পশ্চিমবাংলা বা পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীত (ইংরেজি: Folk music of West Bengal) হচ্ছে প্রধান তিনটি ধারার প্রায় কুড়ির অধিক ধরনের লোকসংগীত। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে মুখে মুখে প্রচলিত ও সমাজে নিজস্ব ধারার স্বীকৃত গানগুলিই পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীত নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীতের রূপ ও বিষয়গত বৈচিত্র্য এই সংগীতকে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ডান করেছে। প্রধানত দেশের প্রত্যক্ষ প্রকৃতিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে এই পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা লোকসঙ্গীতের সুর-বৈচিত্র্য।
ভাটিয়ালি, বাউল ও ঝুমুর গানের বিভিন্ন উপধারা নিয়ে গড়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীত। এদের মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলের লোকসংগীতের ধারাগুলোর মধ্যে মূল ধারাটি হলো ঝুমুর। তাছাড়াও পশ্চিমাঞ্চলের সব ধারার গানের মধ্যে আমরা খুঁজে পাই ঝুমুর সুরের একটা নিজস্বতা।
সাধারণত লোকসংস্কৃতির একটা প্রধান অংশ হচ্ছে লোকসংগীত। লোকজীবনের নানা বস্তুগত, ভাষাগত, প্রদর্শনমূলক বা অভিকরণযোগ্য সংস্কৃতি বস্তুগুলির প্রধানতম দিক হলো লোকসংগীত। লোকজীবনের অন্যান্য বস্তুর মতো লোকসংগীত রচনা ও সৃষ্টি নিশ্চিত ভাবেই লোকচিত্তে আনন্দ বিধান বা সৌন্দর্যসৃষ্টির প্রেরণা থেকে জাত, কিন্তু কেবলমাত্র সৌন্দর্যসৃষ্টির জন্য লোকসংস্কৃতি বস্তু রচিত হয়নি, সেখানে কাজ করেছে আরও নানা প্রয়োজনীয়তা। বাংলার লোকসংগীতের বহু উপধারা থাকলেও, প্রধানত তিনটি ধারা লক্ষ্য করা যায় যথা ভাটিয়ালি, বাউল ও ঝুমুর।
পশ্চিমবঙ্গের বাংলা লোকগানের ধারা উপধারা
নিরক্ষর গ্রামবাসীর মন তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বার মাসে তেরো পার্বণের মধ্যেই প্রধানত বেঁচে রয়েছে সেই সংস্কৃতিগত ঐতিহ্য ও বাংলা লোকসংগীতের বহু উপধারা। এসব গানের মধ্য দিয়ে সহজিয়া মনের ভাবটিই বিশেষভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। নিম্নে বাংলা লোকগানের ধারা উপধারা উল্লেখ করা হলো:
কবি, তরজা, পাঁচালী, সাঁওতালী গান, ঝুমুর, পটুয়া, বারোমাস্যা, গম্ভীরা, ভাদু, টুসু, ভাওয়াইয়া, গাজন, সত্যপীর ও মানিকপীরের গান, গাজীর গান, ছাদ পেটানোর গান, তুষ-তুষালীর গান, ময়নামতী ও গোপীচন্দ্রের গান, বাউল, আলকাপ, বনবিবি, বোলান, পুতুল নাচের গান, রাঢ়ের বাউল, কুর্মি গান, হাপু গান, খন গান, ছড়া গান, বোলান, পটের গান, জারি গান, এই অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিয়ের গান, মুসলিম বিয়ের গান, মেয়েলী গীত ইত্যাদি।
বাঙালী তার দুঃসহতম জীবনযাত্রার শত দুঃখ-কষ্টর মধ্যেও, জীবনের সৌন্দর্য অব্যাহত রেখেছে তার এই সহজ মনের গান দিয়ে। লোকসংস্কৃতি বিশ্বজনীন না হলেও একটি চিরায়ত ধারণা, যা কোন একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষের চিন্তাধারা, জীবন-জীবিকা, সমাজ ব্যাবস্থা প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। লোকসংস্কৃতির বিবর্তনের ধারা নানাভাবে পরিবর্তিত। ফলে কোথাও সমৃদ্ধিশালী, কোথাও আবার লুপ্তপ্রায়।
বস্তুতপক্ষে কোন একটি জেলার, লোকসংস্কৃতির প্রকৃত রূপরেখা কেবলমাত্র সেই জেলার ভৌগোলিক বৃত্তের উপর প্রস্তুত করা যায় না, সমগ্র রাজ্যের ক্ষেত্রে সেই লোকসংস্কৃতির একটা প্রভাব চারিদিক বিস্তৃতির আকার আমরা দেখতে পাই, কারণ লোকায়ত জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতির পরিমন্ডল একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডের চৌহিদ্দের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না।
