শরীরে ঘা, ক্ষত এবং নখকুনির সমস্যায় ২৪টি ঘরোয়া ভেষজ চিকিৎসা

১. অড়হর: কয়েকটি অড়হরের কচিপাতা (সম্ভব হলে) ভাল করে ধুয়ে অল্প থেতো করে নিয়ে, সেটা আস্তে আস্তে চিবোতে হবে। এই সময় একটু জ্বালা করে; তবে ২ থেকে ৩ দিন এইভাবে করতে পারলে জিহ্বার ক্ষত সেরে যায়। আর একটা কথা, চিবিয়ে পাতার ছিড়ে ফেলে দেওয়ার পর আর মুখ ধুতে নেই।

২. মহুয়া বীজ: উভয় ক্ষেত্রেই মহুয়া বীজের তেল কোনো পরিষ্কার কাপড়ের টুকরা বা তুলাতে লাগিয়ে আঘাতের ক্ষতে এবং পুরানা ঘায়ে ওপরে রেখে কাপড়ের ফালি দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। কয়েক দিন এভাবে তেল লাগালে ঘা ভালো হয়ে যাবে।

৩. করবী: গাছের মূল পরিষ্কার পানির সাথে ঘষে থেঁতো করে পুরুষাঙ্গে লেপন করলে শরীরে ঘা, ক্ষত আরাম হয়। যদি মূল পানিতে ঘষার অসুবিধা থাকে তাহলে শিকড় পানি দিয়ে বেটে মলমের মতো লাগান যায়। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, লিঙ্গমুণ্ডে ঘা হয় সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হলে।

৪. বিশল্যকরণী: পাতার রস সামান্য গরম পানিতে মিশিয়ে তার সাহায্যে দিনে একবার ঘা ধুয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে বিশল্যকরণী পাতা এবং মূল ভালো করে বেটে ঘায়ের ওপর লাগিয়ে ফালি কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ঘা ভালো হয়ে যাবে।

৫. ভুই আমলা: গাছের পাতা ও শিকড় চাল ধোয়া পানির সাথে বেটে প্রলেপ দিলে ক্ষত, ঘা এবং নখকুনি রোগের উপশম হয়। দুর্গন্ধযুক্ত ঘায়ে ভূঁই আমলা গাছের সাদা আঠা শরীরের উপরের ত্বকের ক্ষতে দিলে অবশ্যই ঘা সারবে। এটি ক্ষতের জন্য বিখ্যাত একটি ওষুধ।

৬. শেয়ালকাঁটা: যে কোনো ক্ষতে শেয়ালকাঁটা গাছের আঠা প্রয়োগ করলে দ্রুত সেরে যায়। এমনকি বিষাক্ত ঘা ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে ভালো হয়। এটি একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। শেয়ালকাঁটার শিকড় অল্প পানি দিয়ে বেটে ঘায়ে প্রলেপ দিলে দ্রুত ঘা শুকিয়ে যায়।

৭. নুন: বিষাক্ত পোকার কামড়ে, হাত পুড়ে যাওয়ায়, ক্ষতে ও রক্তপাতে নুন লাগালে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। ঘা থেকে বা ক্ষত থেকে রক্ত বের হলে তার ওপরে নুন জলে ভেজানো ব্যান্ডেজ বা পটি বাঁধলে ক্ষত পেকে যায় আর শীঘ্রই শুকিয়ে যায়।  নুন জীবাণুনাশক ও দুর্গন্ধহর। ঘা ইত্যাদি ধুতে সেই জন্যেই নুন জল ব্যবহার করা উচিত।

আরো পড়ুন:  মাথার যন্ত্রণা দূর করা বা কমানোর ঘরোয়া সহজ দশটি উপায়

৮. তেঁতুল: যে ক্ষত কিছুতেই ভালো হচ্ছে না, সেক্ষেত্রে তেতুলের পাতা সিদ্ধ জলে ক্ষত স্থান ধুয়ে দিলে তাড়াতাড়ি আরোগ্য হয়। এর পাতা-সিদ্ধ জল মুখে খানিকক্ষণ রেখে ফেলে দিতে হয়। এইভাবে ৫ থেকে ১০ মিনিট করে ২ থেকে ৩ দিন ব্যবহার করলে উপশম হয়; অনেক ক্ষেত্রে সেরেও যায়, তবে আভ্যন্তরিক কোনো কারণে ক্ষত হলে সেখানে চিকিৎসার প্রয়োজন। মুখে ঘা ও ত্বকের প্রদাহ সারাতে সাহায্য করে।

