চিরসবুজ এই গাছটি সমগ্র ভারতবর্ষে অল্পবিস্তর রোপিত হয়, এমন কি ৪০০০ ফুট উচু পর্যন্ত স্থানেও এটি পাওয়া যায়। এটি বট অশ্বত্থের মতো বৃহদাকার হয় না বটে, তবে দীর্ঘদিনের হ’লে ৫০ থেকে ৬০ ফুট পর্যন্ত উচু হতে দেখা যায়। গাছের ছাল ধূসর, কাঠ খুব একটা শক্ত নয়, মিহি আঁশ, রঙ হলদে, পাতার আকার লম্বায় ৬ থেকে ৭ ইঞ্চি এবং চওড়া ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি হয়। পাতার আগাটা অর্থাৎ অগ্রভাগটা ডিমের আকারের মতো এবং ঈষৎ পুরু। গাছের গায়ে ও শাখায় সবুজ রঙের কাঁঠাল হয়—এক একটা বৃহদাকারও হয়। অপক্কাবস্থায় একে আমরা এঁচোড় বলি এবং তরকারি হিসেবে সেটাকে ব্যবহার করি। গাছে ও ফলে দুধের মতো সাদা চিটচিটে আঠা, গায়ে লাগলে আর ছাড়তে চায় না। বাংলাদেশ, পশ্চিমবাংলা এবং মাদ্রাজ অঞ্চলে এই গাছ যত্রতত্র হয়ে থাকে। সুতরাং এর বিশেষ পরিচয় নিষ্প্রয়োজন।
কাঁঠালের (Artocarpus heterophyllus) ফল কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থাতেই উপাদেয় খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কাঁচা ফল কষায়ধর্মী এবং পাকা ফল মৃদু, বিরেচক গুণসম্পন্ন।
১. কাঁঠালের কচি পাতা বিবিধ চর্মরোগে ব্যবহৃত হয়।
২. কাঁঠাল গাছের আঠা গ্রন্থি ফুলায় এবং ফোঁড়া পাকানোর জন্য প্রলেপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
৩. কাঁঠাল গাছের শিকড় অতিসারে খেতে দেওয়া হয়।
ব্যবহার:
স্বাদ, গন্ধ, রস এবং প্রতিটি অংশের ব্যবহারে এ ফল তুলনাবিহীন। ফলের বাকল বা খোসা গরুর প্রিয় খাদ্য। ফলের শাস সুস্বাদু এবং খাদ্যমূল্যে সমৃদ্ধ। এর বীজ উপাদেয় সবজি; যা আলুর সমতুল্য। বীজ রোস্ট করে গুঁড়া দিয়ে তৈরি চা সুস্বাদু এবং হৃৎপিণ্ড-উদ্দীপক। শুধু ফল নয়, এর কাঠ (গাঢ় হলুদ রঙের) মসৃণ, আসবাবপত্রের চমৎকার উপাদান। কাঠের হলুদ রং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কষায়বস্ত্রের রঞ্জক।
কাঁঠাল-এর ভেষজ গুণ:
কাঁঠাল শুধু ফল হিসাবে নয়, সুপ্রাচীন আয়ুর্বেদের সেই স্বর্ণময় যুগে এর ওষুধি গুণাগুণ সে সময়ের প্রেক্ষিতে মূল্যায়িত হয়েছিল। সেই সুপ্রাচীন কালের পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ আজও আমরা সঠিক বলেই দেখে থাকি। প্রায় সবক্ষেত্রেই কাঁঠালের ফলের মধ্যে ওষুধি গুণাগুণ খোঁজা হয়েছে। এর পাতা, পাকা ও কাঁচা কাঁঠালের (যাকে আমরা এঁচোড় বলি) দ্রব্যশক্তি এবং কাঁঠালের বীজ নিয়েও উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্লান্তিতে বা দৌর্বল্যে কাঁঠালের রস ৩-৬ চা-চামচ মাত্রা আধ কাপ দুধের বা পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে ক্লান্তি বা দুর্বলতা কেটে যাবে। তবে যাদের সর্দি হয়েছে বা সর্দির ধাতু আছে, তারা কাঁঠালের রস খাবেন না।
১. হৃৎপিণ্ডের সুস্থতায়: হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতায় এঁচোড় পানিসহ বেটে হেঁকে সে রস ৪ থেকে ৫ ফোঁটা অল্প দুধসহ দিনে তিনবার খেলে ঐ দুর্বলতা কমে যাবে।
