ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০
অনুবাদ – অনুপ সাদি
১. প্রশাসন বা সংগঠনের উচ্চস্তরে থেকে আমলাতান্ত্রিক নেতারা খুব অল্প জ্ঞান রাখে; তারা জনগণের মতামত বোঝে না; তারা অনুসন্ধান করে না এবং পড়ে না; তারা নির্দিষ্ট নীতিসমূহ গ্রহণ করে না; তারা রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত কাজ পরিচালনা করে না; তারা বাস্তবতা থেকে, জনগণ থেকে, পার্টি নেতৃত্ব থেকেও দূরে সরে থাকে; তারা সর্বদা নির্দেশনামা জারি করে এবং সেসব নির্দেশনামাগুলো সচরাচর ভুল; তারা দেশ ও জনগণকে নিশ্চিতভাবেই ভুলপথে নিয়ে যায়; এবং অবশেষে তারা পার্টির ধারাবাহিক অবিচল লাইন ও কর্মনীতিতে [policy] প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে; তারা জনগণের নাগাল পায় না।
২. তারা অহংকারী, অসহনীয়, এবং তারা রাজনীতি নিয়ে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে আলোচনা করে থাকে। তারা তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করে না, তারা আত্মগত এবং একদেশদর্শী; তারা অমনোযোগী; তারা জনগণের কথা শোনে না; তারা হিংস্র ও নির্বিচারী; তারা জোর করে নির্দেশ দেয়; তারা বাস্তবতা সম্বন্ধে মনোযোগী নয়; তারা অন্ধ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। এটাই হলো কর্তৃত্বমূলক আমলাতন্ত্র।
৩. তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ততার ভান করে থাকে, তারা সারা বছর কাজের মধ্যে থাকার ভাব ধরে; তারা জনগণকে নিরীক্ষা করে না এবং তারা বস্তুর তদন্ত করে না; তারা কর্মনীতিসমূহ পাঠ করে না, তারা জনগণের উপর নির্ভর করে না; তারা নিজেদের বিবৃতিসমূহ প্রস্তুত করে না; তারা নিজেদের কাজ নিয়েও পরিকল্পনা করে না। এটা মগজহীন, ভুলদিকে পরিচালিত আমলাতন্ত্র। অন্যভাবে বললে, এটি রুটিনবাদ [routinism]।
৪. তাদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব অপরিমেয়; তারা পথ ঠিক করতে পারে না; তারা স্বার্থপরায়ণ; তারা হম্বিতম্বি করে সবকিছু তুরি মেরে উড়িয়ে দেয়; তারা চোখ রাঙিয়ে জনগণকে সন্ত্রস্ত করে; ক্রমাগতভাবে তারা জনগনের প্রতি বিষোদগার করে; তাদের কাজের ধরণ রূঢ়; তারা জনগণকে সম মর্যাদা দেয় না। এটি জমিদারী আমলাতন্ত্র।
৫. তারা অজ্ঞ; তারা কোনো বিষয়ে জানার জন্য প্রশ্ন করতে লজ্জ্বাবোধ করে; তারা অতিরঞ্জিত করে এবং মিথ্যা বলে; তারা নিজেরা ভুলে ভরা কিন্তু তারা সে ভুলের দায় চাপায় জনগণের উপর; তারা সফলতার ভাগ নিজেদের উপর বসাতে আগ বাড়িয়ে থাকে; তারা কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে প্রতারণা করে; তারা তাদের উচ্চস্তরের নেতৃত্বকে ভুল তথ্য দিয়ে প্রতারণা করে এবং এবং তাদের অধস্তনদের বোকা বানায়; তারা তাদের ভুলভ্রান্তিকে গোপন করে এবং ভুলসমূহকে চাকচিক্যময় করে। এটাই অসাধু আমলাতন্ত্র।
