মানবতাবাদ বা মনুষ্যধর্ম শব্দের সমগোত্রীয় অর্থে ‘হিউম্যানিজম’-এর ব্যবহার প্রচলিত

অম্লান দাশগুপ্ত
প্রাবন্ধিক, গবেষক ও অধ্যাপক

হিউম্যানিজম নিয়ে আলোচনা করার প্রধান সমস্যা কথাটির বিভিন্ন অর্থের মধ্যে পার্থক্য করা। ইউরোপীয় নবজাগরণের সম্বন্ধে আলোচনার ক্ষেত্রে ‘হিউম্যানিজম’ যে অর্থে ব্যবহার করা হয়, তারই কিছু সূত্র ধরে এখানে আমরা আলোচনা করব। আরো নানাভাবে কথাটি প্রয়োগ করা হয়, কখনো সাধারণ এবং বিস্তৃতভাবে, কখনো খুব সীমিত বা পারিভাষিক অর্থে। ‘মানবতাবাদ’ বা ‘মনুষ্যধর্ম’ শব্দের সমগোত্রীয় অর্থে ‘হিউম্যানিজম’-এর ব্যবহার বহুপ্রচলিত। মানবজাতির সামাজিক কল্যাণ, তার সমষ্টিগত উন্নতিসাধন এবং সমস্যার সমাধানের প্রচেষ্টা এই ধারণার আওতাভুক্ত। এই ধরনের প্রয়োগ সাধারণভাবে স্বীকৃত, তাই ব্যাখ্যা করতে বিশেষ অসুবিধে হয় না। অন্যদিকে খ্রিষ্টীয় ধর্মচিন্তার পরিভাষায় ‘হিউম্যানিজম’-এর একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। যিশু খ্রিষ্টকে শুধুমাত্র মানুষরূপে কল্পনা করার রীতিকে এইভাবে নির্ধারণ করা হয়।

ইউরোপীয় নবজাগরণের যে কোনো আলোচনায় ‘হিউম্যানিজম’ স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে। কিন্তু এর মানে নিয়ে এখানেও নানারকম সমস্যা, বিশেষ করে সংজ্ঞা নির্ধারণের। রেনেসা-এর স্বরূপ নিয়ে যেমন অনেক মতবিরোধ, হিউম্যানিজম-এর প্রকৃত অর্থ নিয়েও বিভিন্ন মতবাদ। আলোচনার শুরু পল অস্কার ক্রিস্টেলর (Paul Oskar Kristeller) সমর্থিত একটি মত দিয়ে করা যায়। প্রাথমিকভাবে অন্তত ‘হিউম্যানিজমকে মানবতাবাদ’ ইত্যাদির প্রতিশব্দ না মনে করে এটিকে একটি বিশেষ শিক্ষার ধারার শীর্ষক বলে মনে করা যেতে পারে। জার্মান পণ্ডিত নিয়েটহামের (Niethamier) ১৮০৮ সালে ম্যানিজমুস’ (Humanissmus) কথাটি প্রয়ােগ করেন বিদ্যালয়ে গ্রিক ও লাতিন সাহিত্যের পঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে। প্রচলিত কারিগরি বা বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ্যক্রম থেকে এই শিক্ষা ভিন্ন। ক্রিস্টেলর মন্তব্য করেন যে যদিও ‘হুমানিমুস’-এর এই অর্থটি উনিশ শতকের গোড়ার থেকে পাওয়া যায়, ইউরোপীয় রেনেসাস-এর সময় থেকেই ধ্রুপদি শিক্ষার সঙ্গে জড়িত শিক্ষাবিদ এবং ছাত্রদের ‘হুমানিস্তা’ (Humanista) অথবা এইরকম অন্য কোনো নামে, অভিহিত করা হতো।