২. মাংসপেশির সবলতায়: যাঁরা মাংস খাওয়ার পরিমাণ ক্রমেই বাড়াতে থাকেন, পরিণামে তাঁদের মাংসগ্রন্থিগুলো ক্রমেই শক্ত হয়ে যায়। মাংস খাওয়ার একটা উপকারিতা আছে, কিন্তু সব মাংস সবার ক্ষেত্রে উপকারী নয়, সে দিকটা বিচার করে পরিমাণমত মাংস খেলে কোন অসুবিধে হয় না। যেক্ষেত্রে মাংসের বাছ-বিচার না করে ক্রমেই পরিমাণ বাড়ানো হয়, সেক্ষেত্রে তারই পরিণতিতে শিরাগুলো ক্রমশঃ মোটা হতে থাকে, অধিকন্তু মাংসগ্রন্থিগুলিও শক্ত হয়, শেষে মাংসজ বাতের পীড়া এসে হাজির হয়। মাংসজ বাত একবার ধরলে হঠাৎ ছেড়ে যাওয়ার কোন লক্ষণ, সহসা দেখা যায় না । এক্ষেত্রে কাঁঠালের মধ্যস্থিত শক্ত দণ্ডটি কুচি কুচি করে কেটে ৪ থেকে ৫ গ্রাম নিয়ে ২ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে এবেলা-ওবেলা দু’বেলা খেলে ও-রোগটা সেরে যাবে।
৩. চর্মরোগ সারাতে: দাদ, একজিমা, হাজা বা চুলকানি প্রভৃতি রোগে কাঁঠালের কচি পাতা ২ থেকে ৩টি থেঁতলিয়ে ২ কাপ পানিতে দিয়ে ভালোভাবে সেদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে নিয়ে সকালে-বিকালে দুবার ঐটা খেতে এবং ঐ পানি আরও তৈরি করে ক্ষতস্থান ধুলে দ্রুত নিরাময় হবে।
এর থেকে তেল তৈরী করে রাখলেও হতে পারে (১০০ গ্রাম সরিষার তেল কড়ায় চাপিয়ে মদ, জাল দিতে হবে। তেল নিক্ষেন হলে অর্থাৎ তেলে ফেনা মরে গেলে কাঁঠাল পাতা বাটা আন্দাজ ১০ গ্রাম তাতে দিয়ে ভেজে নিলে তেলটি তৈরী হয়। তবে মনে রাখতে হবে বাটাটি যেন পড়ে না যায়, আবার কাঁচাও যেন না থাকে।)
৪. একশিরায়: আয়ুর্বেদ সংহিতায় উল্লেখ দেখা যায় যে কাঁঠালের শিকড় কোমরে বাঁধলে একশিরা। (হাইড্রোসিল) আরাম হয়।
৫. ফোঁড়া সারাতে: ফোঁড়া পাকাতে কাঁঠালের আঠা ফোঁড়ার চারদিকে লাগাতে হয়।
৬. বিষনাশক: পাকা পাতার রস শিরঃশূলনাশক। পাতার রস সাপের বিষের প্রতিষেধক।
৭. ক্লান্তি দূর করতে: যেকোন কারণে পরিশ্রান্ত অথবা ক্লান্ত হ’লে কাঁঠালের রস ৩/৪ চা-চামচ মাত্রায় নিয়ে আধ কাপ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে ক্লান্তিটা চলে যাবে। এক্ষেত্রে একটা কথা জানিয়ে রাখি যাঁদের সর্দির ধাত কিংবা সর্দি হয়েছে, তাঁরা পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও কাঁঠালের রস খাওয়া ঠিক হবে না।
৮. দুর্বলতা কমাতে: বার্ধক্যের ক্ষয়জনিত দুর্বলতায় অথবা যেকোন কারণে শরীর ক্ষয় হতে থাকলে যে দুর্বলতা আসে, সেক্ষেত্রে কাঁঠালের স্বচ্ছ রস এবেলা-ওবেলা। দু’বেলা ৫/৬ চা-চামচ করে খেলে দুর্বলতাটা থাকবে না।
৯. অরুচিতে: মানসিক কারণে অরুচি যে হয় না তা নয়, তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে পিত্ত অথবা বাত-পিত্ত বিকারে অরুচি দেখা দেয়, এই অরুচির উৎপত্তিস্থান হচ্ছে আমাশয়ে। একমাত্র বিকৃত শ্লেষ্মা ছাড়া অন্য দুটি কারণে বা পিত্ত প্রকৃতির ব্যক্তির যদি বিকার হয়, তবে কাঁঠালের রস ২/৩ চা-চামচ নিয়ে তার সঙ্গে মরিচ চূর্ণ ২/১ টিপ ও সামান্য একটু, চিনি মিশিয়ে কয়েকদিন খেলেই অরুচিটা চলে যায়। কেবল দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলেও চলে।