৬. তারা রাজনীতি বোঝে না; তারা তাদের কাজও করে না; তারা কাজের ভার অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়; তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন করে না; তারা কুতার্কিক, তারা ওজর দেখিয়ে কাজকে সরিয়ে রাখে; তারা সংবেদনশূন্য; তারা নিজেদের উপর সতর্কতাহীন। এটাই দায়িত্বজ্ঞানহীন আমলাতন্ত্র।
৭. তারা বিভিন্ন ব্যাপারে অবহেলাকারী; তারা যতটুকু পারে ততটুকু ভোগসর্বস্ব; তাদের জনগণের সাথে কিছুই করার নেই; তারা সবসময় ভুলই করে থাকে; তারা উর্দ্ধতনের কাছে নিজেকে সম্মানীয় হিসেবে উপস্থাপিত করে এবং নিম্নস্তরের কাছে নিষ্কর্মায় পরিগণিত হয়; তারা নিজেদের সম্মানের বিষয়ে যত্নশীল; তারা আটকোনায় চলতে পারে এবং বাইম মাছের মতো পিচ্ছিল। এটা সেই ধরণের আমলাতান্ত্রিকতা যা কর্মকর্তার মতো কাজ করে কিন্তু কেবল জীবিকা নির্বাহ করে।
৮. তারা রাজনীতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শিখে না; তারা নিজেদের কাজকে এগিয়ে নেয় না; তাদের কথাবলার ধরণ কটু; তাদের নেতৃত্বের কোন দিকনির্দেশনা নেই; তারা বেতন গ্রহণের সময় তাদের অফিসের কর্তব্য উপেক্ষা করে; তারা লোকদেখানো কাজেই সিদ্ধহস্ত; তারা অলস জমিদারের মতো ঠাটবাট বজায় রাখে; তারা যে সকল কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে ও ধার্মিক, এবং কর্মকর্তার মতো কাজ করে না, তাদের সাথে বাজে আচরণ করে। এই ধরণের আমলাতান্ত্রিকতা হলো ফাঁকিবাজির ও মেধাশুন্য আমলাতান্ত্রিকতা।
৯. তারা নির্বোধ; তারা দ্বিধাগ্রস্ত; তাদের নিজস্ব চিন্তা বলে কিছু নেই; তারা পচা মনের; দিনশেষে তাদের বাগাড়ম্বরই সার; তারা শেষ পর্যন্ত নিজেদের জন্য গর্বিত এবং তারা একইসাথে অস্থিরচিত্তসম্পন্ন ও অজ্ঞ। এটা হলো নির্বোধ, অকর্মা আমলাতন্ত্র।
১০. তারা অন্যদের দিয়ে দলিল দস্তাবেজ পড়ায়; অন্যেরা পড়ে এবং তারা ঘুমায়; তারা জিনিসের দিকে না তাকিয়েই সমালোচনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে; তারা ভুলের সমালোচনা করে এবং জনগণকে দোষারোপ করে; ভুল থেকে উত্তরণের পথটি তারা খোঁজে না; তারা সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করে না, বরং সমস্যাকে উপেক্ষা করা; তারা তাদের উচ্চস্তরের নেতৃবৃন্দের মন যোগাতে ব্যস্ত থাকে; তারা তাদের অধস্তনদের কাছে নিজেকে বুঝদার হিসেবে জাহির করে; যখন তারা পেরে উঠে না তখন তাদের হিক্কা উঠতে থাকে; তারা তাদের সমপর্যায়ের সকলের সাথে তর্ক চালাতে থাকে। এটা অলস আমলাতন্ত্র।
১১. সরকারি অফিসে লটবহর বড় থেকে বড় হতে থাকে; কিন্তু ব্যাপারগুলাতে বিভ্রান্তি আরো বাড়ে; কাজের চেয়ে জনগণ বেশি হয়ে যায়; তারা চক্রের সাথে চলে; তারা ঝগড়া করে এবং অনর্থক আলোচনায় মেতে থাকে; জনগণ অধিক কিছু করতে অনিচ্ছুক থাকে কিন্তু তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন করে না। এটা সরকারী দপ্তরের আমলাতন্ত্র।
