টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশ, আসাম ও মেঘালয়ের জনগণের জন্য মরণফাঁদ

টিপাইমুখ বাঁধ বা বরাক নদীর বাঁধ (ইংরেজি: Tipaimukh Dam) হচ্ছে ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদীর উপর একটি প্রস্তাবিত বাঁধ বাঁধ, এটি ১৯৮৩ সালে প্রথম পরওয়ানা হয়েছিল। বলা হয়েছে, বাঁধের উদ্দেশ্য হচ্ছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলবিদ্যুৎ উত্পাদন। প্রকৃত অর্থে বাঁধটি করা হচ্ছে বাংলাদেশ ও পূর্বদেশসমূহের জনগণকে শোষণ, নিপিড়ন ও গরিব করে রাখার জন্যে।

প্রকল্পটি অগ্রসরের সাথে সাথে বারবার বিলম্বের শিকার হয়েছে, কারণ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পানির অধিকার নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, পাশাপাশি বিশাল প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাবের প্রশ্ন আছে। এছাড়াও কটি বিশাল জলাধার নির্মাণের জন্য আদিবাসী হামার লোকদের পুনর্বাসন করার প্রয়োজন রয়েছে।

মেঘনা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদীর উৎসস্থল ভারতে হওয়ায় এই নদী নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে একটি তিক্ত সম্পর্ক বিদ্যমান। ভারত মেঘনার উজানে আসামের বরাক ও তুইড়ী নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ জলাধার নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। ড্যামটির উচ্চতা ১৬১ মি ও দীর্ঘ ৩৯০ মিটার যাতে ১৫.৯ হাজার মিলিয়ন ঘন মিটার পানি মজুদ রাখা যাবে। এই পানি দিয়ে ভারত সেচ নৌ চলাচল ও শুকনা মৌসুমে পানি প্রবাহ বাড়ানোর কাজ চালাবে। 

বাঁধের ফল হবে বন্যা ও খরা উভয়টিই

ভারতের নদী সংযোগ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে বন্যা কমবে না বরং উল্টো হবে। বর্ষার সময় জলাধারে পানি আটকে দিলে বন্যার আশংকা কমবে না বাড়বে তা নির্ভর করবে সে বছরের বৃষ্টিপাতের উপর। বৃষ্টি বেশি হলে জলাধার চাপ সামলাতে পারবে না। তখন জলাধার বাচাতে বিপুল পরিমাণ পানি এক সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হলে মুহুর্তের মধ্যে ব্যাপক এলাকা তলিয়ে যাবে। 

টিপাইমুখ বাঁধ, বাংলাদেশ ও আসাম-মেঘালয়ের জন্য মরণফাঁদ। নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করে পৃথিবীতে কোথাও কোনোদিন লোকসান ছাড়া লাভ হয়নি। বাংলাদেশ এখনো আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। বাংলাদেশ যদি আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশনে স্বাক্ষর করে তবে দিল্লীর এই প্রকৃতিবিধ্বংসী প্রক্রিয়া থামানো যেতে পারে। এজন্য বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশনে স্বাক্ষর করতে হবে এবং সরকারকে এ কনভেনশনকে আইনে পরিণত করার উদ্যোগ নিতে হবে। উল্লেখ্য হাওরাঞ্চলের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশ ও আসাম-মেঘালয়ে মহাবিপর্যয় নেমে আসবে।

আরো পড়ুন:  বাঙলার নদীরা কেন মরে যায়?

পরিবেশের উপর বিরূপ প্রক্রিয়া

বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় নদীমালার মূল নদীর বরাকের ওপর ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করছে। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি রাজ্যসহ মােট ৯টি রাজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে । 

‘বরাকড্যাম’ নামে পরিচিত এই বাঁধটি বরাক নদীর ৪০ কিলোমিটার উজানে টিপাইমুখে নির্মিত হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি রুপি। 

এই বাঁধ নির্মিত হলে বৃহত্তর সিলেট জেলায় বর্ষা ও শুকনাে মৌসুমে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় এই শ্যামল ভূভাগে উত্তরাঞ্চলের ন্যায় মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। এছাড়া হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সিলেটের ভূতাত্ত্বিক গঠন প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হবে বলে ভূবিজ্ঞানীগণ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। 

বাংলাদেশের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী ভারত থেকে প্রবাহিত বরাক নদীর স্রোতধারাবাহী শাখা-নদী। বরাক নদী কাছাড় জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বদরপুরের নিকট সিলেটে প্রবেশ করেছে। সিলেট থেকে ১১ কিলােমিটার প্রবাহিত হয়ে তা দু’প্রধান শাখায় বিভক্ত হয়েছে। উত্তরের শাখা সুরমা ও দক্ষিণের শাখা কুশিয়ারা নাম ধারণ করেছে । মনু ও ধলাই সুরমা কুশিয়ারারই উপনদী।

ভূবিজ্ঞানীদের মতে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা অর্থাৎ এই বাঁধের এলাকা অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ। এই এলাকায় বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন ভূতাত্ত্বিক বিচারে একেবারে সমীচীন নয়। ভূবিজ্ঞানীগণ বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় যেমন মাঝে মাঝে ভূকম্পন হয়ে থাকে তেমনি ভূকম্পন একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় আঘাত হানবে। 

১৯৮৪ সালে পূর্ব কাছাড় জেলায় প্রচণ্ড ভূকম্পন অনুভূত হয়। এতে ১১ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে। অসংখ্য ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। এই ভূকম্পনের পর বরাক নদীর একটি পাড় তলিয়ে যায় । 

বরাক বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে সিলেটবাসী বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ১৯৯৫ সালের ৪ জুন লন্ডনে সিলেট বিভাগ উন্নয়ন পরিষদ যুক্তরাজ্য শাখা ভারত ও বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষোভ শেষে উভয় দূতাবাসে স্মারকলিপি পেশ করা হয়।[১]

আরো পড়ুন:  ফারাক্কা বাঁধ এবং বাংলাদেশের পানি সম্পদের ওপর এই বাঁধের প্রভাব

তথ্যসূত্র

১. আবদুস সাত্তার, “কতিপয় মিনি ফারাক্কা” বেনজীন খান সম্পাদিত, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ: বাংলাদেশের বিপর্যয়, কথাপ্রকাশ ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৯, পৃষ্ঠা ২১৮-২১৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!