ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী প্রণালী বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের নদীপ্রণালীগুলোর অন্যতম

ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী প্রণালী (ইংরেজি: Brahmaputra-Jamuna River System) বা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী ব্যবস্থা বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের তথা পৃথিবীর নদীপ্রণালীগুলোর অন্যতম। ভূপৃষ্ঠের নিয়ত পরিবর্তন সাধনকারী নিয়ামকসমূহের মধ্যে নদী অন্যতম এবং নদী মাতৃক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদী ব্যবস্থা ও তার অববাহিকা এলাকার বিভিন্ন স্থানে ক্ষয়, বহন ও সঞ্চয় ক্রিয়ার মাধ্যমে বিচিত্র ভূমিরূপ সৃষ্টি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

ব্রহ্মপুত্র-যমুনা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী এবং বিশ্বের প্রধান নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা তিব্বত, ভারত ও বাংলাদেশ দিয়ে প্রবাহিত। যমুনা ব্রহ্মপুত্রের নিম্ন প্রবাহ যা ১৭৯৭ সালের ভূমিকম্প ও বন্যার দ্বারা সৃষ্ট। নদীটি ৩১°৬০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮২°০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে হিমালয়ের মানস সরোবর ও কৈলাশ শৃঙ্গের মধ্যবর্তী চেমাইয়াংডং নামক হিমবাহ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। উৎপত্তিস্থল হতে চারবার নাম পরির্তন করে প্রবাহিত হয়েছে। ইহা তিব্বতে শানপো, আসামে ডিহং ও ব্রহ্মপুত্র এবং বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা নামে পরিচিত। 

যমুনা নদী উৎপত্তি স্থল থেকে শানপো নামে হিমালয়ের পাদদেশ বরাবর উত্তর পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে এবং সাদিয়া নামক স্থানে হিমালয়ের একটি বাঁক দিয়ে নেমে পড়ে। তারপরে আসামে প্রবেশ করে লোহিত নাম ধারণ করে। আসাম উপত্যাকায় এই নদী ডিহং ও পরে ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত হয়ে পশ্চিমদিকে প্রবাহিত হয়। অতঃপর গারো পাহাড়ের নিকট দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী থানার নারায়নপর হউনিয়নের মাঝিয়াল নামক স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদীটি কিছুদূর প্রবাহিত হওয়ার পর বাহাদুরাবাদ ঘাটের নিকট দুইটি ধারা প্রবাহিত হয় যার একটি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে ময়মনসিংহ জেলায় প্রবেশ করেছে এবং অপরটি ঝিনাই নামক ক্ষুদ্র স্রোতধারার সঙ্গে মিলিত হয়ে মিলিত ধারা যমুনা নামে (বর্তমান স্রোতধারা) দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয় এবং সিরাজগঞ্জ ও আরিচা ঘাট অতিক্রম করে গোয়ালন্দের নিকট পদ্মার সাথে মিলিত হয়েছে। 

নদীর দৈর্ঘ্য, প্রশস্ততা ও গভীরতা: উৎপত্তি স্থল হতে পদ্মার সাথে মিলনস্থল পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭০০ কিলোমিটার। বাংলাদেশের ভিতরে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র মিলে এর দৈর্ঘ্য ২৭৬ কিমি। এর মধ্যে যমুনার দৈর্ঘ্য ২০৫ কিলোমিটার। 

যমুনা নদীর প্রশস্ততা ৩ কিমি হতে ১৮ কিমি পর্যন্ত তবে এর গড় প্রশস্ততা প্রায় ১০ কিমি। বর্ষা ঋতুতে এর প্রশস্ততা সচরাচর ৫ কিমি এর অধিক হয়ে থাকে। নদীটির গড় গভীরতা প্রায় ১৮ মিটার। তবে অবস্থান ভেদে কম বা বেশি হয়। বাহাদুরাবাদে নদীটির গড় গভীরতা ১৩.২৯-২০.৬২ মিটার এবং সিরাজগঞ্জের নিকট গড় গভীরতা ৭.০৩-১৫.১২ মিটার। প্রশস্ততা ও গভীরতা অনুপাত ৫০:১ থেকে ৫০০:১ পর্যন্ত হয়ে থাকে। 

আরো পড়ুন:  শ্রীমতী নদী বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার একটি নদী

অববাহিকা এলাকার আয়তন: ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকার আয়তন প্রায় ৫৮৩০০০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে তিব্বতে ২৯৩০০০ বর্গকিলোমিটার, ভারতে ২৪১০০০ বর্গকিলোমিটার এবং বাংলাদেশে কেবলমাত্রা ৪৭০০০ বর্গকিলোমিটার অবস্থিত। বাহাদুরাবাদের উজানে ব্রহ্মপুত্র ৫৩৬০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার পানি নিষ্কাশন করে থাকে। 

