বাংলাভাষী অঞ্চলে সারা পৃথিবীর ন্যায় লোকসংগীত খুব জনপ্রিয় এবং এসব সংগীতের ভেতর সারি গান একটি। নদনদী, হাওড়-বাওড় জলাভূমি সমভূমি বেষ্টিত মহান কৃষক ও শ্রমিকগণ কাজের মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। তাদের কাছে বাংলা লোকসংগীতের একটি জনপ্রিয় ধারা হচ্ছে সারি গান (ইংরেজি: Sari gaan)।
সারি গানে সুরের বৈচিত্র্য খুব বেশি লক্ষিত হয় না। এ গানগুলি অত্যন্ত আবেগধর্মী সমবেত সংগীত। সমবেতভাবে গাওয়া হয় বলে এগানের মূল আশ্রয় তাল বা রিদিম। এই গান তাল প্রধান বলেই এর মধ্যে ভাবের গভীরতার থেকে ছন্দের চঞ্চলতা বেশি লক্ষ্য করা যায়।
আরে ও কানাই, পার করে দে আমারে
১. “আরে ও কানাই, পার করে দে আমারে।
আজিকার মথুরার বিকি দান করিব তোমারে।।
তুমি তো সুন্দর কানাই, তোমার ভাঙ্গা না।
কোথায় রাখব দইয়ের পশরা; কোথায় রাখব পা।।
শুনে কানাই বলে তখন, শোন রসবতি;
শুনে কানাই বলে তখন, শোন রসবতি;
শুনে কানাই বলে তখন, শোন রসবতি;
আগা নায়ে রেখে দই মাঝখানেতে বস।
ফুটিক ফুটিক ফেল জল লজ্জায় কেন ভাস।।
গানটির আরেকটি ভাষ্য
তুমি তো সুন্দর কানাই, তোমার ভাঙ্গা নাও,
কোথায় রাখুম দই পসরা কোথায় রাখুম পাউ।।
শুনো রাধে বলি তোমায় শুনো ওমো’ রসবতী
নিশিকালে যাইবার তোমার হইলো কেন মতি।।
আগা নায়ে রাইখা দধি মাঝখানেতে বইসো
ফুটিক ফুটিক ফেলাও পানি লাজে কেন ভাইসো।
পার কইরা দাও পার কইরা দাও যামু আমি মথুরাতে
মথুরাতে বেচাকেনার সময় বইয়া যায়।।
তুমি তো সুন্দর কানাই গানটি ইউটিউবে শুনুন এবং আমাদের চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন
- আরে ও কানাই, পার করে দে আমারে
- ওরে ললিতে, এত রাত্তিরে বাঁশী বাজায় কে?
- কোন বনে বাজে বাঁশী রে, –
- কোথায় ফেলে গেলি এ-সব, ওমা দশভূজা
- হেইও, চল চল নাও হেইও।
- সোনার বান্ধাইল নাও পিতলের গুড়ারে
- আরে ওই, পশ্চিমেতে আঁধি উঠছে উড়ছে ঝড়ি ভাই,
- পাগল করিলু, বাঁশী রে, বাঁশ নয়, বাঁশালী নয় রে
- হো ঐ দেখ কে যায় রে
- সুন্দরী লো বাইর ওইয়া দেখ
- মা বলিয়া কোলে আয়রে
- আরে ওরে মাঝি বসে ভাবিস কি
- সোনা বন্ধুরে, পিরীত করা ছাড়্যা যাইও না
- ওহে নন্দ গেল বাথানে, যশোদা গেল জলে
- উজান মুখে চালাও পানসি দরিয়ার
ওরে ললিতে, এত রাত্তিরে বাঁশী বাজায় কে?
২. ওরে ললিতে
এত রাত্তিরে বাঁশী বাজায় কে?
তারে, ডাক দে।।
বাঁশীর সুরেতে রে হরে নিল প্রাণ।
আমি সীন্তার সিন্দর বাধা থুয়্যা
শোনব বাঁশীর গান।
বাঁশীর সুরেতে রে হরে নিল প্রাণ।
আমি আঙ্খের কাজল বাধা থুয়্যারে
শোনব বাঁশীর গান।
কোন বনে বাজে বাঁশী রে, –
৩. কোন বনে বাজে বাঁশী রে, –
বাঁশী রাধার পরাণ রে ঘরে রইতে দিল না ॥
তরলা বাঁশের বাঁশী তাতে সপ্ত ছেঁদা,
কদম্ব হিলানে বাঁশী বলে রাধা রাধা।।
বাওয়ার বাঁশী নয় রে কালিয়া নাগের বিষ।
বাঁশীর মধ্যা থাইক্যা নাগরে দেয় রে দারুণ শিষ।।
কোথায় ফেলে গেলি এ-সব, ওমা দশভূজা
৪. কোথায় ফেলে গেলি এ-সব, ওমা দশভূজা।
সোনার কমল ভাসিয়ে জলে আমার মা বুঝি চলিল কৈলাসে।
হাঁস মোষ দিয়ে মাগো কল্লেম তোর পুজা,
মাগো, কার বাড়ী গিয়েছিলে কে করেছে পুজা।।
হেইও, চল চল নাও হেইও।
৫. হেইও, চল চল নাও হেইও।
চল চল নাও চালাইয়া চল।
চল চল চল, ময়ূরপঙ্খী চল।।