৯. বুড়িগুয়াপান: এই গাছ সম্পর্কে ‘বনৌষধি দর্পণ’ (কবিরাজ বিরজাচরণ গুপ্ত কৃত) ব্যতীত অন্য কোনো গ্রন্থে এই গাছটির রস-গুণ সম্পর্কে কোনো কথার উল্লেখ নেই, তবে মুখের ও জিহর ক্ষতে পানের সঙ্গে এই গাছের পাতা চর্বণ করলে উপকার হয় এবং পুরাতন কদর্য ক্ষতেও বুড়িগুয়াপান পাতা বেটে লাগালে ক্ষত শুদ্ধি হয়, এই কথা বলা আছে।

১০. কদম গাছ: এই গাছের পাতার ক্বাথ ক্ষতে ও মুখের ঘায়ে দিলে সেরে যায়।

১১. বহেড়া:  বীজ বাদ বহেড়া গাছের শাঁস (উপরের মাংসল অংশ) আন্দাজ ৫ গ্রাম জল দিয়ে বেটে, ঘন করে জলে গুলে সেইটা কবল ধারণ করতে হবে। তবে দিনে ২ থেকে ৩ বার হলে ভাল হয় এবং মুখে নিয়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিট বসে থাকতে হবে।

১২. নিসিন্দা নিসিন্দার ক্বাথ দিয়ে সেচন করলে ২ থেকে ৪ দিনেই শরীরে ঘা, ক্ষত সারে।

১৩. গাব: কোনো জায়গায় ক্ষত (ঘা) সেরে যাওয়ার পর (যে কোনো কারণেই হোক) সাদা দাগ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে কাঁচা গাব ফলের রস কিছুদিন ঐ দাগের উপর প্রলেপ দিলে ওটার বর্ণ স্বাভাবিক হয়ে যায়।

১৪. হলুদ: বিশেষ করে কার্বাঙ্কল জাতীয় (অয়ুর্বেদিক ভাষায় ‘ব্লমিক স্ফোটক’) ফোড়ায় কাঁচা হলুদ বাটা অল্প গরম করে দিনে রাত্রে কয়েকবার লাগালে কয়েক দিনেই দূষিত পূজ পড়া বন্ধ হয়ে যায়।

১৫. পান: দাঁতের মাড়ির দুষিত ক্ষতে পুঁজ জমতে থাকলে পানের রসের সঙ্গে অল্প জল মিশিয়ে কুলকুচি করলে ওখানে আর পুজ জমে না; মুখের ক্ষত শুকিয়ে যায়। আবার, পানের রসে তীক্ষ্ণতায় আছে জীবাণুনাশক গুণ। সেইজন্যে পরিমিতভাবে পান খাওয়া দাঁত ও মুখের পক্ষে ভাল। পানে একটি বিশেষ ধরনের তৈল পদার্থ আছে- সেইজন্যে পান মুখশুদ্ধি করায়, দাঁতের পচে যাওয়া রোধ করে। পানের স্বাদ তীক্ষ্ণ, কিছু সুগন্ধযুক্ত, পান খেলে মুখের বিস্বাদ দূর হয়ে যায়, অরুচি ও মুখের দুর্গন্ধও দূর হয়।

আরো পড়ুন:  বমি বা বমন বন্ধ করার ১৮টি ভেষজ ঘরোয়া সহজ পদ্ধতি যা জেনে রাখা ভাল

১৬. আপাং: কোনো কারণে ক্ষতস্থান যদি বিষিয়ে যায় এবং নানা ওষুধ প্রয়োগ করে ভালো না হয়, তবে আপাং গাছের পাতা ও কচি ডাল বেটে তার রস দশ-পনর মি.লি. এক থেকে দেড় চামচ গাওয়া ঘি দিয়ে ভেজে সেটা সকালে একবার, রাতে শোয়ার সময় আরও একবার ক্ষতস্থানে লাগালে ক্ষত দ্রুত সেরে উঠবে। তবে একটা পরিষ্কার ফালি কাপড় দিয়ে হালকাভাবে ক্ষতস্থান বেঁধে রাখলে ভালো। তা না হলে ঘুমের ঘোরে বিছানা নোংরা হবে।

১৭. তিল : যদি টাটকা শরীরে ঘা, ক্ষত না সারে তাহলে তিল পিষে নিয়ে মধু আর ঘি মিশিয়ে লাগালে অনেক ওষুধ বা মলমের চেয়ে বেশি কাজ দেয়।

১৮. সোনালু: কোনো জায়গায় কেটে বা ছিঁড়ে গেলে বিষিয়ে ওঠে, জ্বালা যন্ত্রণা হতে থাকে; এক্ষেত্রে সোনালুর পাতা বেঁটে, তার সঙ্গে অল্প ঘি মিশিয়ে ওখানে লাগালে ব্যথা সেরে যাবে।

