আধুনিক বাংলা গানের গীতিকার বাংলা ভাষায় গান লিখে ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন

আধুনিক বাংলা গানের গীতিকার (Song-writer of modern Bangla songs) হচ্ছেন বাংলা অঞ্চলের সেসব লেখক যারা আধুনিক বাংলা গান লিখে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে বাংলার সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময়। আধুনিক বাংলা গানের আবির্ভাবের পূর্বে গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়াও অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় অনেক জনপ্রিয় গান লিখেছেন।

চল্লিশের দশকে সংগীত রচনা আর সুর সংযজনার একটি সম্পূর্ণ নতুন ক্ষেত্রে পদক্ষেপ করেন কয়েকজন নবীন স্রষ্টা-সলিল চৌধুরী, পরেশ ধর, হেমাঙ্গ বিশ্বাস। এই তিন সুরকার বাংলা গানে গণ-সংগীতের পথিকৃৎ।

অবশ্য আগে আমাদের সংগীতে কোরাস গান ছিল। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ বা নজরুল সকলেই কোরাস গান রচনা করে যৌথ বা বৃন্দ গানের জগতের বা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিপীড়িত আর শোষিত শ্রেণীর অগণিত মানুষের বঞ্চনা-ক্ষোভ-বেদনাকে কথা ও সুরে অভিব্যক্তি দানকারী যে যৌথগান, গণসংগীত তার পথিকৃত্যের গৌরব শেষোক্ত তিনজনকেই দিতে হয়। কোরাস গান থেকে গণসংগীতের উত্তরণকে ভাবের দিক থেকে দেখতে গেলে বলতে হয় এই রূপান্তর জাতীয়তার অভীপ্সা থেকে সমাজতন্ত্রের অভীপ্সার অভিমুখী, মধ্যবিত্ত শ্রেণির দেশপ্রেমের আকুতিকে ছাপিয়ে সর্বহারা শ্রেণির জাগরণের দ্যোতক।

অবশ্য আগের গানের সঙ্গে এই নতুন কালের গানের একটা মস্ত পার্থক্য দেখা যায় এইখানে যে, কিছু-কিছু ব্যতিক্রম-দৃষ্টান্ত ছেড়ে দিলে, এ কালের বেশীর ভাগ গানেরই গীতিকার ও সুরকার দুই ভিন্ন ব্যক্তি। পূর্বযুগে এমন ছিল না। পূর্বযুগের গানে যিনি গীতরচয়িতা, তিনিই সুর রচয়িতা। বাণী ও সুরের এই অপাণী সমন্বয়ের আদর্শ কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত অবিচ্ছেদ চলে এসেছে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু নতুন কালে এসে এই ঐতিহ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। আজকের দিনের বহু প্রচলিত শ্রমবিভাজনের নীতি অনুযায়ী গান রচনা আর সুর রচনা দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। এর ফল ক্ষেত্রবিশেষ হয়ত শুভ হয়েছে কিন্তু সর্বক্ষেত্রে হিতকর হয়েছে এমন কথা বলতে পারি নে। বাংলা গানের রচনা মাত্রেই বাণী ও সুরের যুগ্নমূর্তি, এই যে ধারণা ও সংস্কার এতকাল গানের জগতে বিনাবাধায় গৃহীত হয়ে এসেছিল, তা একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে এই নতুন শ্রমবিভাজনের ফলে।

আরো পড়ুন:  শ্যামল গুপ্ত বাঙালি আধুনিক বাংলা রোমান্টিক গানের গীতিকার

সে যাই হোক, তিরিশ-চল্লিশের দশক থেকে রীতিই হয়ে দাড়িয়েছে এই রকম যে, যিনি গান বাঁধেন তিনি সুর দেন না, সুর যোগান অন্য লোক। এ কথা এখনকার কালের কয়েকজন প্রসিদ্ধ গীতিকার আর সুরকারের দৃষ্টান্ত নিলেই বুঝতে পারা যাবে। শৈলেন রায়, বাণীকুমার, সুবোধ পুরকায়স্থ, অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব রায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত প্রমুখরা হলেন মুখ্যত গীতিকার ; আর কৃষ্ণচন্দ্র দে, হিমাংশুকুমার দত্ত, রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজকুমার মল্লিক, শচীন দেববর্মণ, কমল দাশগুপ্ত, অনিল বাগচী, রবীন চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখােপাধ্যায়, নচিকেতা ঘােষ প্রমুখরা হলেন মুখ্যত সুরকার ও সঙ্গীতজ্ঞ। ব্যতিক্রম দৃষ্টান্তের কথা বলেছি। একাধারে গীতিকার ও সুরকার পর্যায়ের স্রষ্টার তালিকায় প্রথমেই নাম করতে হয় দিলীপকুমার রায়, তারপর একে একে এদের আগমন হয়—নির্মলচন্দ্র বড়াল, হীরেন বসু, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, গোপাল দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী, প্রবীর মজুমদার, সুধীন দাশগুপ্ত প্রমুখ। এদের ভিতর দিলীপকুমারের সৃষ্টির অজস্রতা মনে বিস্ময় জাগায়। দেশী বিদেশী দুই সূত্র থেকেই আহৃত নানা সুরের ঢঙ বাংলা গানে আরোপ করে তিনি আধুনিক বাংলা গানের সুরের ভাণ্ডারটিকে বিচিত্রভাবে ঐশ্বর্যময় করে তোলেন।