১২. দলিলাদির সংখ্যা অসংখ্য; লাল ফিতার দৌরাত্ব্য বাড়ে; নির্দেশাবলী প্রসারিত হয়; অনেক প্রতিবেদন অপঠিত থেকে যায় যেগুলো মূল্যায়ন করা হয় না; অনেক ছক কষা হতে থাকে, কাজের তালিকা বাড়তে থাকে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না; অনেক বৈঠকের পরে কোনো সিদ্ধান্তই গৃহীত হয় না; অনেক ঘনিষ্ঠ সংগঠন আছে কিন্তু কিছুই শেখা হয় না। এটাই লাল ফিতার ও আনুষ্ঠানিকতার আমলাতন্ত্র।
১৩. তারা আমোদ খোঁজে, কিন্তু কষ্ট করতে ভয় পায়; তারা সবসময় পেছন দরজা দিয়ে কাজ সারে; নিজে কর্মকর্তা হবার পরে পরিবারের সবাই সুবিধা পেতে থাকে; একজন নির্বান লাভ করলো তো তার সমস্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা স্বর্গ পর্যন্ত উঠে যায়; তাদের উদ্দেশ্যে ভোজসভা আর উপহার দেয়া হতেই থাকে… এটা ব্যতিক্রমীদের আমলাতন্ত্র।
১৪. যিনি যত উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, তিনি তত অসহিষ্ণুতা; তাকে সমর্থন দেবার জন্য তার চাহিদা উচ্চ থেকে উচ্চে যেতে থাকে; তার ঘরদোর ও আসবাবপত্রের বাহার ক্রমান্বয়ে বিলাসবহুল হতে থাকে; বিভিন্ন বিষয়ে তার এখতিয়ার বাড়তে থাকে; তারা উচ্চস্তরের আমলারা অধিক ভাগ পেতে থাকে কিন্তু নিচের স্তরকে তার মূল্য দিতে হয়; বিলাসিতা বাড়তে থাকে, আবর্জনাও বাড়তে থাকে। উপরে-নিচে-ডানে-বামে সবাই হাত তুলতে থাকে। এটা হলো বায়বীয় কর্মকর্তাদের আমলাতন্ত্র।
১৫. তারা অহংকারী; তারা সর্বজনীন উপকরণ দিয়ে ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি মেটায়; তারা কারচুপি, সন্দেহকে ঘনীভূত করে; তারা যত গিলতে পায়, তত বেশি চায়; এবং তারা পিছু হটে না বা দেয় না। এটা হলো অহংকারী আমলাতন্ত্র।
১৬. তারা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ও অর্থের ভাগ নিয়ে বিবাদ লাগায়, তারা পার্টির ভেতরে হাত বাড়ায়; তারা খ্যাতি ও সৌভাগ্য চায়, তারা পদ চায়, এবং তারা যদি তা না পায় তবে তারা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে; তাদের মেদ বাড়তে থাকে, কিন্তু তারা পাতলু হতে চায়; তারা বেতন ভাতাদির ব্যাপারে বেশ মনোযোগী থাকে; তারা তাদের সহযোদ্ধাদের সাথে উঞ্চ সম্পর্ক ধরে রাখে, কিন্তু জনগণকে তোয়াক্কা করে না। এটা হলো ক্ষমতা ও অর্থের ভাগ নিয়ে বিবাদে মত্ত থাকা আমলাতন্ত্র।
১৭. সংখ্যাভারাক্রান্ত নেতৃত্বমন্ডলী সুসসমন্বিতভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে জানে না; তারা সবাই যে যার মতো করে পথ দেখাতে থাকে এবং তাদের কাজ হযবরল হতে থাকে; নিজের কথাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে থাকে; উচ্চস্তর বিচ্ছিন্ন থাকে নিম্নস্তর থেকে এবং কেন্দ্রীকরণ থাকে না, গণতন্ত্রও থাকে না। এটা অনৈক্যের আমলাতন্ত্র।