যমুনা নদীর ঢাল ও নতিমাত্রা: অন্যান্য সকল নদীর মত যমুনা নদীর ঢাল ভাটিতে ক্রমান্বয়ে কম এবং উজানে বেশি হয়ে থাকে। বাহাদুরাবাদ হতে গোয়ালন্দ পর্যন্ত যমুনার নদীর ঢাল প্রতি মাইলে ০.৩৫ ফুট বা প্রতি কিলোমিটারে ০.৬ সেমি। বাংলাদেশে নদীটির নতিমাত্রা ০.০০০০৭৭ যা গঙ্গার সাথে মিলন স্থলের নিকটে ০.০০০০৫ এ হ্রাস পায়। যমুনার গড় নতিমাত্রা ১.১১৮৫০ এবং ইহা গঙ্গার তুলনায় সামান্য বেশি। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদী ব্যবস্থা বড় বৈচিত্র্যময় এবং এর অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নিম্নলিখিত দিকগুলো উল্লেখযোগ্য।

ভাঙ্গন প্রবণ যমুনা নদী: যমুনা একটি ভাঙ্গন প্রবন নদী, বিধায় এর তটরেখা সর্বদা পরিবর্তনশীল। গত ১৬০ বছরে নদীটির কোন না কোন স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই ভাঙ্গনের মাত্রা অনেক বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিম পাড়ের গড় ভাঙ্গনও গড়ার হার বিগত দেড়শত বছরের চেয়ে যথাক্রমে ৯.৭ গুন -১০.২ গুন বেশি। ১৯৮১ হতে ১৯৯৩ সালের মধ্যে নদী ভাঙ্গনের ফলে সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় ৭২৯০০০ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ছিল যমুনা নদীর তীর ভাঙ্গনের শিকার। 

চর বিশিষ্ট নদী যমুনা: যমুনা নদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি বিনুনী সদৃশ নদী। নদীর তীর ভাঙ্গনে ও পলি বহনের মাধ্যমে ও তলদেশে জমার ফলে নদীর মধ্যে চরের সৃষ্টি করে। এসব চরের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অস্থায়ী এবং বর্ষা ঋতুতে প্লাবিত হয়ে এর ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে। যেখানে উপনদীগুলো মূল নদীর সাথে মিলিত হয় সেখানে দ্বীপ চর সৃষ্টি হয় এবং যেখানে নদীর স্রোত এক তীর হতে সরে সরাসরি অন্য তীরে যায় সেখানে বালুচর সৃষ্টি করে। যমুনা নদীর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো চর একত্রীকরণের ফলে চরের দৈর্ঘ্য অনেক সময় ৩.০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত হয়। ল্যান্ডসেট ইমেজ হতে দেখা যায় ১৯৯২ সালের শুষ্ক ঋতুতে যমুনা নদীতে ৫৬ টি বড় আকারের চর বিদ্যমান যেগুলোর দৈর্ঘ্য কমপক্ষে ৩.৫ কিলোমিটার এবং ২২৬ টি ছোট আকারের চর বিদ্যমান যাদের দৈর্ঘ্য ০.৩৫-৩.৫ কিমি। 

আরো পড়ুন:  পাগলা নদী বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আন্তঃসীমান্ত নদী

যমুনা নদীর শাখা নদী ও উপনদীসমূহ: যমুনা নদীর অনেকগুলো শাখা নদী বিদ্যমান। এর মধ্যে লোহিত, বুড়ি, নোওয়া, তোলী, দিহাং, মালায়, ধানসিড়ি, মানস, কামাক্ষা, কোপিলি, সুবনসিড়ি, দিহিন্তা ইত্যাদি প্রধান। যমুনা নদী দীর্ঘ পথ অতিক্রমের সময় অসংখ্য উপনদী এসে এর সাথে মিলিত হয়েছে। এর মধ্যে দুধকুমার, ধরলা, তিস্তা এবং করতোয়া, আত্রাই নদী প্রণালী অন্যতম। 

যমুনা নদীর গতিপথের ধরন: প্রত্যেক নদীকে তার গতিপথের উপর ভিত্তি করে তিনটি প্রধান ভাগ করা যায়। যথা: ক) পার্বত্য এলাকার প্রবাহ বা প্রাথমিক গতি, খ) উপত্যকা এলাকার নদীর মধ্যগতি ও গ) সমতল এলাকার নদীর নিম্নগতি। সংগত কারণেই যমুনা- ব্রহ্মপুত্র নদীকে তিন ভাগ করা যায়। নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে আসাম পর্যন্ত উচ্চ গতি বা পার্বত্য প্রবাহ, আসাম উপত্যকা থেকে মাসহারী পর্যন্ত নদীর মধ্যগতি এবং মাঝহারী থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত নিম্ন গতি বা সমতলভূমি অবস্থা। 

যমুনা নদীর পানিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য: যমুনা নদী অববাহিকায় প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয়, কেননা যমুনা নদী অববাহিকায় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এখানে আসামের চেরাপুঞ্জিতে পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয়। তাছাড়া হিমালয়ের বরফগলা পানি ও মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ফলে জুলাই হতে সেপ্টেম্বর মাসে মধ্য ও নিম্নাঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এখানে মৌসুমের শুরু হতে মৌসুমের মাঝে এবং শেষদিকে বন্যা হতে দেখা যায়। 

যমুনা জোয়ারভাটা মুক্ত: যমুনা নদীর আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই নদীতে জোয়ার ভাটা হয় না। 

যমুনা নদীর পানি সমতল ও পানি নির্গমন: যমুনা নদীর চিলমারী, আকুলিয়া, কামারখালী, ফুলবাড়ি, বাহাদুরাবাদ, ভাগ্যনাথ, আরিচা, সিরাজগঞ্জ ও নগরবাড়ি ইত্যাদি স্থানে স্টেশন বসিয়ে পানি সমতল ও পানি নির্গমন উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। ১৯৮৮ সালে নুসাকোয়া স্টেশনের সর্বোচ্চ পানি সমতল ছিল ২৮.৯ মিটার এবং সর্বনিম্ন পানি সমতল ছিল ২০.৯ মিটার। 

যমুনা নদীতে পানি নির্গমন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এই নদীতে বার্ষিক গড় পানি নির্গমন ৪০০০০ কিউমেক। বর্ষাকালে নির্গমন বেশি হয়ে থাকে। সর্বোচ্চ পানি নির্গমন ছিল ১৯৮৮ সালে যার পরিমাণ ছিল ৯৮০০০ কিউসেক। বার্ষিক গড় প্রবাহ বাহাদুরাবাদের নিকট ৫১ মিলিয়ন একর ফুট। 

তলানী বোঝা পরিবহণ ও সঞ্চয়ন: যমুনা নদী প্রায় দশ হাজার বছর পূর্বে অর্থাৎ কোয়াটারনারী যুগে সৃষ্ট চুনবিহীন গাঢ় ধুসর বা বাদামী বর্নের প্লাবন সমভূমি দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কাদা, বালি, পলল কণা এবং সুক্ষ্ম কণার পরিমাণ বেশি। যমুনা নদীর মাধ্যমে বাহিত বোঝার আকার ০.১ মিমি হতে ০.২৮ মিমি। বর্ষা ঋতুতে যমুনা নদী দিয়ে দৈনিক প্রায় ১২ লক্ষ টন পলি বহন করে থাকে এবং বাহাদুরাবাদে পরিমাণকৃত যমুনার বার্ষিক পলিবহন ক্ষমতা প্রায় ৭৩৫ মিলিয়ন টন। 

আরো পড়ুন:  তরকা মনি নদী বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলার একটি নদী

বিপদসীমা: এ নদীতে কিছু পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক বিপদসীমা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। নিম্নে যমুনা নদীর কিছু স্টেশনের বিপদসীমা দেখানো হলো: 

সারণী: বিভিন্ন স্টেশনে যমুনা নদীর বিপদসীমা

স্টেশনের নামবিপদসীমা (মিটার)
চিলমারী২৩.৩২
বাহাদুরাবাদ১৯.৩৫
সিরাজগঞ্জ১৮.৫৬
আরিচা১১.০
গোয়ালন্দ১০.০
উৎসঃ পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা।

১৯৮৮ সালের বন্যার তথ্য হতে দেখা যায় বাহাদুরাবাদে সর্বোচ্চ পানি সমতল ছিল ২০.৭২ মিটার। যা বিপদ সীমার ১.৩৭ মিটার উপরে প্রায় ১০ দিন থেকেছে। এভাবে দেখা যায় প্রায় প্রতি বছরই পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

বন্যা: যমুনা নদীতে সারা বছরের পানি ছকের লাইন গ্রাফ আঁকলে দেখা যায় যে মধ্য জুলাই, মধ্য আগষ্ট এবং মধ্য অক্টোবরের পর থেকে তিনটি পিক পয়েন্ট বিদ্যমান। অর্থাৎ এই নদীতে বছরে তিনবার বন্যা হয়ে থাকে। পানি নির্গমনের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে এবং ডিসেম্বরে ও জানুয়ারী মাসে নির্গমনের পরিমাণ সর্বনিম্ন হয়। সাধারণত পদ্মা ও যমুনা নদী দিয়ে একই সময়ে বন্যা হয় না। তবে ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালে এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে। 

পরিশেষে বলা যায় যে, উপরােক্ত আলােচনার প্রেক্ষিতে যমুনা নদী একটি বেনুনী সদৃশ নদী যার প্রশস্ততা বেশি। গভীরতা তুলনামূলকভাবে কম। এই নদীতে বন্যা বেশি হয়ে থাকে। চরের পরিমাণ বেশি, এ নদীর ভাঙন প্রবণতা বেশি বিধায় বাংলাদেশে অনেকটা হুমকীর সম্মুখীন। এই নদী অনেক সম্পদ নষ্ট করছে। তাই এর অব্যাহত ক্ষয় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে দরকার সুষ্ঠ পরিকল্পনা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনাসহ সুনিপূণ নদী প্রশিক্ষণ কর্মসুচীর। 

Leave a Comment

error: Content is protected !!