চল চল উড়ান দিয়া চল।
চল চল বাইচ খেলাইয়্যা চল, হেইও।।
সোনার বান্ধাইল নাও পিতলের গুড়ারে
৬. সোনার বান্ধাইল নাও পিতলের গুড়ারে পিতলের গুড়া
ও….রঙ্গের ঘোড়া দৌড়াইয়া যাও।
…তাইরে নাইরে তাইরে নাইরে নাই …
আরে বন্ধুর দেশে যাইমু আমি বড় তাড়াহুড়া…
আরে হৈ হৈ হৈ হৈয়া
আরে ওই, পশ্চিমেতে আঁধি উঠছে উড়ছে ঝড়ি ভাই,
৭. আরে ওই,
পশ্চিমেতে আঁধি উঠছে উড়ছে ঝড়ি ভাই,
হুঁশিয়ারীতে চোট চেপে কসে ধরো হাল।
নোঙ্গর জলদি কোরে দরিয়ায় ঢাল।।
(কোরাস) হুরর হো, হুরর হো, হুরর হো, হো, হো হো।
সামাল সামাল পাল ছিড়িল, ঘটল কি জঞ্জাল।।
দরিয়ার পীর গাজীর বদর সবাই মুখে বল,
নোঙ্গর জলদি কোরে দরিয়ার ঢাল।।
(কোরাস)— হুরর হো, হুরর হো …………।
পাগল করিলু, বাঁশী রে, বাঁশ নয়, বাঁশালী নয় রে
৮. পাগল করিলু, বাঁশী রে, বাঁশ নয়, বাঁশালী নয় রে।
এ তরলার বাঁশের আগা।
এপার থেকে বাজাও বাঁশী রে, ঐ পার থেকে শুনি।
কেমনে হইব পার আমার কোলে যাদুমণি।।
হো ঐ দেখ কে যায় রে
৯. হো ঐ দেখ কে যায় রে ?
নিশান টাঙ্গাইয়া নাও বাইয়া রে
জিজ্ঞাস কইরা দেখ তারে কোন বা দেশী নাইয়া।
বাইছালী খেলাইয়া মধুর সুরে যায় গান গাইয়্যা রে ।।
সুন্দরী লো বাইর ওইয়া দেখ
১০. সুন্দরী লো বাইর ওইয়া দেখ
শ্যামের বাঁশী বাজাইয়া যায় কে?
অষ্ট আঙ্গুল বাঁশী না-রে মধ্যে মধ্যে ছেদা,
নাম ধরিয়া ডাকে বাঁশী কলঙ্কিনী রাধা।।
মরাল বাঁশের বাঁশী না-রে তরই বাঁশের আগা,
অবলা নারীর জানে দিল কত দাগা।।
মা বলিয়া কোলে আয়রে
১১. মা বলিয়া কোলে আয়রে।
মায়ের সমান আর আছে কেবা।।
সন্ন্যাসী না হইও রে নিমাই,
সন্ন্যাসী না হইও।
অভাগিনী শচীরাণীর মা বলে ডাইকিও৷৷
ঘরে আছে বিষ্টপিয়া একবার ফিরা চাও।
কাঞ্চা বয়সের সোনার নারী কারে দিয়া যাও।।
আরে ওরে মাঝি বসে ভাবিস কি
১২. আরে ওরে মাঝি বসে ভাবিস কি ?
ধান দূর্বা লয়ে হাতে দাঁড়ায়ে আছে ঝি ।।
ভাল দূর্বে চিনি রামসায়রের ধারে।
তারাদেবী রাণীর মেয়ে দাঁড়ায়ে পথের ধারে।।
দশভূজা করে পূজা প্রসাদ লয়ে হাতে।
দশমীর আরতি দিতে দাঁড়ায়ে আছে পথে।।
সোনা বন্ধুরে, পিরীত করা ছাড়্যা যাইও না
১৩. সোনা বন্ধুরে, পিরীত করা ছাড়্যা যাইওনা।
পিরীত কর্যা ছাড়্যা গেলে দেহে পরাণ থাকবে না।।
পিরীত রতন, পিরীত যতন, পিরীত গলার হার,
পিরীত করা যে জন মরছে সফল জীবন তার।।
পিরীত রতন, পিরীত যতন, পিরীত বড় লেটা,
ছাড়াইলে ছাড়ানি যায় না টেংরা মাছের কাঁটা।।
ওহে নন্দ গেল বাথানে, যশোদা গেল জলে
১৪. ওহে নন্দ গেল বাথানে, যশোদা গেল জলে,
খালি ঘর পায়া কিষ্ট ননী চুরি করে।
ওহে ঘরে ঘরে বেড়ায় কিষ্ট ননী নাহি পায়।
ছিকায়ে নবনী ভাণ্ডে দেখিবারে পায়।।
ওহে ছেদন ছিড়িয়া কিষ্ট সকল ননী খায়,
ওহে হাতে নড়ি নন্দরাণী পিছে পিছে ধায়।
গোকুল ভুবনে কিষ্ট পলাইয়া যায়।
(কোরাস) ফলকে পরায় গলায়।।
উজান মুখে চালাও পানসি দরিয়ার
১৫. উজান মুখে চালাও পানসি দরিয়ার।
ঈশান কোণে ম্যাঘ উইঠ্যাছে।।
লাওয়ের বাদাম নিলে তায়।
টলমল ছলছল আগে চল, আগে চল।।
বাউরি বাতাস লাগে আইস্যা
কালাপানির গায় –
ঢেউয়ের মুখে হালের দড়ি
ছিড়ল বুঝি হায়।।
গুরুর নামে সিন্নি দিব
রসুল পীরের দরগায়।।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।