১৮. কোনো সংগঠন নেই; তারা ব্যক্তিগত বন্ধুদের মনোনীত করে; এতে উপদলীয়বাদ সৃষ্টি হয়; তারা সামন্তীয় ধারার সম্পর্ক বজায় রেখে চলে; তারা ক্ষুদ্র কুচক্র সৃষ্টি করে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য, এবং তারা একে অপরকে রক্ষা করে, এতে সব কিছুর উপরে ব্যক্তিবাদিতা জাহির হয়; এই ক্ষুদে কর্মকর্তারা জনগণের ক্ষতি করে।। এটাই হলো চক্রপন্থী আমলাতন্ত্র।
১৯. তাদের বিপ্লবী আকাংখা দুর্বল; তাদের রাজনীতির পতন হয় এবং রাজনীতির চরিত্র বদলে যায়; তারা দেখায় যে তারা অনেক অনেক অভিজ্ঞ; তারা দায়িত্বপালনকে লাটে ওঠায়; তারা যা ভাবে তা প্রকাশ করে না এবং যা করে তা ভাবে না। তারা প্রতিদিন তাদের খাবার খায়; তারা অসুস্থ না হলেও ডাক্তার ডাকে; তারা পাহাড়ে, সাগর সৈকতে সময় কাটাতে যায়; তারা ভাসাভাসা ভাবে সবকিছু করে থাকে; তারা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়ে সবসময় উদ্বিগ্ন থাকে; কিন্তু তারা জাতীয় স্বার্থ নিয়ে চিন্তাই করে না। এটা হলো অধপতিত আমলাতন্ত্র।
২০. তারা খারাপ প্রবণতা পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে এবং প্রতিক্রিয়াশীলতাকে উস্কে দেয়; তারা মন্দ লোকদের সাথে সংযোগ রাখে এবং খারাপ অবস্থাকে লাই দিতে থাকে; তারা খলনায়কীতে জড়িত থাকে এবং আইন ভাঙতে থাকে; তারা সন্দেহজনক হতে থাকে; তারা পার্টি ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকি; তারা গণতন্ত্রকে পিষতে থাকে; তারা কোন্দল করে এবং প্রতিশোধ নেয়, আইন ও বিধি ভাঙতে থাকে; তারা মন্দকে রক্ষা করে; তারা শত্রু ও মিত্রের মধ্যে পার্থক্য করে না। এটাই ভ্রান্ত প্রবণতা ও প্রতিক্রিয়াশীল আমলাতন্ত্র।
উৎস: Joint Publications Research Service, (ওয়াশিংটন, ডিসি)
অনুবাদ করা হয়েছে মার্কসবাদী ডট অর্গের ইংরেজি লেখা থেকে। লিংক এখানে।
মাও সেতুং বা মাও সে তুং বা মাও জেদং (ইংরেজি: Mao Tse-Tung; ২৬ ডিসেম্বর ১৮৯৩ – ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ খ্রি.) মার্কসবাদী বিপ্লবী তাত্ত্বিক, সাম্যবাদী রাজনৈতিক নেতা, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং চীন ভূখন্ডের প্রায় শতাব্দীকালের সামাজিক রাজনীতিক মুক্তি ও বিপ্লবের নায়ক। জাপানি দখলদার শক্তি এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার কুওমিনটাং নেতা চিয়াং কাইশেকের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সামাজিক বিপ্লবের জন্য চীনের অগণিত এবং অনুন্নত কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার কৌশলী হিসেবে মাও সেতুং এক সময় সমগ্র পৃথিবীতে সংগ্রামী মানুষের অনুপ্রেরণাদায়ক উপকথায় পরিণত হয়েছিলেন। তিনি অনেক জটিল কথাকে জনগণের সামনে অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করতেন। জনগণের সেবায় মানবেতিহাসের সমস্ত জ্ঞানকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন।