নব্যধ্রুপদীবাদ বা নয়াধ্রুপদীবাদ (ইংরেজি: Neoclassicism) ছিল সাজ এবং দৃশ্যকলা, সাহিত্য, থিয়েটার, সংগীত এবং স্থাপত্যের একটি পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আন্দোলন যা প্রাচীন ধ্রুপদী সভ্যতার শিল্প ও সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রেরণা অর্জন করেছিল। পম্পেই এবং হারকিউলেনিয়াম পুনরায় আবিষ্কারের সময় জোহান জোয়াচিম উইঙ্কেলমানের লেখার জন্য রোমে নব্য ধ্রুপদীবাদের জন্ম হয়েছিল, তবে ইউরোপীয় শিল্পকলার এক প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ইতালি থেকে নতুন নতুন আবিষ্কৃত গ্রিকো-রোমান আদর্শশিক্ষাসহ তাদের মহা ভ্রমণ শেষ করে নিজ স্বদেশে ফিরে আসার ফলে এই মতবাদের জনপ্রিয়তা পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। প্রধান নব্য ধ্রুপদীবাদ আন্দোলন ১৮-শতাব্দীর আলোকায়নের যুগের সাথে মিলিত হয়েছিল এবং ১৯ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল, শেষদিকে রোমান্টিকতাবাদের সাথে প্রতিযোগিতা করেছিল।[১] স্থাপত্যশিল্পে, নব্য ধ্রুপদীবাদের শৈলীসমূহ উনিশ, বিশ এবং একুশ শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
ইংরেজি সাহিত্যে অষ্টাদশ শতক ছিল ‘গদ্য ও যুক্তির যুগ’। জীবনদর্শন ও সাহিত্যে তখন নীতি-নিয়মের প্রতি আনুগত্য, ঐতিহ্যের প্রতি মোহ, আভিজাত্যের অহমিকা, স্থায়িত্বের প্রতি বিশ্বাস ইত্যাদির লাগাম ছিল কড়া। যুক্তিবাদী ও বিদ্রুপের পরিশীলিত চমক ড্রাইডেন-পোপ-জনসন-ফিলডিংদের এই যুগকে চিহ্নিত করেছিল নব্য-ধ্রুপদী তথা ‘অগাস্টান যুগ’ হিসেবে। সৃজনধর্মের স্বতঃস্ফূর্ততা, আবেগ ও অনুভবের স্পন্দন, জীবনদৃষ্টির স্বপ্নময়তা, আঙ্গিকের অভিনবত্ব, কল্পনাশক্তি ও প্রেরণা ইত্যাদির কোনো সুযোগ ছিল না সুনিয়ন্ত্রিত জীবনবিন্যাস ও সুসঙ্গত শিল্পসৃষ্টির এই ‘আভিজাত্যের স্বর্ণযুগ’-এ (থ্যাকারে)।
নব্যধ্রুপদীবাদের ইতিহাস
ভাষা ও গঠনের সুষমা ও সুমিতি এবং সংযত শিল্পদৃষ্টি প্রাচীন গ্রিস ও রোমের ঐতিহ্যকে যে মর্যাদায় চিহ্নিত করেছিল, ইউরোপের নবজাগরণের কালে তার প্রতি সমালোচক ও পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। বিশেষত প্রাচীন গ্রিক নাটকের চর্চা থেকে তাঁরা ধ্রুপদী সাহিত্যের কয়েকটি লক্ষণ সশ্রদ্ধ অনুকরণের যোগ্য বলে মনে করেন, যথা গঠন প্রকরণের উৎকর্ষ, স্থান-কাল-ঘটনার ঐক্যে ধৃত একটি আনুগত্য, ভাবাবেগের আতিশষ্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। এই ‘ক্ল্যাসিসিজম’-এর সাধারণ সূত্রগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এ্যারিস্টটলের কাব্যনির্মাণকলা বিষয়ক গ্রন্থ পোয়েটিকস-এ এবং তারপর কবি হোরেস-প্রণীত আর্স পেপায়েটিকা-য়। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে এবং রাজতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন-পরবর্তী ইংল্যান্ডে, মোটের ওপর ১৬৬০ থেকে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্যের এই নিয়মগুলো সাহিত্যের স্থায়ী ও মৌলিক শর্ত হিসেবে গৃহীত হয়। সংযম, শৃঙ্খলা, যৌক্তিকতা, আভিজাত্য ও সম্ভ্রম ইত্যাদি সাহিত্যের ভাবনা ও প্রকরণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এই যুগের পরিচিতি ঘটে নব্য-ধ্রুপদী বা Neo-Classical যুগ হিসেবে।[২]
ষোড়শ শতকে ইতালিতে J. C. Scaliger ও অপরাপর পণ্ডিতদের চর্চায় এ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব পুনরাবিষ্কৃত হয়েছিল। এ্যারিস্টটল-বর্ণিত নাট্য ঐক্যসূত্রগুলো জোরালোভাবে ব্যাখ্যা ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্ক্যালিজার তার ‘পোয়েটিকা’ (১৫৬১) গ্রন্থে। শিল্প বা সাহিত্যকর্ম হলো ‘অনুকৃতি’ বা ‘Imitation’-এ্যারিস্টটলের এই মূল প্রতিপাদ্য ফ্রান্সে বিশেষভাবে আর্টের চরম লক্ষ্য বলে ঘোষিত হয়। অনুকৃতি-তত্ত্ব ও ঐক্যসূত্রের এই গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণায় উচ্চকণ্ঠ ছিলেন নব্য-ধ্রুপদী আন্দোলনের প্রধান হোতা Boileau।
ধ্রুপদী শিল্পভাবনা ও আঙ্গিকের মূলে রয়েছে এক প্রথানুগ, রক্ষণশীল, আভিজাত্যপূর্ণ জীবনদৃষ্টি। জীবনের বহুবিচিত্র গতিশীল নিত্যপ্রবহমানতার প্রতি তাঁদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়নি। সামাজিক আচার-বিচার, নিয়মানুবর্তিতা, মানবজীবনের বহিরঙ্গ বিষয়ে কৌতূহল এবং যুক্তিশৃঙ্খলায়, প্রাকরণিক উৎকর্ষে নিখুঁত শিল্পকর্ম নির্মাণই ছিল তাঁদের স্থির লক্ষ্য। ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্য, কল্পনার স্বতঃস্ফূর্ততা, আপাতগ্রাহ্য জগতের সীমার বাইরের বোধ ও ইন্দ্রিয়াতীত অনুভবের জগৎ সম্পর্কে তারা নিস্পৃহ ছিলেন। এই আভিজাত্যপূর্ণ নিস্পৃহতার গর্ভেই নিহিত ছিল রোমান্টিক আন্দোলনের জন্মবীজ।
নব্য-ধ্রুপদী শিল্পতত্ত্বের প্রভাবশালী বিবৃতি ছিল Boileau-র, L Art Poetigue (1674), আর ইংরেজি ভাষায় এরই সমতুল্য রচনা আলেকজান্ডার পোপের Essay on Criticism (1711)। ইংল্যান্ডে নব্য ধ্রুপদী আন্দোলন চূড়ান্ত মাত্রা পায় পোপেরই Essay on Man (1733-34)-এ। ভাবপ্রকাশে অতিরিক্ত আগ্রহ, বিস্ময়মণ্ডিত সৌন্দর্যবোধ, কল্পনার আবেগ ইত্যাদির সুযোগ না থাকায় শিল্প বলতে বোঝাত জীবনবাস্তবের এক শান্ত, সংযত, নিখুঁত নির্মাণ। মিলটনের কাব্য-নাটক ‘স্যামসন অ্যাগোনিসটিস’-এর শেষে যে আবেগের শান্তায়নের কথা বলা হয়েছিল সেই ‘Calm of mind, all passions spent’ ধ্রুপদী জীবনাদর্শের মূল প্রত্যয়। মানবমনের গুঢ় রহস্য