কালমেঘ-এর ভেষজ গুণাগুণ ও ঘরোয়াভাবে প্রয়োগ পদ্ধতির বর্ণনা

কালমেঘ (Andrographis paniculata) একটি বর্ষজীবী উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদ ১ থেকে ৩ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট হয়ে থাকে। কাণ্ড অনেকটা চারকোণ বিশিষ্ট। এদের পাতা সরল ও ছোট বোটাযুক্ত। পাতা ২ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা, পাতার কিনার মসৃণ, সূক্ষ্মাগ্র, জালিকা ও শিবিণ্যাসযুক্ত। মঞ্জরী লম্বাটে, ফুল দেখতে ছোট, বৃতি গ্রন্থিযুক্ত, পাপড়ি দুই ওষ্ঠযুক্ত; পুংকেশর পাপড়িলগ্ন, গর্ভকেশর দুটি ও সংযুক্ত; এদের ফল ক্যাপসিউল, লম্বা, অনেকটা সিলিন্ড্রিকেল, সাধারণত ফলে ১২টা বীজ থাকে। বর্ষার শেষ হতে শীতকাল পর্যন্ত ফুল ও ফল হয়।

কালমেঘ-এর অন্যান্য নাম:

এর সংস্কৃত নাম যবতিক্তা, বাংলায় প্রচলিত না। কালমেঘ ও হিন্দীতে মহাতিয়া বলে। এর লোকায়তিক নাম কল্পনাথ। বৈজ্ঞানিক নাম Andrographis paniculata Nees, ও ফ্যামিলি Acanthaceae।

বিস্তার:

কালোমেঘ বাংলাদেশে প্রায় সকল জেলাতেই জন্মে থাকে। তবে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অধিক দেখা যায়। এটি ভারতের সর্বত্রই পাওয়া যায় তবে অঞ্চল বিশেষে বেশীও হয়, এছাড়া পতিত জমিতেও এটি দেখা যায়।

কালমেঘ-এর প্রয়োগ:

প্রথমেই জানা দরকার যে, কালমেঘের রস আয়ুর্বেদীয় দৃষ্টিতে কিভাবে দেহের কোথায়, কোন অংশে প্রধানভাবে কাজ করে। প্রথমতঃ যেভাবে রস, গুণ হিসেবে বিচার করা হয় সেটা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। বীর্যবত্তায় এটি যে শক্তি নিয়ে থাকে সেটা পুষ্টিকর হিসেবে কাজ করে, অতএব এর বীর্যবত্তা খুবই উল্লেখযোগ্য, কিন্তু কাজ করে বিপাকে এবং বিপাকে কাজ করতে গেলে সেটা রসবহ স্রোতের মাধ্যমে; এ কিন্তু স্থায়ী হয় না, এটা বিপাকে কাজ করে বলেই রক্তবহ স্রোতে এর কার্যকারিতা প্রকাশ পায়। অতএব কালমেঘের প্রধান বিবেচনা হলো যে, এটা রসপ্রধান নয়, এটি বীর্যপ্রধান—এটি যাবতীয় রক্তগত ব্যাধির ক্ষেত্রে যেমন রক্তদৃষ্টি—পিত্ত এবং রক্ত উভয়ে পাশাপাশি একধমী থাকে বলে পিত্তগত অশ্লপিত্ত, চুলকণা, খোস-পাচড়া হয়। কেন আমরা এটা বলি যে, দেহের সাতটা ধাতুতেই বায়ু-পিত্ত-কফ তার প্রভাব নিয়ে থাকে অর্থাৎ পিত্ততে তাপ প্রধান, রস অপ্রধান ও বায়ু, অপ্রধান। এই যখন দেহধাতুর বিচার বিবেচনা, সেক্ষেত্রে কালমেঘের রস বীর্যগত কাজ করা অপেক্ষা এর বিপাকে কটুতা আসে না বলেই এই কালমেঘ বিপাকপ্রধান দ্রব্য, তাই সে রক্তবহ স্রোতে সর্বাধিক কাজ করে, তাই আমরা একে যকৃত এবং প্লীহাগত অর্থাৎ রক্তবহ স্রোতের মূল কেন্দ্র হলো যকৃত এবং প্লীহা, তাই সে সেখানেই তার ক্রিয়া প্রকাশ করে।[১]

আরো পড়ুন:  মচকুন্দ গাছের ভেষজ গুণাগুণ ও উপকারিতা

গুণাগুণ:

কালমেঘের সাধারণ গুণ হলো- এটি তিক্তরস, অগ্নিপীপক, রুচিকর, রেচক, বলকারক, কৃমিনাশক, জ্বরাতিসবার নাশক। ইহা কোষ্ঠ, রক্তদোষ, আমদোষ ও বিষদোষে উপকারী। কালমেঘের ব্যবহার্য অংশ হচ্ছে- সমগ্র গাছ। গাছের প্রায় সব অংশই ব্যবহার করা যায়; বিশেষ করে পাতার রস খুবই উপকারী।[২]

রোগ নিরাময়ে কালমেঘের ব্যবহার: 

