সেলুলার জেলের ফলক থেকে উধাও তিন শতাধিক বাঙালিসহ ৪৫৩ জন বিপ্লবীর নাম

আন্দামানের সেলুলার জেল বা কালাপানির জেলে একসময় ঠিকানা হয়ে উঠেছিল ভারতের বিভিন্ন জাতির হাজার হাজার বিপ্লবী ও ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বা সিপাহী বিদ্রীহের সময় থেকেই আন্দামানকে বন্দিখানা হিসেবে ব্যবহার করত আধুনিক বর্বরতার প্রতিভূ ব্রিটিশ সরকার। ১৮৯৬ সালে আন্দামানে একটি জেলখানা নির্মাণের কাজ শুরু হয় যা বর্তমানে আন্দামান সেলুলার জেল নামে পরিচিত। সেই জেলখানায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে যাঁদের, বেশ কয়েকটি পাথরের ফলকে তাঁদের মোট ৯৬৬ জনের নামের তালিকা খোদাই করে বসানো হয়েছিল এই জেলে। তবে সম্প্রতি দেখা গেছে সেই তালিকাটি উধাও হয়ে গেছে এবং নতুন তালিকা স্থাপন করা হয়েছে। নতুন তালিকায় ৫১৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং মুছে ফেলা হয়েছে ৪৫৩ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম। খবর কেবলটাইমস ডট কমের

কেবলটাইমস ডট কমে সেলুলার জেলের নয়া তালিকার ছবি তুলে ধরা হয়েছে। সেই নতুন ফলকগুলিতে রয়েছে মাত্র ৫১৩ জন বিপ্লবীর নাম। সেখান থেকেই দেখা যাচ্ছে যে, এই নতুন তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে চারশ তিপান্ন জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম। এই তালিকা প্রকাশ্যে আসার পরেই রীতিমতো চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

নাদুরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপক রায় রোদ্দুরে ডট কমকে জানিয়েছেন, “তালিকা থেকে বাদ পড়া স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অধিকাংশই বাঙালি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সারা ভারত থেকেই সেলুলার জেলে সংগ্রামীদের যে বন্দি করা হত, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। কিন্তু বাংলা, বিহার এবং আন্দামানের বিচার ব্যবস্থা অনেকটা বেশি করেই নির্ভরশীল ছিল কলকাতা হাইকোর্টের ওপরে। ফলে বাঙালিদের এই জেলে দ্বীপান্তর করার প্রবণতাও সেই সূত্রেই বেশি থেকেই যায়”। 

নিশ্চিত না হতে পারলেও খানিকটা সংশয়ের সঙ্গেই বলছেন তিনি, “রমেশ মজুমদারের বইয়ের তালিকার পুরো পর্যালোচনা না করে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে আপাতভাবে প্রায় ছ’শো-সাতশো’র মতো বাঙালি বিপ্লবীদের নাম ছিল। সেটাই এখন দাঁড়িয়েছে ৩৮৪ জনে। ফলে বাঙালিদের নাম যে বাদ গেছে বেশি তা বলাই বাহুল্য। তবে পাশাপাশি অন্যান্য রাজ্যের বিপ্লবীদের নাম বাদ যাওয়ারও সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে।”

আরো পড়ুন:  ন্যায় দর্শন প্রসঙ্গে

উল্লেখ করার মতো আরো একটি বিষয় হচ্ছে, এই পুরনো তালিকায় প্রত্যেক বিপ্লবীদের নামের পাশে উল্লেখিত ছিল তাঁরা কত সালে এই জেলে বন্দি হয়ে এসেছিলেন। নতুন তালিকায় এই ধরণের কোনো উল্লেখ নেই। বরং ১৯০৯-১৯২১, ১৯২২-১৯৩১ এবং ১৯৩২-১৯৩৮ সাল; এই তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে পুরো সময়সীমাকে। বাদ দেয়া হয়েছে ১৯০৯ সালের আগের বিপ্লবীদের নামও? উঠে আসছে এমনটাই। ঐতিহাসিক ও লেখক হামাদ সুবানিও তাঁর একটি প্রবন্ধে এই বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

কিন্তু কবে হল এই বদল? লোকচক্ষুর আড়ালে এই লকডাউনেই? তার উত্তর অবশ্যই নয়। আনুমানিক ২০১৫ সাল বা তার আগেই আগেই এই বদল ঘটেছে। কারণ হামাদি সুবানির সেই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৫ সালে। অর্থাৎ সেই সময়ে কিংবা তার আগেই হয়েছে এই পরিবর্তন। তবে এতগুলো বছর তা চোখ এড়িয়ে গেল কীভাবে, সন্দেহ থেকে যাচ্ছে সে ব্যাপারেই।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালেই এই সেলুলার জেলের পুনর্নবীকরণের কাজ হয়। সেলুলার জেলের নামকরণ করা হয় যুদ্ধাপরাধী ও সন্ত্রাসী ভারতের জনগণের শত্রু দামোদর সাভারকারের নামে। প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, তখনই কি এই তালিকায় বদল আনা হয়েছিল? যদিও বিষয়টি স্পষ্ট নয় এখনও। বদল হওয়া নতুন তালিকাতেও প্রথমেই রয়েছে এই ভারত শত্রু দামোদর সাভারকারের নাম। তবে রমেশচন্দ্র মজুমদারের বইয়ে বিবরণ থেকেই উঠে আসে পুরনো তালিকাটি সাজানো হয়েছিল নামের আদ্যাক্ষর দিয়েই। সেক্ষেত্রে দামোদর সাভারকারের নাম তালিকার প্রথমে তুলে আনা হয়েছে সন্ত্রাসবাদী বিজেপির এজেন্ডা ও ইতিহাসকে বিকৃত করার জন্যেই।

ভারতের বিপ্লবী আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের নাম এইভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে কেন, তারই বা যুক্তি কি? কোথাও গিয়ে কি তাঁরা কম প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিলেন? নাকি তাঁদের গুরুত্ব কম বলেই মনে করল প্রশাসন? জানা নেই। আবার অধিকাংশ বাঙালি বিপ্লবীদের নাম বাদ যাওয়ার সম্ভাবনা উসকে দিচ্ছে হিন্দি আগ্রাসনের সম্ভাবনাকেও। ইতিহাস বদলে ফেলতে চাওয়ার এই প্রচেষ্টায় বহু মানুষ সরব হয়েছেন ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায়। 

আরো পড়ুন:  খিলাফত আন্দোলন ছিলো ভারতে ধর্মীয় পুনর্জাগরণের আন্দোলন

এইভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করার কী হবে এর পরিণতি? যদি সত্যিই ইতিহাস বিকৃতির ষড়যন্ত্র ঘটে থাকে, বাঙালিরা কি প্রতিবাদে দলবদ্ধ হবেন? নাকি অন্য অনেক বিতর্কের মতোই ধামাচাপা পড়ে যাবে এইভাবেই? শিক্ষক দীপক রায় চাচ্ছেন, শীঘ্র এই সত্যতাটুকু যাচাই করে দেখা হোক। এই চাহিদা সকলেরই। প্রকৃত সত্য সামনে আসুক। আর যদি দেখা যায়, সত্যিই এক মস্ত ‘গোলমাল’ থেকে গেছে, কে নেবে সেই দায়? প্রশ্ন অনেক। উত্তরের অপেক্ষায় সকলেই…

Leave a Comment

error: Content is protected !!