জটিলতা ও জীবনের বাহ্য-আবরণের অন্তরালে নিহিত দোলাচল ও অনিশ্চয়তা এ-যুগের রচনায় তেমনভাবে পাওয়া যায় না। জীবনের বাহ্যানুষ্ঠান, সামাজিক নিয়ম-নীতি, প্রতিষ্ঠান ও সমস্যার চিত্রই ফুটে উঠেছিল রেস্টোরেশন ও অগাস্টান যুগের আচার-নির্ভর কমেডি, ব্যর্থ বীররসের কাব্য ও নাটক এবং গদ্য-পদ্য স্যাটায়ারে। ড্রাইডেনের কাব্য ও তাঁর রাজনৈতিক রূপক-কাব্য Absalom and Achitophel (1681) এবং বীররসের ট্র্যাজেডি The Conquest of Granada (1668), Aureng-Zebe (1676), All for Love (1678) ইত্যাদি, পোপের অতি-উপভোগ্য ব্যঙ্গ-মহাকাব্য The Rape of the Lock (1714), আর এক সরস ব্যঙ্গরচনা The Dunciad (1728-1743), তার হোরেসের অনুকরণে লেখা Odes, Satires, Epistles ইত্যাদি, হেনরি ফিলডিংয়ের দীর্ঘ, সুনির্মিত গদ্য-আখ্যান (Comic epic in prose) The History of Tom Jones, A Foundling (1744), সুইফটের বিধ্বংসী স্যাটায়ার Tale of a Tub (1704 ) ও তাঁর বহুপঠিত ব্যঙ্গ-রূপক Guliver’s Travels (1726) অ্যাডিসন ও স্টীলের সামাজিক বিষয়াশ্রয়ী, সরস, বিদ্রুপাত্মক প্রবন্ধাবলি ইত্যাদি ছিল ইংরেজি সাহিত্যে ‘নব্য-ধ্রুপদী’ যুগের প্রতিনিধিত্বমূলক রচনা।
নব্যধ্রুপদীবাদের বৈশিষ্ট্য
ড্রাইডেন, পোপ, এ্যাডিসন, সুইফট, জনসন, গোল্ডস্মিথ এবং এডমন্ড বার্ক প্রমুখ লেখকের রচনায় যে ভাবধারা ও বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় তার সাহায্যে নব্যধ্রুপদী সাহিত্যের একটি রূপরেখা নির্মাণ করা যেতে পারে:
১. এই লেখকরা ঐতিহ্যের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল, নতুন কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন অথবা উদ্ভাবনা সম্পর্কে সন্দিগ্ধচিত্ত, এবং প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্য, বিশেষ করে রোমান লেখকদের রচনা যে অতি উচ্চমানের এবং সর্বাংশে অনুকরণীয় সে বিষয়ে দ্বিধাহীন। এই সূত্রেই নিওক্লাসিক কথাটি ব্যবহার।
২. সাহিত্য হচ্ছে মূলত একটি শিল্পকর্ম, ‘আর্ট’। লেখকের অন্তর্নিহিত গুণের প্রয়োজন হলেও একে বিকশিত করতে হলে ব্যাপক পঠনপাঠন এবং পরিশ্রমী অনুশীলন অপরিহার্য। সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করতে হলে কতকগুলো নিয়মকানুন ও রীতি-নীতি মানতে হবে, যার নির্দেশনা পাওয়া যাবে হোরেসের Arts Poetica-য় এবং ক্লাসিকাল সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মে, যেমন নাটকের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে হলে ‘তিন ঐক্য’ রক্ষা করতে হবে।
৩. কবিতার বিষয়বস্তুর মৌল উৎস হচ্ছে মানুষ, বিশেষভাবে সুবিন্যস্ত সমাজের সভ্য মানুষ। কাব্য হচ্ছে মানবজীবনের অনুকৃতি— ‘a mirror held to nature’.
