বিশ শতকে সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ ও শ্রেণি সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ইউরোপে থাকলো না। সমাজতন্ত্রের ময়দান দখল করলো এশিয়া, লাতিন আমেরিকা আর আফ্রিকার মানুষ। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ নিয়ে কিন্তু আলোচনার টেবিল, গবেষণা, বাকোয়াজি কম করেনি ইউরোপ। কিন্তু ইউরোপের এতো এতো সাম্যবাদি, সমাজতান্ত্রিক ও বামপন্থি পার্টিগুলো কোনোদিনই বিপ্লবের পথে যেতে পারেনি তার কারণ ওই পার্টিগুলো মার্কসবাদ-লেনিনবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আরো পড়ুন
সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশসমুহ দুনিয়া ও সাম্রাজ্যবাদি বিশ্ব একইসাথে শত শত বছর দিব্যি পাশাপাশি টিকে থাকবে তা হতে পারে না। ফলে এখন যদি আমরা কিউবা, উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনামকে সমাজতান্ত্রিক পথের অনুসারি বলি তবে সেই তিনটি দেশ কি টিকতে পারবে সাম্রাজ্যবাদের সাথে লড়াইয়ে_এ প্রশ্ন এক জরুরি প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আমাদের জন্য শুধু নয়, সমস্ত বিপ্লব-আকাঙ্খী মানুষেরই এই প্রশ্নের উত্তর বের করা দরকার।
আমরা জানি যে কোনো বস্তুই বিকশিত হয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে। ফলে সেই দেশগুলোতেও সমাজতান্ত্রিক বিকাশ ঘটতে পারে কেবল সেই দেশের জনগণ ও পার্টির অভ্যন্তরের শক্তির কারণে। সেই দেশ তিনটি টিকে থাকতে পারবে ততদিন যতদিন সেই দেশ তিনটির জনগণ ও পার্টি সমাজতন্ত্রের পক্ষে থাকবে।
এই মুহুর্তে অন্যান্য দেশের পার্টিগুলা বাম-আঙুল চুষবে, মৌজ করবে, উহ-আহ করবে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করবে সেই দেশ তিনটি সমাজতান্ত্রিক কী না, বিতর্ক করবে কোন নেতা সমাজতন্ত্রী আর কে জাতিয়তাবাদি; কিন্তু পার্টিগুলো বিপ্লব করবে না এবং সেই দেশগুলোকে সহায়তা করবে না তা হয় কী? একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ধারা থেকে বিচ্যুতিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক ছিলো; ভুয়া ক্রুশ্চেভকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-মস্করা চলেছে, এবং আমরা দেখেছি সোভিয়েত ইউনিয়ন হারিয়ে গেল মানচিত্র থেকে। তারপর ২২ বছর কেটে গেল, লাতিন আমেরিকা শুধু নড়াচড়া করছে, কিন্তু এশিয়া আফ্রিকার কোনো কমিউনিস্ট পার্টিই বুর্জোয়াদেরকে উৎখাত করে ক্ষমতা গ্রহণ করছে না, সর্বহারার একনায়কত্ব কায়েম করছে না নিজ দেশে। এরকম চলতে থাকলে কিউবা, উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনাম টিকে থাকতে পারে না। সেই তিনটি দেশের পার্টিগুলোও বুর্জোয়া নেতাদের দখলে চলে যেতে বাধ্য। যে ঘটনা আমরা চিন-সোভিয়েতসহ পুর্ব ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রে অতীতে দেখেছি; সেই ঘটনা ভিয়েতনামে ঘটে গেছে বলেই বিভিন্ন চিন্তাশিল ব্যক্তিরা বলছেন, উত্তর কোরিয়া ও কিউবায় বুর্জোয়াদের দ্বারা ক্ষমতা দখল যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে। ফলে সাম্রাজ্যবাদ বেঁচে থাকবে আর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও পাশপাশি বেঁচে থাকবে তা হয় না।
কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশের পার্টি যদি সাম্রাজ্যবাদের সাথে লড়াইয়ে হেরে যায় তবে সেজন্য শুধু সেই দেশের পার্টিটিকেই দায়ি করা চলে না। যদি কোনো পার্টির নেতৃত্ব সংশোধনবাদি ধারার দখলে চলে যায় তবে সেই পার্টির সংশোধনবাদি নেতারাই দায়ি এরকম একপেশে মন্তব্য সঠিক হতে পারে না। যে কোনো ঘটনাকে দ্বান্দ্বিকভাবে দেখাই একজন বিপ্লবীর দায়িত্ব এবং এই ঘটনা দুটোকে সেই দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। কোনো একটি দেশের একটি দলের নেতৃত্ব সংশোধনবাদিদের দখলে চলে যাবার জন্যে সেই দলের বাইরের প্রতিক্রিয়াশিল শক্তির এবং সাম্রাজ্যবাদি শক্তির প্ররোচনাও কাজ করে।
সারা দুনিয়ায় যেসব পার্টিগুলোর নেতৃত্ব সংশোধনবাদিদের হাতে চলে গেছে তার কারণ কী? এর উত্তর হলো প্রধানত সেসব দেশের পার্টিগুলোর ভেতরে সংশোধনবাদি ধারার শক্তি বেড়ে যাওয়ার কারণে এবং দ্বিতীয়ত সেসব দেশের অভ্যন্তরে প্রতিক্রিয়াশীলদের শক্তি বেড়ে যাবার কারণে এবং সাম্রাজ্যবাদি দেশগুলো অনবরত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ভেতরে বিরাজমান প্রতিক্রিয়াশিল গোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবার কারণে। এখানে আমরা আরো স্মরণ করতে পারি, ১৯৫৭ সালের নভেম্বরে মস্কোতে অনুষ্ঠিত ‘সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টিগুলোর প্রতিনিধিদের বৈঠকের ঘোষণায়’ সংশোধনবাদের উৎস সম্পর্কে দেয়া বক্তব্যের দিকে; সেখানে দেখানো হয়,
