন—এদের অনেকেরই শ্রেণীসংগ্রামে বিশ্বাস নেই—এদের গানও সুতরাং কেমন একধরণের রােম্যান্টিক আবেদন সম্পন্ন।[৩]

প্রসঙ্গত একটা কথা বলি। আধুনিক বাংলা গানের প্রচারে চলচ্চিত্র, গ্রামোফোন কোম্পানী এবং রেডিও এই তিনটি মাধ্যম প্রভূত সহায়তা করেছে। বাংলা গানের অগ্রগতি ও উন্নতিতে এই তিন সংস্থার সহযোগী ভূমিকার উল্লেখ করলে ইতিহাসের বিচারে আলোচনায় খুঁত থেকে যাবে।

দশটি আধুনিক বাংলা গান ইউটিঊব থেকে শুনুন

আধুনিক বাংলা গানের গীতিকার

আধুনিক বাংলা গানের গীতিকার (Song-writer of modern Bangla songs) হচ্ছেন বাংলা অঞ্চলের সেসব লেখক যারা আধুনিক বাংলা গান লিখে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে বাংলার সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময়। আধুনিক বাংলা গানের আবির্ভাবের পূর্বে গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়াও অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় অনেক জনপ্রিয় গান লিখেছেন।

আরো পড়ুন:  আঁখি দুটি ঝরে হায় একা জেগে থাকি

মূল নিবন্ধ: আধুনিক বাংলা গানের গীতিকারদের তালিকা

চল্লিশের দশকে সংগীত রচনা আর সুর সংযজনার একটি সম্পূর্ণ নতুন ক্ষেত্রে পদক্ষেপ করেন কয়েকজন নবীন স্রষ্টা-সলিল চৌধুরী, পরেশ ধর, হেমাঙ্গ বিশ্বাস। এই তিন সুরকার বাংলা গানে গণ-সংগীতের পথিকৃৎ। এছাড়াও আধুনিক বাংলা গান লিখেছেন প্রায় শতাধিক সংগীত রচয়িতা।

তথ্যসূত্র

১. নারায়ণ চৌধুরী, চার দশকের বাংলা গান, অরুণ সেন ও গোপালকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সংকলিত, প্রকাশ ভারতী কলকাতা, মে ১৯৬০, পৃষ্ঠা-৫-৭।
২. দিনেন্দ্র চৌধুরী, গ্রাম নগরের গান (১৮০০-২০০৫) লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০০৯, পৃষ্ঠা ৯২-৯৩
৩. মানস মুখোপাধ্যায়, সংস্কৃতির বেলা অবেলা, প্রকাশক: চন্দনা ঘোষ, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬০, পৃষ্ঠা ১৩।

Leave a Comment

error: Content is protected !!