১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগ (ইংরেজি: Partition of Bengal in 1947) ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ মিলে তিন গণশত্রুর পারস্পরিক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। এই ঘটনাটি যারা ঘটিয়েছিল তারা পরে প্রায় দশ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিলো এবং প্রায় তিন কোটি মানুষকে ভিটে মাটি ছাড়া করে সহায় সম্বলহীন করে পথে বসিয়েছিল। এই বিশাল গণহত্যাটির বিচার পরবর্তীকালে করা হয়নি, কারণ এই তিন গণশত্রুই ছিলো রাষ্ট্র ক্ষমতায়।
১৯৪৬ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বাংলা প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী । সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু বাংলা ভাগ চান নি। ওনারা ছিলেন, অখণ্ড বাংলার পক্ষে। সাথে ছিলেন আসামের আবুল হাশিম। কিন্তু ক্ষমতালিপ্সু শ্যামাপ্রসাদ, বৃটিশদের সাথে চক্রান্ত করে বাংলাভাগের পক্ষে রায় দেন। তবে ১৯৪৭ সালের ২০ জুনের ভোটটিকেই বাংলা ভাগের একমাত্র কারণ বলা অযৌক্তিক। বাংলা ভাগের আগেই অনেক ঘটনা বাংলা ভাগ অনিবার্য করে তুলেছিল। কিন্তু বাংলা ভাগের দায় এককভাবেই হিন্দু বা কমিউনিস্টদের নয়। বাংলা ভাগের জন্য দায়ী একটি রাষ্ট্র ব্রিটেন, দুটি সংগঠন কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ, দুটি জাতি মাড়োয়ারী-গুজরাটি, তিনটি শিল্পপতি গ্রুপ বাজাজ-টাটা-ইস্পাহানী।
বাংলা ভাগের চক্রান্তকারীরা
সাতচল্লিশে যে দেশভাগ হয়েছিল, সেই যে অত্যন্ত ক্ষতিকর ও একেবারেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা তার জন্য দায়ি ছিলো তিনটি পক্ষ। প্রথম দায়ী গণহত্যাকারী আর মানবজাতির শত্রু ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী। আর দায়ী অভ্যন্তরীণ গণশত্রু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ। দায়ী দু’পক্ষই, কম আর বেশি। উভয়েই ছিল অনমনীয়, ফলে ভাগ না হলে গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে এমন আশঙ্কা অমূলক ছিল না।
কিন্তু মূল অপরাধ ছিলো সেই ব্রিটিশেরই, অন্য কারো নয়। আসল ঘটনাটা তারাই ঘটিয়েছে, জাতীয়তাবাদী দু’পক্ষকে এমনভাবে ক্রমাগত উস্কানি দিয়েছে যে ওই দু’পক্ষ পরস্পরের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে এবং দেশ ভাগ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। সংগে এসেছে বাংলা ভাগ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন,
সাম্রাজ্যবাদের সেই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ নীতি, ভাগ করো এবং শোষণ করো, সেটা ভারতভাগের ক্ষেত্রে মোটেই অসত্য ছিল না; ছিল পুরোপুরি সত্য। কখনো তারা হিন্দুদের দিকে ঝোঁকার ভঙ্গি করেছে, কখনো মুসলমানদের দিকে; কিন্তু ভেতরে একেবারেই অনড় ছিল নিজেদের স্বার্থ-উদ্ধারের অবস্থানে। ভাগ করার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পরিবর্তে ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস দিয়ে আপাতত বিদায় নিয়েছে, কিন্তু ক্ষমতা যেটুকু দেবার তা তুলে দিয়ে গেছে দুই দিকের দুই তাঁবেদার শাসক শ্রেণির হাতে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি, সংহতি, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, পৃষ্ঠা ২৮২
আর অন্যদিকে বাংলা ভাগে ষড়যন্ত্র করে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান নরপিশাচ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। সে সারা জীবন ব্রিটিশদের হয়ে ষড়যন্ত্র করে গেছে, এটাই তার আসল পরিচয়। বাবা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নাম এবং রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে। উপাচার্য পদে থাকাকালীন, সে ‘ডি লিট’ উপাধির জন্য নিজের নাম প্রস্তাব করেন বৃটিশ প্রভুদের কাছে এবং তা অর্জন করেন।
ভারতীয় কংগ্রেস ছিলো ভারতের জনগণের শত্রু সাম্প্রদায়িক সংগঠন । সেই জাতীয় কংগ্রেস ছিল এমনই একটা সংগঠন, যেখানে মুসলিম লিগের মতো আরএসএস, হিন্দু মহাসভার মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের লোকেরাও সদস্য ছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু বিশ্বাস করতেন, এইসব সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালালি করে, ভারতীয়দের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে, যা স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে ক্ষতিকর ছিলো।
ভারতশত্রু কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত ১৯৩৫-এর ভারতশাসন আইনের সংশোধনের ভিত্তিতেই ‘স্বাধীন হতে সম্মত হলো, এবং রয়ে গেলো ব্রিটিশ কমনওয়েলথের ভেতরই। অপর দিকে মুসলিম লীগ তো স্বাধীনতা নিয়ে তেমন মাথাই ঘামায় নি, তাদের কথা ছিল যে কোনো ভিত্তিতেই হোক পাকিস্তান’ চাই; যে জন্য ডমিনিয়ন স্ট্যাটাসে তাদের কোনো আপত্তি থাকার কথা ছিল না, আপত্তি থাকেও নি। পরস্পরের ঘোরতর শত্রু কংগ্রেস ও লীগ শেষ পর্যন্ত ওই একটি ব্যাপারেই দেখা গেলো একমত হতে পেরেছে, সেটা হলো দেশভাগ ও বাংলা ভাগে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।