“সংশোধনবাদের অভ্যন্তরীণ উৎস হচ্ছে বুর্জোয়া প্রভাবের অস্তিত্ব, আর এর বহিস্থ উৎস হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদি চাপের কাছে আত্মসমর্পণ।”[১]
রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত বর্তমান ধারণা ইউরোপ যে আগ্রহ নিয়ে প্রায় বাতিল করেছে তা আফ্রিকা ও এশিয়াকে শোষণ করার জন্য; এটা হয়েছেই ইউরোপিয় কমিউনিস্টদের ব্যর্থতা এবং সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের কারণে। বাংলাদেশের এবং সমস্ত নিপীড়িত জাতিগুলোর জনগণের ভেতরে এই বিষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে যে তাদের দেশ স্বাধীন ও স্বার্বভৌম। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদি দেশসমূহকে বাঁচিয়ে রেখে কোনো দেশ স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারে না। এখন কমিউনিস্ট পার্টিগুলো সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই না চালিয়ে বিকশিত হতে পারবে না। আর এই লড়াই চালাতে পারে তারা কেবল নিজ দেশে সর্বহারার একনায়কত্ব কায়েম করে, সেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।
কিন্তু ইউরোপের সব কমিউনিস্ট পার্টিগুলো সর্বহারার একনায়কত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তথাকথিত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ফেরিওলা সেজেছিল। স্পেনের কমিউনিস্ট পার্টির সেনাবাহিনী ছিলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তারা যুদ্ধ না চালিয়ে বুর্জোয়াদের লেজুড় হলো, ইটালিতে ১৯৪৫-৯৪ সাল পর্যন্ত বিরোধি দল হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টি থাকলো, কিন্তু কোনো শ্রেণিসংগ্রামের লাইন বা গণলাইন গ্রহণ করলো না।
এটা হলো কেন? সংশোধনবাদী ও সুবিধাবাদীরা মনে করে, একটি দেশে পুঁজিবাদ উৎখাতের চেষ্টা করা বোকামো; তারা স্বপ্ন দেখেন একদিন শুভ্র সুন্দর সকালে সারা দুনিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবে এবং সাম্রাজ্যবাদ পাততাড়ি গুটিয়ে নেবে। তাদেরকে মাও সেতুং-এর মতো কওে বলাা যায়, আমরা একবারেই এক প্লেট ভাত খেতে পারি না, এক একবার এক-এক মুষ্টি নিয়েই এক প্লেট ভাত খেয়ে শেষ করতে হয়। আমরা এক মাইল পথ এক লাফে পাড়ি দিতে পারি না, একের পর এক পদক্ষেপ দিয়েই যেতে হয়। তেমনি কোনো একটি দেশে বিপ্লব শুরু করতে হবে। কোথাও না শুরু করলে বিপ্লব আরম্ভই হবে না, ফলে পৃথিবীতে কোনোদিনই সাম্যবাদ আসবে না। ফলে একটার পর একটা দেশে ক্রমান্বয়ে পুঁজিবাদ উৎখাত করেই সমাজতন্ত্র আনতে হবে। আমরা লেনিনের সেই উক্তিটি স্মরণ করলে বুঝবো যে, ‘জগতজুড়ে বিপ্লব শুরু না হলে অপেক্ষা করাই সমীচীন, একথা বলার অর্থ হলোথ সবাই জবুথবু হয়ে অনন্তকাল অপেক্ষাই করতে’[২] থাকা। যা নির্ঘাত বাজে কথা।
আর যেসব দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলো এককালে ক্ষমতায় ছিল সেসব দেশে পুনরায় ক্ষমতায় যেতে হবে। যেসব দেশে সংশোধনবাদিরা ক্ষমতায় রয়েছে সেসব দেশের সংশোধনবাদিদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে হবে। এজন্য সকল দেশের মার্কসবাদী-লেনিনবাদিদের উচিত হবে দৃঢ়তার সাথে সংশোধনবাদিদের মুখোশ উন্মোচন ও প্রতিরোধ করা এবং সেসব দেশের মেহনতি মানুষ ও জনগণকে সেই সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে সাহায্য করা। আমরা মনে রাখব সর্বহারার একনায়কত্ব কায়েম করার উদ্দেশে সমাজতন্ত্রের লড়াই না চালালে বিন্দুমাত্র এগোনো যাবে না। [৩]
তথ্যসূত্রঃ
১. সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টিগুলোর প্রতিনিধিদের মস্কো বৈঠকের ঘোষণা, ১৯৫৭, লেনিনবাদ দীর্ঘজীবী হোক, ইন্টারন্যশনাল পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ১২]
২. ভি. আই. লেনিন Collected Works, Vol.13 page-9
৩. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] রচিত ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ১৩১-১৩৬ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরেতে প্রকাশ করা হলো। প্রবন্ধটির রচনাকাল ৩০ অক্টোবর, ২০১২।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।