১৯. কুশ:  শরীরে ঘা বা ক্ষত হয়েছে দেখলেই যে কুশমূল ব্যবহার করা যাবে, সেটা নয়। কেবলমাত্র যে ক্ষতের প্রকৃতিটা দেখা যাচ্ছে যে, বহুমুখী ক্ষত অথচ সেখানে পুঁজের ভাগ কম এবং সারতে বা পুরতেও চাচ্ছে না, সেখানে বুঝতে হবে এখানে বিকৃতপিত্তের প্রভাব বর্তমান, কেবল সেই ক্ষেত্রেই কুশমূল সিদ্ধ জল দিয়ে ধুয়ে দেওয়া, আর কুশমূল চন্দনের মতো করে বেটে ওখানে লাগানো এই প্রক্রিয়া করলে কয়েক দিনের মধ্যেই ওটা সেরে যাবে।

২০. জাম: যে ঘা বা ক্ষত তাড়াতাড়ি পুরে উঠছে না, সেখানে জাম ছাল মিহি গুড়ো করে ঐ ঘায়ের উপর ছড়িয়ে দিলে তাড়াতাড়ি পুরে যায়।

২১. থানকুনি: মূলসহ গাছ নিয়ে সিদ্ধ করে সেই জলে ধুলে কিংবা ঐ থানকুনি গাছটি শিলে পিষে নিয়ে সেটার সঙ্গে ঘি দিয়ে পাক করে সেটা ছেঁকে ঐ ঘি দূষিত ক্ষতে লাগালে উল্লেখযোগ্যভাবে ওটা কমে যাবে।

২২. নিম: সেক্ষেত্রে নিমের ছালের ক্বাথ খাওয়া আর সেই জলে ক্ষত ধোওয়া এটিতে প্রতিরোধ নিশ্চয়ই হবে। মুখের বা মাড়িতে ঘা বা ক্ষত পিত্তবিকারের কারণে যদি উদ্ভব হয়, তাহলে নিম বীজের তেল লাগালে সেরে যায়।

আরো পড়ুন:  আমাশয় রোগ হওয়ার কারণ ও প্রতিকারের উপায়

২৩. ওল বা ওলকচু: ওল বা ওলকচু কুচি কুচি করে কেটে শুকিয়ে নিয়ে মাটির কোনো পাত্রে মুখ বন্ধ করে লেপে, সেটা শুকিয়ে নিয়ে পোড়াতে হবে, তারপর সেই ওলপোড়ার ছাইকে একটু ঘি-এর সঙ্গে মিশিয়ে দাঁত মাজলে মুখের ও দাঁতের মাড়ির ক্ষত সেরে যাবে।

২৪. অশ্বত্থ: এমন কতকগুলি ক্ষত হয়, যেটায় পুঁজ প্রচুর জন্মে এবং যন্ত্রণাও থাকে; সেক্ষেত্রে অশ্বত্থের  কচিপাতা ক্ষতের উপরে চাপা দিয়ে বেধে রাখলে ঐ পুঁজ পড়া কমে যাবে এবং যন্ত্রণারও উপশম হবে। এছাড়া গভীর ক্ষত আস্তে আস্তে গভীর হয়ে যাচ্ছে, শুকিয়ে যাওয়ার নাম নেই, এক্ষেত্রে ঐ অশ্বত্থ গাছের চটা অর্থাৎ উপরের ছালের যে অংশটার স্বভাবমৃত্যু হয়েছে, এগুলি প্রায় হাত দিয়েই তুলে নেওয়া যায় সেসব মিহি চূর্ণ করে শরীরে ঘা বা ক্ষতের উপর খুব পাতলা করে ছড়িয়ে দিলে ২ থেকে ৪ দিনের মধ্যেই ওটা পুরে উঠবে। সাবধান, কাঁচা ছাল শুকিয়ে সেটার গুড়ো যেন প্রয়োগ করবেন না, তাহলে এটাতে উল্টাই হবে। পোড়ার ঘায়ে ক্ষত: অন্তর্ধূম দগ্ধ অশ্বত্থে অর্থাৎ চটার অন্তর্ধূম দগ্ধ কয়লার মিহি গুড়ো করে নারকেল তেলের সঙ্গে অথবা মোমের সঙ্গে বা ভেসলিনের সঙ্গে মিশিয়ে ঐ পোড়ার ঘায়ে লাগালে ২ থেকে ৪ দিনের মধ্যে শুকিয়ে যায়।

তথ্যসূত্রঃ      

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১ ও ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩।

২. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০।

৩. কবিরাজ বৈদ্যনাথ সেন, সম্পাদনায় কবিরাজ আ: খালেক মোল্লা লোকমান হেকিমের কবিরাজী চিকিৎসা, সর্বস্বত্ব, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ অক্টোবর ২০০৯

Leave a Comment

error: Content is protected !!