ধ্রুপদীবাদ (ইংরেজি: Classicism), সাধারণভাবে চারুকলায় ধ্রুপদীবাদ, বলতে বোঝায় পশ্চিমা ঐতিহ্যের উচ্চ শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রাচীন ধ্রুপদী একটি কাল, ধ্রুপদীবাদীরা যে রুচির মান অতিক্রম করতে চান তার মূল্যবোধ নির্ধারণ করেন। এর শুদ্ধতম রূপে, ধ্রুপদীবাদ হলো প্রাচীন গ্রীস এবং রোমের সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্যের বিভিন্ন নীতিগুলির ভিত্তির উপর নির্ভরশীল নান্দনিক মনোভাব; যেসব মনোভাব জোর দেয় রূপ, সরলতা, অনুপাত, কাঠামোর স্পষ্টতা, নিখুঁততা, সংযত আবেগের পাশাপাশি পরিস্ফুট মনীষার আবেদনের উপর।
ধ্রুপদীবাদ এমন একটি শক্তি যা প্রায়ই মধ্যযুগ-উত্তর ইউরোপীয় এবং ইউরোপীয় প্রভাবিত ঐতিহ্যে উপস্থিত থাকে; যাই হোক, কিছু সময়কাল নিজেকে অন্যের তুলনায় ধ্রুপদী আদর্শের সাথে আরও সংযুক্ত বলে মনে করেছিল, বিশেষত আলোকায়নের যুগ, যখন নব্য ধ্রুপদীবাদ দৃশ্যকলার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ছিল।
প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যকে আমরা সাধারণভাবে অভিহিত করে থাকি ‘Classical’ বা ধ্রুপদী সাহিত্য বলে। সংস্কৃত ভাষার সাহিত্যে প্রাচীন কাব্যনাটকগুলোকে ধ্রুপদী সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[২] আবার রোমানদের জন্য পূর্ববর্তী গ্রিক প্রভাব ছিলো ধ্রুপদীবাদ। রোমান নাট্যকার সেনেকা অনুকরণ করেছিলেন ধ্রুপদী গ্রিক নাট্যকারদের।[৩]
আভিধানিক অর্থে ধ্রুপদীবাদ প্রাচীনকালের শ্রেষ্ঠ রচনাদি আদর্শরূপে গ্রহণ করার ঝোঁক বা ওইগুলোর অনুকরণ। যে সাহিত্য কালজয়ী, যে সাহিত্য সংযত ভাষায়, সুসংহত চিন্তার সম্ভ্রম ও ঔজ্জ্বল্যে রচিত, তার রীতি ও আদর্শকে অনুসরণ করার প্রবণতাই হলো ক্লাসিসিজম।
‘ক্ল্যাসিক্যাল’ বা ধ্রুপদী সাহিত্যের মেজাজে থাকে বলিষ্ঠতার ছাপ, ভাষায় থাকে মহিমময় গাম্ভীর্য, লেখক সচেতন থাকেন ভাবপ্রকাশের সংহতি, নির্মাণের কেতাকানুন, ঐতিহ্যের অনুবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে আবেগ-অনুভূতির ঊর্ধ্বে স্থান দেন যুক্তি-বুদ্ধি-বিশ্লেষণকে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের কারণে কোনোভাবেই পরিমিতিবোধ ও নিয়ম-শৃঙ্খলাকে ক্ষুন্ন হতে দেন না। প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন লেখকদের রচনার যেগুলো প্রধান বৈশিষ্ঠ্য-সংযত রীতি, সুসামঞ্জস্য গঠন, যুক্তিনির্ভরতা, ভারসাম্য ইত্যাদি—সেগুলোর প্রতিচ্ছায়া আমরা কোনো রচনায় পেলে তাকে ক্ল্যাসিক্যাল বলব।[৪]
ধ্রুপদী শিল্পভাবনা ও আঙ্গিকের মূলে রয়েছে এক প্রথানুগ, রক্ষণশীল, আভিজাত্যপূর্ণ জীবনদৃষ্টি। জীবনের বহুবিচিত্র গতিশীল নিত্যপ্রবহমানতার প্রতি তাঁদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়নি। সামাজিক আচার-বিচার, নিয়মানুবর্তিতা, মানবজীবনের বহিরঙ্গ বিষয়ে কৌতূহল এবং যুক্তিশৃঙ্খলায়, প্রাকরণিক উৎকর্ষে নিখুঁত শিল্পকর্ম নির্মাণই ছিল তাঁদের স্থির লক্ষ্য। ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্য, কল্পনার স্বতঃস্ফূর্ততা, আপাতগ্রাহ্য জগতের সীমার বাইরের বোধ ও ইন্দ্রিয়াতীত অনুভবের জগৎ সম্পর্কে তারা নিস্পৃহ ছিলেন।
তথ্যসূত্র
১. Caves, R. W. (2004). Encyclopedia of the City. Routledge. p. 112.
২. সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যের শব্দার্থকোষ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৬২
৩. কবীর চৌধুরী, সাহিত্যকোষ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ৯৭-৯৮।
৪. কুন্তল চট্টোপাধ্যায়, “ক্ল্যাসিসিজম ও নিওক্ল্যাসিসিজম” মোস্তফা আহাদ তালুকদার সম্পাদিত পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতি, ভাষাপ্রকাশ ঢাকা, তৃতীয় সংস্করণ অক্টোবর ২০১৭, পৃষ্ঠা ৮৭-৮৮
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।