ভাটিয়ালি গান হচ্ছে বাংলাভাষী অঞ্চলের বাংলা লোকসংগীতের একটি জনপ্রিয় ধারা

বাংলাভাষী অঞ্চলে সারা পৃথিবীর ন্যায় লোকসংগীত খুব জনপ্রিয়। নদীবিধৌত বাংলাভাষী অঞ্চলের বাংলা লোকসংগীতের একটি জনপ্রিয় ধারা হচ্ছে ভাটিয়ালি বা ভাটিয়ালী গান (ইংরেজি: Bhatiali song)। ভাটির টানে নিজেকে ভাসিয়ে চলার আবেদন, ভাটিয়ালি গানে প্রমূর্ত। সেজন্য নদীমাতৃক বাংলাদেশ এ গানের জন্মভূমি। লেখক তপন রায় উল্লেখ করেছেন যে, ‘পূর্বাঞ্চল বা পূর্ববঙ্গের ধারাগুলোর মধ্যে মূল ধারাটি হলো ভাটিয়ালি'[১]।

ভাটিয়ালি একক সঙ্গীত। তালের ব্যাপার নেই। থেমে থেমে গাওয়া যায়, আবার একটানা গাওয়া হয়। ভাটিয়ালী গানের বিষয়বস্তু দর্শন সংক্রান্ত। সারি বা যুথবদ্ধ গানের পরিণতিই কিন্তু একক গানের সুর। জীবনের মধ্যে যতই জড়িয়ে পড়তে লাগল ততই সে একা হতে শুরু করল। এসে গেল গভীর তত্ত্ব।[২] 

নৈরাশ্য ও বিরহ বেদনা এ গানে ঝংকৃত হয়। বিরহ বেদনা ও নৈরাশ্য প্রণয়গত হতে পারে, আবার জীবনের সীমাবদ্ধক্ষেত্র বা অসম্পূর্ণতা থেকে যে আধ্যাত্মিকবোধ জাগ্রত হয়, তাকে আশ্রয় করেই বাণী ও সুরপ্রাপ্ত হয় এই ধরনের গানগুলি। মাঝি যখন নদীতে নৌকা ভাসিয়ে চলতে থাকে, তখন তার মনে এক উদাসী ভাব জাগ্রত হয়, তখন ভাটির টানে নৌকার দাঁড় বাওয়া ছেড়ে হাল ধরে বসে থাকার অবসর মুহূর্তে হৃদয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনের অব্যক্ত অনুভূতিগুলিকে উদ্ঘাটন করে। এই মুহূর্তের গানই হল ভাটিয়ালি গান। নদীর এক কূলে দাঁড়িয়ে যেমন অপর কূল দেখা যায় না, জীবনেরও তো তেমনি একটা কূলই দেখা যায়। তাই লোককবি গেয়ে ওঠেন:

নদীর কূল নাই কিনার নাইরে
আমি কোন কুল হৈতে কোন কুলে যাব কাহারে শুধাই রে।[৩] 

এই ধরনের গানে গায়কের অন্তর মথিত করে সুর উঠে আসে, তাই লোকসঙ্গীতের মধ্যে ভাটিয়ালির মত আন্তরিকতা খুব কম গানেই আছে। এই ধরনের গানের সুর প্রথমেই উচ্চগ্রামে আরম্ভ হয় এবং ধীরে ধীরে তা নেমে আসে। 

লোকসংগীতের গ্রামীণ সুর

লোকসংগীতের সুর গ্রামীণ। গ্রামীণ সুর শুনেই বোঝা যায় এটা ভাটিয়ালী, এটা ধামাইল, এটা বাইচ, এটা মেয়েদের গান। কেননা প্রতিটি সুরের কাঠামো আছে। এই সুরের কাঠামো কিন্তু তৈরি হয় এক একটা অঞ্চলের নিজস্ব ভৌগোলিক কারণে। একটা জলীয় জায়গা যদি থাকে যেখানে বারোমাস জল থাকে সেখানে সুরের গঠন এক রকমের। ঐ অঞ্চলের সাত রকমের গান থাকলেও সুর হবে ঐ একটা কাঠামোর উপর। শুধু বিষয়বস্তু পাল্টাবে তালে একটু হেরফের হবে। কিন্তু সুরের মূল কাঠামোটা থেকে যাচ্ছে।

আরো পড়ুন:  পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত লোকসমাজের সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোই লোকসমাজের সংস্কৃতি

