শিল্প, ছবি ও ভবিষ্যৎ

আজকাল যখন-তখন লােকে বলে, শুনতে পাই, বাংলা তথা ভারতীয় ছবি গােল্লায় যাচ্ছে।

কথাটা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যে। আমি ইদানীং কিছু কিছু ছবি দেখার অবকাশ পেয়েছি। সেগুলি আমার মনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। যেমন ধরুন, একটি মারাঠী ছবি সম্প্রতি আমার দেখার অবকাশ হয়েছিল। ছবিটির নির্মাতা এবং চিত্রকার আমার বহুপরিচিত এবং শিষ্যস্থানীয় ; ছবিটির নাম শান্ততা, কোরট চালু আহে’- সায়লেন্স, দ্য কোট ইজ অন।

অন্তত গত দশ বছরে ভারতবর্ষের কোনাে ছবি এর থেকে উন্নততর হয় নি। সব প্রদেশের সব ছবির কথা ভেবেই এ কথা বলছি। আমার গােটা অভিজ্ঞতার ভিত্তিকে না ভুলেই এ কথা বলছি। 

কলকাতাতেও কিছু কিছু ছেলেদের আমি দেখছি, যারা বড়াে ভাবে ভাবছে। এবং বড়াে কিছু করার চেষ্টা করছে, এদের ভােলা যায় ?

আমরা, যারা শৈল্পিক দিক থেকে গত হয়েছি, এবং বড়াে বড়াে বকুনির পেছনে আশ্রয় গ্রহণ করছি, তাদের নিয়ে নাচানাচি করে আর লাভ নেই। আমরা ক্রমশই কী করে বসছি, সে মালগুলাে (বস্তির ভাষা হয়ে গেল, না?) দেখলেই বােঝা যায়।

সমসাময়িক ভারতীয় ছবি সম্বন্ধে আমার সত্যিই কিন্তু কিছু বলার কোনাে অধিকার নেই। কারণ, আমি ব্যক্তিগত দুর্বলতা এবং অন্য কিছু কারণে যাকে লােকে ফিচার ফিল্ম বলে, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে গত দশবছর জড়িত নই। তার সঙ্গে সঙ্গে ছবি দেখার স্পৃহাও আমার কমে গেছে। বিশেষ করে, এদেশে দেবতুল্য ব্যক্তিদের শেষের দিকের প্রায় কোনাে কাজই দেখি নি। তাই যখন এদের ব্যাপারে সমালােচকের ভূমিকা নেবার কথা কোথাও ওঠে, আমার লজ্জা করে। নিজেকে চোর বা তারও কিছু অধম মনে হয়। 

তেমনি লজ্জা করে যখন নতুনের দল আমার কাছে এসে আমার নিজের যৎসামান্য ছবিগুলাে সম্পর্কে প্রশ্ন করে।

এ-সব কথার কী জবাব দেব মশায় ?

আমার কোনটি সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি? কী করে এদের বােঝাব, আমার কোনটি ছবিই না। অবস্থা বিপাকে মাস্টারি করতে হয়েছিল একদিন। আজও কিছু কিছু করতে হয়। তার ফলে, এখন যখন ভারতের কোনাে প্রান্তে যাই, আমার প্রাক্তন ছাত্রদের সঙ্গে দেখা হয়। দেখি, তারা লড়ে যাচ্ছে। নিজের নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী।

আরো পড়ুন:  শিল্প মানেই লড়াই ...

তাদের মধ্যে এলােমেলাে ভাবে যাদের নাম এই মুহুর্তে মাথায় আসছে, তাদের কথা বলি।

জয় বলে একটি ছেলে। কেরালার। অসম্ভব সংবেদনশীল। শুনেছি, একটা ছবি করেছে। চলে নি।

কুমার সাহানী। পাঞ্জাবকাশ্মীরের ছেলে। পায়ে পােলিও’ আছে। দেহে খানিকটা অক্ষম। পরিচালক হিসাবে কিন্তু প্রচণ্ড ক্ষমতাবান। ছবি আরম্ভ করেছে। ও পুনা ফিল্ম ইনসটিটিউটের প্রথম পুরস্কার, স্বর্ণপদক পেয়েছিল (তখন আমি ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত)। ওর উপরে আমার অগাধ ভরসা। 