১. ক্রিমিতে: কালমেঘের পাতার রস ৩০ থেকে ৩৫ ফোঁটা ও কাঁচা হলুদের রস ৩০ থেকে ৩৫ ফোঁটা একসঙ্গে করে সামান্য চিনি মিশিয়ে সকালের দিকে একবার এবং বিকেলের দিকে একবার খেতে হবে। তবে এটা পূর্ণ মাত্রা। তবে গর্ভবতী, শিশু, বা বৃন্ধের জন্য মাত্রা কত দেওয়া হবে সেটা চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।

২. পেটের দোষ: একে আয়ুর্বেদীয় ভাষায় বলা হয় উদরাময় বা অতিসার, এই রোগটি জন্ম নেয় অগ্নিমান্দ্য থেকে। তার ওপর যারা খাওয়ার বাছবিচার না করে তার উপর যথেচ্ছভাবে খেয়ে যান, তাঁরাই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এ রোগ যাঁর হয় তিনি জেনে রাখুন, এমন কোন রোগ নেই যা অগ্নিমান্দ্য থেকে হয় না, যদি তেমন কারণে উদরাময় হয় তবে তৎক্ষণাৎ সকালে বৈকালে চা-চামচের আধ চামচ করে জল মিশিয়ে খেতে হবে।

তবে উল্লেখযোগ্যভাবে উপকার পেতে গেলে লবঙ্গ অল্প ভেজে ওটাকে গড়ো করে রাখতে হবে, তা থেকে একটিপ নস্যির মত নিয়ে ঐ কালমেঘের রসের সঙ্গে মিশিয়ে দু’বেলাই খেতে হবে। এইভাবে ৩/৪ দিন খাওয়ার পর থেকে উদরাময়টার উপশম হবে এবং ক্ষিধেও বেড়ে যাবে।

৩. অম্ল ও অজীণে: এই ক্ষেত্রে কালমেঘ পাতার রস আধ চা-চামচ, তার সঙ্গে বড় এলাচের দানা চূর্ণ ২ টিপ নস্যির পরিমাণ মিশিয়ে সকালে খেলে এই দুটি রোগ উপশম হয়, তবে প্রয়োজনবোধে দু’বেলাই খাওয়া যায়। এটাও ঠিক যে, আহারাদির বাছবিচার না করলে এ অসুখের উপশমও হয় না। অম্লরোগের উপশমের অন্তরায় হলো যে কোন মিষ্ট দ্রব্য, এমনকি মিষ্ট ফলও ভাল নয়।

৪. রক্তামাশয়ে: এই রোগটি আসে, যেক্ষেত্রে অতিসার রোগ ভাল সারেনি, তার ওপর খাওয়া দাওয়া অত্যাচার চলছে, সেখানে প্রথমে হয় আমাশা, তারপর কয়েকবার দাস্ত হওয়ার পর মলের সঙ্গে রক্ত পড়তে থাকে। সেক্ষেত্রে কালমেঘের পাতার রস ১৫ ফোঁটার সঙ্গে মুথো চূর্ণ ১৫০ মিলিগ্রাম (দেড় রতি আন্দাজ) মিশিয়ে সকলের। দিকে একবার ও বৈকালের দিকে একবার খেলে দু’দিনের মধ্যেই রক্ত আমাশাটা সেরে যাবে।

আরো পড়ুন:  বালম ক্ষীরা বিশ্বে বিপদমুক্ত এবং বাংলাদেশের দুর্লভ বৃক্ষ

৫. দূষিত জ্বরে: সে যে কোন প্রকারেরই হোক— সে ম্যালেরিয়া ঘটিতই হোক আর অন্য কোন জীবাণুঘটিতই হোক, আভ্যন্তরীণ প্রদাহজনিত জ্বর, স্যাঁৎসেতে জায়গায় বাস করে ঘুসঘুসে জ্বর হ’লে কি দীর্ঘদিন পাড়ুরোগে (এনিমিয়ায়) ভুগে জ্বর হচ্ছে, রক্তের তাপমাত্রা কমে গিয়ে যে জ্বর হয়ে থাকে, এসব ক্ষেত্রে কালমেঘের পাতার রস ১৫/২০ ফোঁটা জল মিশিয়ে দিনে ২ বার বা ৩ বার খাওয়ালে এই জরের উপশম হবে এবং কয়েকদিন ব্যবহার করলে ওটা নিরাময় হবে।

বাংলার কবিরাজ সম্প্রদায় পুরাতন রীতিতে এই কালমেঘ রসে যোয়ান ভিজিয়ে রাখতেন অর্থাৎ ৮ ভাগ কালমেঘ রস, ১ ভাগ যোয়ান, ৮ ভাগ গড়ে দিয়ে কোন মাটির পাত্রে বা চীনা মাটির পাত্রে ১৫/২০ দিন ভিজিয়ে রাখতেন, তারপর তাকে চোলাই করে যেটা পাওয়া যেতো সেইটা ওই পুবোক্ত জ্বরে ৫/৭ ফোঁটা জলের সঙ্গে মিশিয়ে দিনে ২/৩ বার খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন।

