আমাদের দেশীয় লোকসংগীতের মধ্যে বাংলা লোকসংগীতের যতগুলো ধারা ও উপধারা (ইংরেজি: Bangla folk music genre) আছে সেগুলোকে মূলত চারটি অঞ্চলভেদে ভাগ করা যায়। যেমন-পূর্বাঞ্চল বা পূর্ববঙ্গ, উত্তরাঞ্চল বা উত্তরবঙ্গ, পশ্চিমাঞ্চল বা পশ্চিমবঙ্গ এবং দক্ষিণাঞ্চল বা দক্ষিণ বঙ্গের লোকসংগীত। এই চারটি ধারার প্রত্যেকটি আবার বিভিন্ন উপধারায় বিভক্ত।
পূর্বাঞ্চল বা পূর্ববঙ্গের ধারাগুলোর মধ্যে মূল ধারাটি হলো ভাটিয়ালি। তাছাড়াও সারি, জারি, ধামাইল, বিয়ের গান, মাইজভাণ্ডারী, মুর্শিদি, মারফতি, মালসী খাটু, গোষ্ঠের গান, কুঞ্জভঙ্গ, প্রভাতী, গীতিকা, পালাগান, আগমনী, বিজয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে পূর্ববঙ্গের সব গানের মধ্যে যে সুর মূলত আমরা পাই তা হলো ভাটিয়ালি সুর।[১]
উত্তরাঞ্চল বা উত্তরবঙ্গের ধারাগুলোর প্রধান ধারাটি ভাওয়াইয়া। এছাড়াও এই অঞ্চলে আমরা পাই—চটকা, ক্ষিরোল, দীঘলনাশা, পালাগান, জাগগান, মনসার গান, রাজবংশী সম্প্রদায়ের নিজস্ব কিছু আচার অনুষ্ঠানমূলক গান ইত্যাদি। তবে পূর্ববঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের গানের মধ্যে সুরগত তেমন তফাৎ আমরা পাই না। উত্তরবঙ্গেও ভাটিয়ালি সুরের প্রচলন অনস্বীকার্য। এই অঞ্চলের গান সুরের আকুতি ফুটিয়ে তোলার জন্য ভাটিয়ালির মতো উচ্চগ্রামে গাওয়া হয় না। ভাটিয়ালিতে ব্যবহৃত খাম্বাজ রাগের ব্যবহার এই অঞ্চলের গানে আমরা দেখতে পাই কিন্তু তা কোমল নিষাদ স্বরটি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। তাই এই অঞ্চলের অধিকাংশ গান মধ্যমকে জান করে বা মধ্যমকে সা’ করে পরিবেশন করা হয়ে থাকে—কথা ও সুরের আকুতিকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য। তাই উত্তরাঞ্চলের গানে মাঝ খাম্বাজের ব্যবহার লক্ষণীয়।
পশ্চিমাঞ্চল বা পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীতের ধারাগুলোর মধ্যে মূল ধারাটি হল ঝুমুর। তাছাড়াও ভাদু, টুসু, রাঢ়ের বাউল, কুর্মি গান, হাপু গান, খন গান, ছড়া গান, এই অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিয়ের গান, মুসলিম বিয়ের গান ইত্যাদি ইত্যাদি। এই অঞ্চলের সব ধারার গানের মধ্যে আমরা খুঁজে পাই ঝুমুর সুরের একটা নিজস্বতা।
দক্ষিণাঞ্চল বা দক্ষিণবঙ্গের ধারাগুলোর মধ্যে মূলধারাটি—সারি গান ও বনবিবির গান। এছাড়াও দক্ষিণ রায়ের গান, দাশু রায়ের গান, অষ্টক গান, দুখে কাহিনী, দক্ষিণবঙ্গের ভাটিয়ালি গান ইত্যাদি ইত্যাদি। এই অঞ্চলের গানের কথার মধ্যে অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য থাকলেও সুরের কোনো নিজস্বতা আমরা পাই না। এই অঞ্চলের সব গানের সুরের মধ্যে আমরা পূর্ববঙ্গের ভাটিয়ালি সুরের সরাসরি প্রভাব বেশি লক্ষ করতে পারি। মাঝে মাঝে পশ্চিমাঞ্চলের সুরও আশ্রয় নিয়েছে।
বাংলা লোকসংগীতের বিষয়ভিত্তিক ধারা
বাংলা লােকসঙ্গীতের বিপুল বৈচিত্র্য বাস্তবিকই আমাদের আশ্চর্যান্বিত ও বিস্মিত করে। বাঙালি জীবনের এমন কোনো পর্যায় নেই, যা এইসব সঙ্গীতে ধরা পড়েনি। বাংলা দেশের অঞ্চলভিত্তিক গানের আলোচনাকে বৈশিষ্ট্য ও ভাব বিষয় অনুসারে একত্রিত করলে যে ভাগ ও উপবিভাগগুলি পাওয়া যায় তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১. প্রভাতী: নামগান ও টহল গীত ২. ব্রত গীত: ননী চুরি, গোষ্ঠ-ফিরাগোষ্ঠ, কুঞ্জভঙ্গ, নিদ্রাভঙ্গ, নৌকাবিলাস ৩. ভাটিয়ালি : লৌকিক, দার্শনিক ৪. সারি : নৌকা বাইচ, খেদ-বিচ্ছেদ ৫. ঝুমুর : লৌকিক, দরবারি ৬. ভাদু ৭. টুসু ৮. জারি ৯. গীতিকার গান : মৈমনসিংহ গীতিকা, গুণাই বিবির পালা, দক্ষিণ রায়ের গান, বনবিবির পালা ১০. বারোমাইস্যা ১১. জীবিকা সংস্কার ১২. রঙ্গ ব্যঙ্গ ১৩. ঘুমপাড়ানি গান ১৪. মনসাভাসান : রয়ানি ১৫. শীতলামঙ্গল ১৬. গম্ভীরা: গাজন, আলকাপ ১৭. হােলি ১৮. জল ভরার গান ১৯. ধামাইল ২০. বিবাহ গীতি: হিন্দু রীতি, মুসলমান রীতি ২১. আগমনী-বিজয়া ২২. মালসি ২৩. বাউল-ফকিরি গান: তত্ত্বাশয়ী, দেহতত্ত্ব, মনঃশিক্ষা, চুয়া, আখেরি-চেতন, মুর্শিদী, মাইজভাণ্ডারি, মারফতি, ভাবগান ২৪. মেছেনির গান ২৫. ঝাপান ২৬. গারাম ঠাকুরের গান ২৭. পাঁচালী গান ২৮. কবিগান: তরজা ঢপ, ২৯. গাজির গান ৩০. রাখালিয়া গান ৩১. জাগ গান, ৩২. ভাওয়াইয়া: যাইটোল, কাতি পুজার গান, ছুবচনি, চটকা ৩৩. শ্রম সংগীত: ছাঁদ পেটার গান, ঢেঁকি ও যাতা ভানার গান, ধান ভানার গান ছাড়াও আরো অনেক উপবিভাগ।
তথ্যসূত্র
১. তপন রায়, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৬০০-৬০৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।