আধুনিক বাংলা গানের গীতিকারদের তালিকা

আধুনিক বাঙালি গীতিকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন অজয় ভট্টাচার্য, অজয় দাস, অঞ্জন কুণ্ড, অনল চট্টোপাধ্যায়, অনাদিকুমার দত্ত, অনিল ভট্টাচার্য, অবনী সাহা, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমল গুহঠাকুরতা, অমিতাভ নাহা, অমিয় চট্টোপাধ্যায়, অমিয়জীবন মুখোপাধ্যায়, অমিয় দাশগুপ্ত, অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ গুপ্ত, অরুণ সেন, অলক উকিল, আনন্দ মুখোপাধ্যায়, আভা দেব, কবিতা সিংহ, কমল ঘোষ, কবিশেখর কালিদাস রায়, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, কেষ্ট চক্রবর্তী, গিরিন চক্রবর্তী, গোপাল দাশগুপ্ত, গোপালকৃষ্ণ মুখখাপাধ্যায়, গোবিন্দ হালদার, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, জীবনময় গুহ, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, তপেন্দ্র দেব, তারক ঘোষ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী লাহিড়ী, দিনেশ দাস, দিলীপ সরকার, দিলীপকুমার রায়, দিনেন্দ্র চৌধুরী, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ননীগোপাল আইচ, নির্মলচন্দ্র বড়াল, নিশিকান্ত রায়চৌধুরী,  নীহাররঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, পবিত্র মিত্র, পরেশ ধর, পান্নালাল বসু, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রকাশকালী ঘোষাল, প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণব রায়, প্রতিমা গঙ্গোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার, প্রবোধ ঘোষ, প্রভাতকুমার গোস্বামী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, ফণীভূষণ ভট্টাচার্য, বনফুল, বরুণ বিশ্বাস, বাণীকুমার, বিনয় রায়, বিমলচন্দ্র ঘোষ, বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ভবেশ গুপ্ত, ভাস্কর বসু, মধু গুপ্ত, মনীশ ঘোষ, মনোজ বিশ্বাস, মন্টু সরকার, মিল্টু ঘোষ, মিহিরকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মীরা দেববর্মন, মুকুল দত্ত, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহিনী চৌধুরী, রঞ্জিৎ দে, রবি গুহমজুমদার, লক্ষ্মীকান্ত রায়, শক্তিকুমার সরকার, শঙ্কর বসু, শান্তিময় কারফরমা, শিবকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, শুদ্ধস্বত্ব বসু, শৈলশেখর মিত্র, শৈলেন চক্রবর্তী, শৈলেন রায়, শৈলেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, শ্যামল গুপ্ত, সজনীকান্ত দাস, সজনীকান্ত মতিলাল, সত্যেশ্বর মুখ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, সদানন্দ সিকদার, সরিৎ সেন শর্মা, সলিল চৌধুরী, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুখময় ভট্টাচার্য, সুখময় সেনগুপ্ত, সুধাংশু মল্লিক, সুধীন দাশগুপ্ত, সুধীন্দ্রনাথ মিত্র, সুনীলবরণ, সুবোধ পুরোকায়স্থ, সুহাস চৌধুরী, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, স্বামী সত্যানন্দ, হাসান ফকরী, হিমেন নস্কর, হীরেন বসু, হেমন্ত গুপ্ত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস এবং হেমেন্দ্রকুমার রায়। এই নামগুলিই আধুনিক বাংলা গানের গীতিকারদের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সংগ্রহ।

আরো পড়ুন:  ও জানি ভোমরা কেন কথা কয় না

আধুনিক বাংলা গানের কথাংশে রবীন্দ্রনাথের সর্বাতিশায়ী কবিত্বের প্রভাব আশির দশক পর্যন্তও বিশেষ লক্ষণীয় ছিল, তবে ইদানীন্তন কালের লেখা গানের বাণীতে এই প্রভাব ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসছে বলে মনে হয়। অনুকরণ তা সে যত বড় কবিরই হোক, স্বকীয়তার হানিকারক, সেই দিক দিয়ে নূতন গীতিকারদের কম বেশি মৌলিক হওয়ার চেষ্টাকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। তবে দেখতে হবে মৌলিকতা যেন উৎকেন্দ্রিকতায় পর্যবসিত না হয়। এবং গানের বাণী যেন কাব্যগুণ বর্জিত না হয়। সুরের দিক দিয়ে এখনকার বাংলা গান পূর্ব-প্রভাব সম্পূর্ণ অতিক্রম করে এসেছে, এ কথা সম্ভবত বিনা দ্বিধায় বলা যায়। অবশ্য এর ফল সবটাই ভাল হয়নি, বৈচিত্র্যের আকর্ষণে সুরের গঠনের ভিতর কখনও কখনও ভেজালের অনুপ্রবেশ বিসদৃশভাবে চোখে পড়ে। বিদেশী ‘পপ’ আর ‘রক অ্যাণ্ড রোল’ শ্রেণীর গানের সুর-ভঙ্গীর নির্বিচার প্রয়োগ সুরের বিশুদ্ধিকে বিনষ্ট করবার উপক্রম করেছে। সহগামী যন্ত্রসংগীতের কোলাহলটাও মাঝে মাঝে গানে কম উৎপাতের সৃষ্টি করছে না। সুরারোপ ও সুরপরিবেশনার এই সব অনুচিত প্রবণতা অবিলম্বে প্রতিরুদ্ধ হওয়া দরকার। বাংলা গানের সুরের একটা ধারাবাহিক ঐতিহ্য আছে। তনত্ব ও বৈচিত্র্যের অজুহাতে সেই ঐতিহকে বিকৃত করা কোন কাজের কথা নয়।

তথ্যসূত্র

১. নারায়ণ চৌধুরী, চার দশকের বাংলা গান, অরুণ সেন ও গোপালকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সংকলিত, প্রকাশ ভারতী কলকাতা, মে ১৯৬০, পৃষ্ঠা-৫-৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!