শুক্লা। লখনউয়ের ছেলে। তথ্যচিত্র করেছে, শীঘ্রই বেরােবে। পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি করার কথা ভাবছে। ওর ভাবনা সফল হােক।

দুলাল সাইকিয়া। গৌহাটির ছেলে। একটা তথ্যচিত্র করেছে। লােকে ভালাে বলেছে। এবার বড়াে ছবির কাজে হাত দেবে।

মণি কাউল। পাঞ্জাবের। “উস্কী রােটী” করেছে। দেখি নি, এখনও। কাজ কিছু স্টিলটেড’, ‘পােজ’ করবার প্রবণতা বেশি। কিন্তু বুদ্ধিমান। বয়স বাড়লে মনে হয় ওই গােলমালগুলাে কেটে যাবে।

চন্দ্রশেখর নায়ার। অন্ধ্রের ছেলে। ফিলমস ডিভিশনে পেটের দায়ে কাজ নিয়েছে। ভেতরে আগুন।

এরকম আরও কত ছাত্রের কথা বলতে পারি। এখনও যারা শিখছে, তাদের মধ্যেও স্পার্ক দেখতে পেয়েছি। আরও পাব।

ডিরেকশন-এর কথা এখন থাক্। ক্ষমতাবান নতুন টেকনিশিয়ানদের প্রসঙ্গে আসি। যাদের কাজের জোরে বহু বাজে ছবিও ভদ্র হয়ে যাচ্ছে। অনেক নিচু ক্লাসের ছবি যেমন কে কে মহাজনের ফটোগ্রাফির জন্য উৎরে গেছে। গুরহা, অমরজিৎ, ধ্রুবজ্যোতি, কাউল, সাহানী- এরকম কত নতুন ক্যামেরাম্যানের নাম করা যায়।

আশা করি, আমার পয়েন্টটা এতে পরিষ্কার হয়েছে। সাউন্ড, এডিটিং, আর্টডিরেকশন- প্রত্যেক বিভাগে এমন সব ছেলে এগিয়ে এসেছে, আসছে। সংগীতে কলকাতার এক সুরকারের নাম মনে পড়ছে। হাদয় কুশারী। এক সময়ে যখন বগলার বঙ্গদর্শন’ করছিলাম, যা বেশি দূর এগােয় নি, তখন এই তরুণ সুরকার আমার সঙ্গে কাজ করেন। এর প্রতিভা আছে।

অভিনয়ের দিকটাও বাদ দেবার নয়। হিন্দী ছবির ক্ষেত্রে রেহানা, শক্রয়, নবীন নিশ্চল, অমিতাভ প্রভৃতি অনেক নতুন ছেলেমেয়ে কাজ করছে। ওরা একটি নতুন আবহাওয়াও সৃষ্টি করছে।

আরো পড়ুন:  নগ্নতা এবং চলচ্চিত্র

এখানেই শেষ নয়। অবশ্যই না। ইনসটিটিউটের ছাত্ররা ছাড়াও আছে প্রতিভাবান চিত্রকার। বাসু ভট্টাচার্য, বাসু চট্টোপাধ্যায়, বাবুরাম ইসারা- এরা কিছু করতে চায়, করবে বলেই বেরিয়েছে।

কলকাতাতেও এই লক্ষণ আছে। কিন্তু কলকাতায় আমি এখন বিদেশী। মাঝে মাঝে শুনি, মনে লাগে।

আমাকে ভীষণ ‘পার্ট অব দ্য এক্টাবলিশমেন্ট মনে হচ্ছে, না? ঘটনাটা ঠিক তা নয়। আমি যা, তা-ই। আমার সাধ্যমতাে কাজ করে যাব, বাঁচি আর মরি। সে যাক। যা বলছিলাম।

যাদের নাম উল্লেখ করেছি, তাদের সকলের ক্ষমতা একরকম নয়। হওয়ার কথাও না। সবাই সফলও হয়তাে হবে না। কিন্তু এই ডামাডােলের মধ্য দিয়েই কিছু একটা বেরােবে। বড়াে কিছু।

এব্যাপারের অর্থনৈতিক পটভূমিকা সম্পর্কে আমার প্রচুর বক্তব্য ছিল। জমা রইল। যদি কখনাে পরে কুম হয়, হাজির হব।