পূর্ব বাংলা নদীমাতৃক। প্রচুর জল। সেখানে ভাটিয়ালী টানা সুর। কিন্তু যখন জল শুকিয়ে যায় তখন ঐ গান পাল্টে যায়। সুর টানা থাকে না। গানের ঢং পাল্টে যায়। গান গাওয়া হয় ছন্দে। কিন্তু সুরের কাঠামো ঠিক থাকে। শুধু গায়কী পাল্টে যায়। একটা ছিল টানা। যেই জলে চলে গেল, এসে গেল তাল। এলে গেল যন্ত্র। একে বলে ‘চালি’তে দিয়ে গান গাওয়া।

গ্রামের মানুষের ভাটিয়ালী সুরের কাঠামোতে তৈরি হয়েছে সারিগান, ধামাইল, বাইচ, মেয়েদের গান। সুরের পর্দা বিশ্লেষণ করলেই তা দেখা যায়। ধামাইল ত্রিমাত্রিক ছন্দে। মেয়েলি নাচ ঘুরে ঘুরে। ত্রিমাত্রিক ছন্দ বাইচেও আছে। বাইচে শারীরিক কসরত আছে। তার অ্যাকসেন্ট আলাদা কিন্তু পর্দা একই। ত্রিমাত্রিকে অ্যাকসেন্ট আলাদা বলে ওটা বাইচ। আবার নাচ, উচ্ছলতা বেশি বলে ওটা ধামাইল।

উত্তরবঙ্গে সমস্ত গানের সুর পাচ্ছি ভাওয়াইয়াতে। ভাটিয়ালী ও ভাওয়াইয়া গানের কাঠামোতে ব্যবহৃত পর্দা এক। দু ক্ষেত্রেই মুদারার ‘না’ কোমল বাকি সব পর্দা শুদ্ধ। তবে স্বরগুচ্ছ (Melodic Grouping) আলাদা। ভাওয়াইয়াতে মুদারার কোমল ‘না’ হচ্ছে উপরের পর্দা কদাচিৎ তারার ‘রা’ লাগে এবং খাদে উদারাতে পা পর্যন্ত নামে কিন্তু ভাটিয়ালীতে ওপরে তারাতে মধ্যম পর্যন্ত তো যায়ই বরং ক্ষেত্র বিশেষে আরও ওপরে পর্দার ব্যবহার দেখা যায় এবং উদারাতে খাদে ‘ধা’ হচ্ছে শেষ পর্দা। এ ছাড়াও আরও একটা পার্থক্য হলো, ভাটিয়ালীতে তান-এর ব্যবহার আছে, অলঙ্কার আছে প্রচুর। ভাওয়াইয়াতে অলঙ্কারের ধরন ভিন্ন এবং তান এর ব্যবহার কদাচিৎ।[৪]

ভাটিয়ালির চারটি ধারা

গ্রামীণ জনগণের সুরের বৈচিত্র্য খুব বেশী নয়। যেমন ভাটিয়ালী একটা সুরের কাঠামো। তার থেকেই তৈরি হচ্ছে। সারিগান, ধামাইল, বাইচ, মেয়েদের গান। সবগুলির সুরের কাঠামো কিন্তু ভাটিয়ালী।

আমরা এখানে বাংলা ভাষার মণিমুক্তা থেকে শ্রেষ্ঠ দশটি বাংলা ভাটিয়ালী গান নির্বাচন করেছি যেগুলো গত কয়েক শতাব্দী জুড়ে বাঙালিরা শুনে চলেছেন।  আপনারা গানগুলো শুনুন, আশা করি ভালো লাগবে।

আরো পড়ুন:  হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন উপমহাদেশের বাংলা গণসংগীতের জননন্দিত মহাযোদ্ধা

তথ্যসূত্র: 

১. তপন রায়, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৬০০-৬০৩।
২. খালেদ চৌধুরী, প্রেমেন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত, লৌকিক উদ্যান প্রসঙ্গ লোকসংগীত, স্বদেশচর্চা লোক সৃষ্টিসন্ধান, ইউবিআই, স্টাফ ওয়েলফেয়ার এন্ড কালচারাল সোসাইটি, কলকাতা, ১৯৯৮।
৩. মযহারুল ইসলাম, ফোকলোর: পরিচিতি ও পঠন-পাঠন, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ৬০।
৪. খালেদ চৌধুরী, পূর্বোক্ত।

Leave a Comment

error: Content is protected !!