৪. বিষয়বস্তু এবং শিল্পকর্ম উভয়ক্ষেত্রেই গুরুত্ব লাভ করবে মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ, বেশিরভাগ মানুষের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং রুচিসমূহ। ঝোঁকটা চমক জাগানো নতুনত্বের উপর নয়, বরং প্রতিনিধিত্বমূলক হবার উপর। পোপের ভাষায় ‘True wit’ হচ্ছে ‘what of was thought but ne’er so well expressed’. তাই প্রয়োজন অনুশীলন, ঘষামাজা। কল্পনার হঠাৎ ঝলকানি নয়, অধ্যবসায়ী নির্মাণ।
৫. নব্য ধ্রুপদী লেখকরা তাদের কালের দার্শনিকদের মতোই মানুষকে দেখেছেন সীমিত সাধ্য ও সম্ভাবনার প্রাণীরূপে। এ যুগের অনেক রচনায়, ব্যঙ্গাত্মক এবং উপদেশমুখী, আক্রমণের বিষয় হয়েছে মানুষের অহমিকা, মাত্রাতিরিক্ত উচ্চাভিলাষ, অনিয়মিত আকাঙ্ক্ষা। মানুষকে তাই সীমারেখা মেনে চলতে হবে, যেমন জীবনে তেমনি সাহিত্যকর্মে। সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে অনেক নিয়ম তারা সানন্দে মেনে নিয়েছিলেন, যেমন কবিতার ক্ষেত্রে ‘closed couplet’।[৩]
পরবর্তী নব্যধ্রুপদীবাদ
‘ধ্রুপদী’ বা ‘ক্লাসিক্যাল এই তকমা কোনো বিশেষ যুগ বা সময়-পর্বের গায়ে এঁটে দেয়া বোধ হয় সঙ্গত নয়। অষ্টাদশ শতকেই বার্নর্স, ব্লেক, ওয়ালপোলরা প্রস্তুত হচ্ছিলেন। আবার উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এবং বিশ শতকের মডার্নিস্ট আন্দোলনেও ধ্রুপদী ভাবাদর্শ ও প্রকরণের প্রভাব পড়েনি এমন নয়। ম্যাথু আর্নল্ডের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সমালোচনায়, টি.এস. এলিয়টের ‘Tradition and the Individual Talent’ ও অন্যান্য প্রবন্ধে প্রাচীন সাহিত্যের গীতি-আদর্শের সমর্থন ও প্রশস্তি আছে। রোমান্টিক কাব্যতত্ত্ব ও নন্দন ভাবনার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ও আবেগনির্ভর প্রবণতার বিরুদ্ধে এঁরা নৈর্ব্যক্তিকতা, ঐতিহ্যানুগত্য, মননশীলতা ও আভিজাত্যবোধের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। এলিয়ট তো ঘোষণাই করেছিলেন যে তিনি সাহিত্যের ক্ষেত্রে ধ্রুপদী ভাবাদর্শের অনুগামী— ‘Classicist in literature’।
তথ্যসূত্র
১. Kohle, Hubertus (August 7, 2006). “The road from Rome to Paris. The birth of a modern Neoclassicism”. Jacques Louis David. New perspectives, pp. 71-80.
২. কুন্তল চট্টোপাধ্যায়, “ক্ল্যাসিসিজম ও নিওক্ল্যাসিসিজম” মোস্তফা আহাদ তালুকদার সম্পাদিত পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতি, ভাষাপ্রকাশ ঢাকা, তৃতীয় সংস্করণ অক্টোবর ২০১৭, পৃষ্ঠা ৮৭-৮৮
৩. কবীর চৌধুরী, সাহিত্যকোষ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ৯৭-৯৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।