এবার শিল্পের তত্ত্বগত দিক নিয়ে দুই-এক কথা। এ ব্যাপারে ভাবালুতা (যা সােজাসুজি ন্যাকামি মনে হয় আমার কাছে) পছন্দ করি না।

জন শ্লেজিঞ্জার কোথাও কোনাে কাগজে বলেছিলেন যে, শিল্প শুধু শিল্পই। এইটা সম্পর্কে আমার যথেষ্ট আপত্তির একটা অবকাশ আছে। এই লােকটি কী কী ছবি করেছেন সব আমার জানা নেই, কারণ আমি ছবি সম্পর্কে ঐতিহাসিক হতে পারি নি। কিন্তু তথাকথিত ব্রিটিশ নিউ ওয়েভকে পুরােপুরি ঘেঁটে দেখেছি। লিনডসে অ্যানডারসন প্রমুখ পরিচালকরা আমাকে অভিভূত করেন নি। একমাত্র ‘এ কাইন্ড অব লাভিং’ আমাকে পাগল করেছিল। বিশেষ করে ওই ছবির শেষ দৃশ্যে মেয়েটির কাজ ভােলা যায় না। ওখানে মানবিকতার একটা চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে।

সিনেমা ভেরিতে, আন্ডার গ্রাউন্ড সিনেমা, Pseudo-existentialism- এই সব বাড়তে বাড়তে কথার মােহে কিছু ব্যক্তি পড়ে গেছেন। এদেরকে কৃপা করা উচিত। এরা শিক্ষিত নন।

যা বলছিলাম। জন শ্লেজিঞ্জার একটি নিরালম্ব বায়ুভূত দর্শনের কথা বলেছেন যেটা বাচ্চাদের মুখ দিয়ে সাবানের ফেনা দিয়ে বুদবুদ ওঠানাের মতােই ক্ষণস্থায়ী। অবশ্য কোনাে শিল্পই চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু কিছু শিল্প মানুষকে কিছুদিনের জন্য এগিয়ে দেয়। কিন্তু এরা হচ্ছে যমের দূত। আজকের কাগজে এদের চটকদারি কথা শােনা যাবে, কাল এদের কেউ মনে রাখবে না।

আরো পড়ুন:  ঋত্বিক ঘটক বাংলা ভাগে যন্ত্রণাবিদ্ধ বাংলা ভাষার এক মহান চলচ্চিত্র পরিচালক

করুণা করার ক্ষমতা আমার যদি থাকত, তবে এদেরকে অল্প-অল্প ক্ষমা করতাম। পারব না। লড়াইয়ের ক্ষেত্রে দাড়িয়ে যােদ্ধা কাউকে ক্ষমা করে না।

এইখানেই তবে প্রশ্ন তুলছি : শিল্পী কমিটেড কি না, শিল্পী কোথাও বাধা আছেন। কি না।

কমিটমেন্ট কথাটার মানে কী? নিজেকে কোথাও সংলগ্ন করে রাখা। কার সঙ্গে সংলগ্ন করব? সংলগ্ন করতে হলে একটা দ্বিতীয় পক্ষ লাগে। যেমন, আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে পড়েন। তা হলে সেই মহিলাটিকে লাগে। শিল্পীর জীবনেও তাই। তাকে কোথাও না-কোথাও লাগতে হবে। আপনি কি শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর সংলগ্নতার কথা বলছেন? সেই সংলগ্নতা নিজের সঙ্গে যদি করতে পারেন তা হলে দয়া করে ভগবান বুদ্ধের সঙ্গেই করুন না!

যদি না পারেন, তবে বাইরের একটা বস্তু খুঁজতেই হবে। সেটা কী? 

মানুষ।

শিশু। 

জীবন মৃত্যুকে অস্বীকার করে। সকল শিল্প-কে তাই হতে হবে জীবন অনুগামী। 

জন্মই জীবন। 

শিল্প জন্ম।

এই কথাটা আমরা কখনাে ভুলে যেন না যাই। যত ক্লেদাক্ত, বিষাক্ত অভিশাপের ভিতর দিয়ে আমাদের বেরতে হবে, হবে। শিল্প আমাদের এই দায়িত্ব দিয়েছে।

বড়াে বড়াে কথা না বলে এই শেষ কথাটাকে যেন আমরা মনে রাখি। তা হলে হয়তাে আমরা আখেরে কিছু গুছাতে পারব।

Leave a Comment

error: Content is protected !!