একটি বিশিষ্ট শিক্ষাক্রম এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘হিউম্যানিজম’-এর উৎপত্তি রোমান যুগে। সিসেরা (Cicero) এবং অন্যান্য লেখকদের মধ্যে ‘স্তুদিয়া হুমানিতাতিস্’ (Studia Humanitatis)-এর ব্যবহার পাওয়া যায়। এর আওতায় সাহিত্য, অলঙ্কারশাস্ত্র, ইতিহাস, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি পড়ত। এই অর্থের একটি ছায়া এখনও আমাদের ‘হিউম্যানিটিজ’ (Humanities) পাঠ্যক্রমের মধ্যে রয়ে গেছে। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে এই অর্থটি প্রাধান্য পায়। ইউরোপীয় মধ্যযুগের শিক্ষাব্যবস্থায় ঈশ্বরতত্ত্বের অনস্বীকার্য প্রাধান্য ছিল। তার থেকে ভিন্ন একটি শিক্ষার ধারা নির্ধারণ করার প্রচেষ্টা এই কথাটির ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত। তাই ইউরোপীয় রেনেসাস-এর আলোচনায় ‘হিউম্যানিজম’ একটি বিশিষ্ট পাঠ্যক্রম বা শিক্ষার ধারা, যার অন্তর্গত প্রধান। বিষয়গুলি ব্যাকরণ, ইতিহাস, অলঙ্কার, কাব্য, নীতিশাস্ত্র। এইগুলি অধ্যয়ন করা হতো প্রচলিত লাতিন (এবং কিছুক্ষেত্রে গ্রিক) লেখকদের প্রতি মনোনিবেশ করে। তাই ‘হিউম্যানিজম’-এর এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটি কোনো বিশেষ দার্শনিক ভাবধারা নয়: বরং এটিকে বলা যেতে পারে একটি সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা এবং শিক্ষার কর্মসূচি। ইউরোপীয় রেনেশাস-এর মতাদর্শের খোঁজ করতে গেলে ‘হিউম্যানিজম’-এর কথা সর্বাগ্রে বলতে হয়। নবজাগরণের বিশিষ্ট চিন্তাধারাগুলি, যেমন—প্লেটোবাদ, আরিস্ততলবাদ ইত্যাদি—বুঝতে গেলে ‘হিউম্যানিজম’-এর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রাচীন লেখকদের পুঁথি উদ্ধার, সেগুলি ছাপানোর ব্যবস্থা করা, তার সঠিক পাঠ নির্ধারণের চেষ্টা এবং সেগুলির পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা সাধারণভাবে হিউম্যানিস্ট পদ্ধতির কর্মক্ষেত্রের অন্তর্গত।