লোকসংগীতের অন্তর্জগতে আছে প্রবাহমানতা, নিরন্তর গতিময়তা, সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস। মানভূম হলো লোকসংগীতের খনি। মানভূমির মাটিতে কান পাতলে শোনা যায় অজস্র লোকগান। টুসু, ভাদু, ঝুমুরগান এখানকার জনজীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। অগনিত লোকশিল্পী সৃষ্ট সুধায় সিক্ত এই মানভূমের মাটি। মানভূম, বীরভূম, সিংভূম হলো লোকসংগীতের একসূত্রে বাঁধা এক ভূমি। পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীতের মধ্যে যে,গুলি বিভিন্ন জেলায় এখনও প্রচলিত শুধু সেগুলি নিয়ে গবেষণার কাজ অগ্রসর হয়েছে।
পশ্চিমবাংলায় লোকশিক্ষার জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান
পশ্চিমবাংলায় লোকশিক্ষার জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে, যেমন রাষ্ট্রীয় সাক্ষরতা মিশন, রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য মিশন, পরিবার-শিশু-নারী কল্যাণ দপ্তর,স্বচ্ছ ভারত, নির্মল গ্রামযোজনা, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক, লোকরঞ্জন শালা, লোকশিল্পী দল প্রভৃতি। রাজ্য স্তরে, জেলা স্তরে, মহকুমা স্তরে এমন কি ব্লক স্তরেও লোকশিক্ষার জন্য সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা, বিভিন্ন লোকশিল্পীর দ্বারা বিভিন্নভাবে লোকশিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা, বিভিন্ন ক্লাব, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে লোকশিক্ষার ব্যবস্থা করে। বিজ্ঞান-জাঠা, বিভিন্ন পথ নাটিকা, লোকগান, মূকাভিনয় প্রভৃতির দ্বারা লোকশিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে। এছাড়া পোলিও, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি নিবারনের জন্য ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সরকারী ও বেসরকারী ভাবে, লোকসংগীতের সাথে সাথে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাহায্য নেওয়া হয়। বর্তমানে পশ্চিমবাংলায় প্রতিটি জেলায় লোকশিল্পীদের নথি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সমাজে নানা স্তরে সমাজসচেতনতা, স্বাস্থ্যসচেতনতা, পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এবং কুসংস্কার দূরীভূত করার জন্য, প্রয়োজন মতো ঐ সমস্ত শিল্পীদের কাজে লাগানো হচ্ছে। তাঁরা কখনো মঞ্চে মঞ্চে, কখনো পথে পথে ঘুরে, জনমানসে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে চলেছে। কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে লোকশিল্পীদের ভাতার ব্যবস্থাও আছে।
পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীত প্রচার ও প্রসারের জন্য সংস্থাসমূহ
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন লোকসংগীত বর্তমানে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার, লোকসংগীতের প্রচার ও প্রসারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। সরকার নিজেদের উন্নয়নের প্রচার কাজে, বিভিন্ন লোকসংগীত শিল্পীদের যুক্ত করছে। জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা, জনসচেতনতা, কুসংস্কার দূরীকরন, পরিবার-শিশু-নারী কল্যাণ, পোলিও, জন্মনিয়ন্ত্রন প্রভৃতি বিষয়ের প্রচার কাজে, লোকসংগীতের সঙ্গে সঙ্গে লোকসংগীত শিল্পীদের কদর অনেক বেড়েছে। লোকসংগীত শিল্পীদের উৎসাহিত করার জন্য তাদের ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে শিল্পীরা আমন্ত্রিত হচ্ছেন। বেতার ও দূরদর্শনে লোকসংগীতের অনুষ্ঠান অনেক বেড়ে গিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ক্লাব, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, বিভিন্ন সংগঠন, বছরের বিভিন্ন সময়ে লোকসংগীতের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন উৎসবে এখন লোকশিল্পীদের কদর আগের থেকে অনেক বেশি। সাধারণ মানুষের লোকসংগীত শোনার প্রবণতাও অনেক বেড়েছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।