বাংলাদেশের সঙ্গীত বা বাংলাদেশের গান (ইংরেজি: Music of Bangladesh) হচ্ছে পূর্ব বঙ্গ, দক্ষিণ বঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের মানুষের হাজার বছরের সংগীতের ধারা। উত্তর বাংলার ভাওয়াইয়া, পূর্ব বাংলার ভাটিয়ালি, দক্ষিণবাংলার সারি হচ্ছে এই অঞ্চলের আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল সংগীতের তিনটি প্রধান ধারা।
বাংলাদেশের মানুষের আনন্দ বেদনা, মিলন বিচ্ছেদ, উৎসব রিক্ততা, প্রেম বিদ্বেষ, ক্রোধ প্রশান্তি, আশা হতাশা ইত্যাদি যেসব গানে ফুটে ওঠে তাই হাজার বছরের বাংলাদেশের গান। দুঃখ বিষাদ ঔদাস্য শূন্যতা; কুণ্ঠা লজ্জা দ্বিধা; পুলক শিহরণ রোমাঞ্চ; ফুর্তি উচ্ছাস উল্লাস ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের গানে। বাংলা ভাষী অঞ্চলের মানুষের জীবনের সমস্ত অনুভূতিকে, সমস্ত অভিব্যক্তিকে শুধু প্রকাশ করেই তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের সংগীত।
রাগসংগীত, লোক সংগীত, লঘুসংগীত বা বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা গানে নান্দনিকতা ফুটে উঠেছে মানুষের চেষ্টায়। সৌন্দর্য পিপাসু বাংলা ভাষী জনগণের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশলগ্ন থেকেই এই গান নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে তার সুর আর কথার ডালি নিয়ে।
বাংলা গানের ইতিহাস
বিশ শতকে আধুনিক বাংলা কবিতার সাথে উদ্ভব ঘটে আধুনিক বাংলা গানের। স্নায়ুযুদ্ধ পূর্বকালীন বঙ্গ দেশে লিখিত ও চর্চিত গানের, যাকে কেতাবি ভাষায় বলা হয় আধুনিক বাংলা গান, নির্মাণ ও চর্চা শুরু হলে এবং কলের গানের ভূমিকায় বাংলাদেশের সব ধরনের গান পায় তার নির্মাণ ও সংরক্ষণের উপায়। সামন্ত যুগের বাংলা গান ভেঙ্গে চুরে বেরিয়ে আসে দুটি গানের ধারা। বিশ শতকের শুরুর দিকে পুরনো ধারাটি নাম পায় গ্রাম্য গীতি বা লোকসংগীত হিসেবে। নতুন ধারাটি এগিয়ে আসে আধুনিক বাংলা গান নামে।
বাংলাদেশে আধুনিক বাংলা গানের তিনটি ধারা পরিলক্ষিত হয়। এই তিনটি ধারা হচ্ছে বিপ্লবী গান, জীবনমুখী গান এবং পপ ও রক সংগীত তাদের গতি এখনো প্রবহমান রেখেছে।
বাংলাদেশের বিপ্লবী গানের ভেতরে আছে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের গান বা বাংলাদেশের মুক্তির গান। এছাড়াও এই ধারায় আছে বাংলাদেশের প্রতিবাদী গান এবং বাংলাদেশের গণসংগীত। মুক্তির গানসমূহকে বাংলাদেশের মানুষ দেশাত্মবোধক গান হিসেবেও সম্বোধন করে থাকেন। দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধক গানগুলো সাধারণত দেশকে মাতা হিসেবে কল্পনা করে দেশকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা এবং দেশের জন্য কাজ করার প্রেরণায় রচিত।
বাংলাদেশের ১৯৭০-৭১ সালের গণযুদ্ধের পর পাশ্চাত্য প্রভাবিত রক এন্ড রোল নির্ভর একটি ধারা প্রাবল্য লাভ করে। একে কেউ পপসংগীত, কেউ ব্যান্ড সংগীত ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করে থাকেন। একদিকে নতুন কিছু করার উদগ্র বাসনা অন্যদিকে স্বাধীনতার পর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান জনিত হতাশা এবং পাশাপাশি সেই হতাশাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির মানুষের তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত ও নেশাগ্রস্ত করার সচেতন অপপ্রয়াস; এমনি জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে পপ সংগীতের এই ধারাটির সূচনা। শুরু হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা আজম খান, ফিরোজ সাঁই, লাকি আকন্দ প্রমুখ শিল্পীদের হাত ধরে। এই পপ সংগীতের শুরুটা ছিল নিম্নমানের বাণী আশ্রয়ী চিৎকার দিয়ে। ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা’ গানটির কাব্যবিচার করতে যাওয়া নিরর্থক। কিন্তু এর জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশস্পর্শী। ‘ইস্কুল খুইলাছে রে মাওলা’ গানটি একটি ভাণ্ডারি ভাবাপন্ন গান, গিটার ও ড্রাম সহযোগে গায়নের কারণে এটি উদ্দাম জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। প্রারম্ভিক এলোমেলো অবস্থা কাটিয়ে এই ধারাটি পরবর্তিকালে ধীরে ধীরে সংহত হতে থাকে।[১]
একে একে রক অ্যান্ড রোল, কান্ট্রি, ল্যাটিন, স্প্যানিশ, ফ্লামিংগো, সালসা, সাম্বা, হিপ হপ, ব্লুজ, জ্যাজ প্রভৃতি বিভিন্ন পশ্চিমা সংগীতের প্রকরণ এই তরুণ সমাজের হাত ধরে বাংলা গানের ভুবনে এলোমেলো শিকড়হীনতাকে উদ্দাম ন্যাংটা করে ছেড়ে দেয়। এসবের এত্তা জঞ্জাল থেকেও বাছাই করে বিশ ত্রিশটি উল্লেখযগ্য গান আমরা পাবো যা কালজয়ী হতে প্রেছে।
তাছাড়া তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা এমন বহু কাব্যগুণ সম্পন্ন গান রচনা করেছেন যা বাংলা আধুনিক গানের ধারাকেও সমৃদ্ধ করেছে। সমকালীন বাংলা গানের জগতে আধুনিক ধারার একই পংক্তিতে পাশ্চাত্য প্রভাবিত ধারার গানও তার স্থান করে নিয়েছে।
তথ্যসূত্র
১. মাহমুদ সেলিম, সাপ্তাহিক একতা, তারিখহীন, ঢাকা, “সমকালীন বাংলা গান : প্রগতির প্রত্যাশা”; http://www.weeklyekota.net/?page=details&serial=6843।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।