৬. পচা ঘায়ে: সে যেকোন রকমেরই ঘা হোক না কেন, কালমেঘ পাতা সিদ্ধ করে সেই জল দিয়ে ঘা ধোওয়ালে অবশ্য ৩/৪ দিনের (অন্ততঃ ২ বার ধোয়াতে হবে) মধ্যেই ঐ ক্ষত আরাম হবে।

৭. বাচ্চাদের পেটের সমস্যায়: কালমেঘ সচরাচর বাচ্চাদের রোগের জন্য ব্যবহৃত হয়। তাদের জ্বর, কৃমি, অজীর্ণ, লিভার দোষ প্রভৃতি রোগে কালোমেঘের পাতার রস ভাল কাজ করে থাকে। বাচ্চাদের জন্য কালোমেঘের রস সর্বদাই অতি কল্যাণকর ঔষধ।

আবার দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, গোলমরিচ প্রভৃতি কালমেঘের পাতার রসে পিষে ওষুধ প্রস্তুত করা যায়। এই ওষুধ শিশুর পেটকামড়ানি, অগ্নিমান্দ্য ও কোষ্ঠবদ্ধতায় সারাতে ব্যবহার করা হয়। কালোমেঘ পাতার রস ক্ষুধাহীনতা, পেটে গ্যাস জমা, বাচ্চাদের অজীর্ণ, আমাশয়, উদরাময় এবং সাধারণ দুর্বলতায় প্রয়োগ করা হয়। কালোমেঘের মূল এবং পাতা কৃমিনাশক, শক্তিবৃদ্ধিকারক এবং বায়ুপিত্ত নাশক। কালোমেঘে থেকে ওষধ প্রস্তুতি করার জন্য তাজা পাতা ৩৫০ গ্রাম এবং স্ট্রং অ্যালকোহল ৮০০ গ্রাম। একত্রে উপযুক্ত পাত্রে নিয়ে ঝাকানোর পর তাকে ছেকে নিয়ে মাদার টিংচার ওষুধ প্রস্তুত করা যায়।

৮. ছোটদের লিভারের সুস্থতায়: ছোট ছেলেমেয়েদেরকে এক চামচ পরিমাণ কালমেঘের পাতার রস প্রত্যহ সকালে খাওয়ালে তাদের যাবতীয় লিভার দোষ আরোগ্য হয়। তাছাড়া সামান্য মধুসহ ৮/১০টা পাতার রস খাওয়ালে তাদের কোষ্ঠকাঠিন্য ভালো হয়ে যায় বা শক্ত পায়খানা সহজ হয়।

আরো পড়ুন:  কাঁঠাল-এর দশটি ভেষজ গুণাগুণ ও এর বিবিধ ব্যবহার

ছোট ছেলেমেয়েরা সাধারণত তিতে জাতীয় ওষুধ খেতে চায় না বলে কিছু মসলা সহযোগে আলু মিশ্রিত ভর্তা বানিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। এতে জিরে, দারচিনি ও বড় এলাচের খোসা সমান সমান নিয়ে কালমেঘ পাতার রসে পেষণ করেও ওষুধ তৈরি করে খাওয়ানো যেতে পারে।

কালমেঘ-এর প্রস্তুতকৃত ওষুধের ব্যবহার:

১. মুখে খারাপ স্বাদ, বিশেষ করে তিতো, কখনও পচা স্বাদ রোধ করলে উক্ত ওষুধ খাওয়ানো যেতে পারে।
২. জিহ্বায় ময়লা জমে এবং জিহ্বার অগ্রভাগ সামান্য লাল হলে উক্ত ওষুধ বিশেষ উপকার করে।
৩. ঢেকুর উঠে, অজীর্ণ , গলা ও বুক জ্বালা, পেট ফাপা, পেটের ভিতর ভট ভট করা ও বায়ু নিঃসরণ হলে উক্ত ওষুধ খাওয়ানো যেতে পারে।
৪. প্লীহা ও লিভার বড় হলে এবং বেদনা অনুভূত হলে উক্ত ওষুধ সেবনযোগ্য।
৫. মানসিক বিষন্নতা, স্মৃতিহীনতা প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দিলে উক্ত ওষুধ সেবনযোগ্য।
৬. চোখ, মুখ ও হাত-পা জ্বালা করলেও উক্ত ওষুধ বিশেষ কাজ করে।
৭. কোষ্ঠাবদ্ধতা সহ বাচ্চাদের জণ্ডিসে কালমেঘ বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়।[১][২]

CHEMICAL COMPOSITION

(a) Alkaloids viz., Kalameghin; (b) A bitter principle andrographolide; (c) Sterols.[২]

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৪, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ২৮-৩০।

২. মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী: ‘গাছ-গাছড়ায় হাজার গুণ ও লতাপাতায় রোগ মুক্তি, সত্যকথা প্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ২০০৯, পৃষ্ঠা, ৪৬-৪৯।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: H. Zell

Leave a Comment

error: Content is protected !!