আরো পড়ুন:  নারী পুরুষ ও শ্রমবিভাগ

ব্রিস্টেলর এবং তার অনুগামীদের প্রবর্তিত এই ব্যাখ্যাকে বলা যেতে পারে হিউম্যানিজম-এর একটি আবশ্যিক ন্যূনতম রূপ। যদিও আমরা ‘হিউম্যানিস্ট’ বলতে বুঝি ফ্রাঞ্চেস্কো পেত্রাকের মতো কবিদের, অথবা ফ্লোরেন্স শহরে আচার্য কলুচ্চিও সালুতাতির মতো পণ্ডিত এবং সুলেখকদের। সেকালে যাদের হিউম্যানিস্ট আখ্যা দেওয়া হতো তারা বেশির ভাগ স্কুল কলেজে পড়াতেন, বা সরকারি দপ্তরে চাকরি করতেন, বা রাজা-রাজড়ার পরামর্শদাতা ছিলেন। এ সত্ত্বেও বলা যেতে পারে যে আরেকটু বিস্তৃতভাবে দেখলে ‘হিউম্যানিজম’-এর আরো কয়েকটি বিশেষত্ব চোখে পড়ে। দুটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমটি রাজনৈতিক । যে প্রাচীন লেখকদের হিউম্যানিস্টরা বিশেষভাবে সমাদর করতেন তাদের অন্যতম ছিলেন রোমান দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ সিসেরো। অনেকে মনে করেন যে নবজাগরণের ‘হিউম্যানিজম’-কে ‘সিসেরো-পন্থী ‘হিউম্যানিজম’ বললে ভুল হয় না। হিউম্যানিস্টদের চোখে সিসেরোর দার্শনিক সত্তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর প্রখর বাগ্মিতা এবং তাঁর রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ। তাই সিসেরো-র লেখা অধ্যায়ন করা তাঁর বাগ্মিতার উৎস খোঁজা এবং যথাসম্ভব সেটিকে আত্মস্থ করা। আগেই বলা হয়েছে যে অলঙ্কারশাস্ত্রের (rhetoric) স্থান হিউম্যানিস্ট পাঠ্যক্রমের শীর্ষে ছিল। মনে রাখতে হবে যে এই শাস্ত্র অধ্যয়নের এবং প্রয়োগের প্রধান ক্ষেত্র মনে করা হয়েছে রাজনীতি: বক্তৃতা করার সময় বক্তা কীভাবে ভাষার মাধ্যমে অন্যদের মনে প্রভাব ফেলতে পারে তারই বিচার এই শাস্ত্রের প্রধান লক্ষ্য। প্রাচীনকাল থেকেই বাগ্মিতার সঙ্গে নৈতিক সদগুণের নিবিড় সম্পর্ক কল্পনা করা হতো। রেনেশাস ‘হিউম্যানিজম’-এর চিন্তার ভাষার সঠিক ব্যবহার এবং তার মাধ্যমে নিজের এবং অপরের সামাজিক আদান-প্রদানের নিয়ন্ত্রণ-এর বিষয় গভীর মনোযোগ আমরা দেখতে পাই, এবং এখানে হিউম্যানিস্ট শিক্ষার সঠিক প্রয়োগ সম্ভব। পঞ্চদশ শতাব্দীর  গোড়ায় ফ্লোরেন্স শহরে ‘পৌর হিউম্যানিজম’-এর বিকাশের রূপটি দেখলে এই বিষয়টি বুঝতে সুবিধে হয়।

রেনেশাস ‘হিউম্যানিজম’-এর আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমে যেমন ‘মানবতাবাদ’-এর সাধারণ অর্থের সঙ্গে এর পার্থক্য স্থাপন করার দরকার হয়েছিল, শেষে আবার তেমনই একটি নতুন সম্পর্কের কথা বলা যেতে পারে। যে-শিক্ষার কথা হিউম্যানিস্টরা বলেছেন, তাঁদের চোখে এটি প্রকৃতপক্ষে মানুষ হবার শিক্ষা। এই তত্ত্বের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হিউম্যানিস্ট চিন্তায় মনুষ্যত্বের দুটি সূত্র দেখা দেয়। একটি মানুষের সঙ্গে মনুষ্যবর্গের নিম্নে যা তার পার্থক্য; অন্যটি মানুষের সঙ্গে মনুষ্যবর্গের ঊর্ধ্বে যা তার পার্থক্য। মানুষ হওয়া তাই যেমন একটি সদ্‌গুণ আবার এক ধরনের সীমাবদ্ধতাও বটে। এই দুটি সূত্র আমাদের ‘হিউম্যানিজম’-এর মানবতাবাদ—যা তার বিবিধ শিল্পকর্মে এবং সাহিত্যকর্মে প্রকাশিত—বুঝতে সাহায্য করে।

আরো পড়ুন:  সমাজতন্ত্রের বিকল্প হচ্ছে সমাজতন্ত্রই, অন্য কিছু বিকল্প হিসেবে প্রযোজ্য নয়

টিকা:

১. অম্লান দাশগুপ্ত লিখিত এই প্রবন্ধটি ‘হিউম্যানিজম’ শিরোনামে সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৬৮৮-৬৯০ পৃষ্ঠা থেকে সংকলিত। বর্তমান শিরোনামটি রোদ্দুরে ডট কমের নিয়মিত লেখক অনুপ সাদির দেয়া।

Leave a Comment

error: Content is protected !!