১০. রক্তপিত্তে: এক্ষেত্রে কাঁঠালের বীজ ৮ থেকে ১০টা অল্প থেতলে নিয়ে ৫ থেকে ৬ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ বা ৩ কাপ থাকতে নামিয়ে ছে’কে সারাদিন ৪/৫ বারে ওটাকে খেতে হবে। ২/৩ বার খাওয়ার পর বোঝা যাবে। গলা সুড় সুড় করে যে কাসির ধমকটা আসতো ও সেইসঙ্গে এক ঝলক রক্ত উঠতো, সেটা আর হচ্ছে না।
১১. শোথে: যে শোথের কারণ বাত-পিত্তের বিকার, সেখানে এঁচোড়ের ক্বাথ করে ফুলোয় সেই ক্বাথ লাগালে একদিনেই কমে যায়। অবশ্য বায়ু, বা পিত্ত বিকারের হলে সারবে।
ফলের শ্বেতকষ বা তরুক্ষীরে আছে সাইক্লোআটেনান, সাইক্লোআর্টেনাল, B সিটোস্টেরল, বুটাইরোসপারমোল এবং কিছু এমিনো অ্যাসিড, পাতায়ও একই রাসায়নিক দ্রব্যাদি পাওয়া যায়।[১][২]
এঁচোড় খাওয়ার নিয়ম ও গুণাগুণ
আয়ুর্বেদ মতে, এঁচোড় বা কাঁচা কাঁঠাল মল রোধ করে, বায়ু সৃষ্টি করে, কষায়, ভারি (গুরুপাক), দাহ সৃষ্টি করে, মধুর, শরীরে বল বৃদ্ধি করে, কফ এবং মেদ বাড়িয়ে দেয়। এঁচোড়ের শাঁস বীর্য বৃদ্ধি করে বাত ও পিত্ত নাশ করে। মেহ বা প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এঁচোড়ের প্রয়োগ:
১. কাঁঠাল গাছের বা আম গাছের ছালের রস বের করে তাতে থিতিয়ে যাওয়া চুনের জল মিশিয়ে খেলে রক্ত আমাশা, বিষৃচিকা বা কলেরা সেরে যায়।
২. চর্মরোগে কাঁঠালের কচি পাতার রস লাগালে উপকার পাওয়া যায়।
গাছ পাঁঠা : কাঁচা কাঁঠাল বা এঁচোড়ের কদর তরকারি হিসেবে খুবই বেশি। পেয়াজ, রসুন, আদা, গরম মশলা সহযোগে এঁচোড়ের যে কালিয়া রান্না করা হয় তা স্বাদে পাঠার মাংসের কাছাকাছি এবং পাঠার মাংসের মতোই তাতে ছিবড়ে বা রেশ আছে। সেইজন্যে এই কালিয়াকে গাছ পাঠার কালিয়া বলে। গাছ পাঠা অথাৎ গাছে ফলে যে পাঠা ।
এছাড়াও এঁচোড়ের দমপোক্ত, নারকেল কোরা দিয়ে এঁচোড়ের ঘন্ট, বড়ি-মটরশুটি বা ভালো দিয়ে রান্না করা ডালনা, এঁচোড়ের চপ ও কোফতাও সকলের কাছে খুবই প্রিয়। সারা ভারতেই এঁচোড়ের তরকারি সমাদর।। গ্রীষ্মকালের শুরু থেকে বর্ষার আগমন পর্যন্ত অর্থাৎ যতদিন পর্যন্ত না কচি এঁচোড় পেকে পিয়ে পাকা কাঁঠালে পরিণত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত রান্না করা হয় এঁচোড়ের বিবিধ ব্যঞ্জন। এঁচোড় কাঁচা আম ছোলা ও সর্ষের তেল মিশিয়ে স্বাদিষ্ট আচার তৈরি করে রাখা হয় সারা বছরের জন্যে।[৩]
CHEMICAL COMPOSITION
Artocarpus intigrifolia 1. The fruit contains (a) Moisture 77.2%; (b) Protein 1.9%; (c) Fat 0.1%. (d) Carbohydrates 18.9%; (e) Fibre 1.1%; (f) Mineral matter 0.8%; Calcium 0.02%; Phosphorus 0.03%; iron 0.5 mg. (g) Vitamin A 540 IU. (h) Vitamin C 10 mg/100 g. 2. Seeds contain : – (a) Moisture 51.6%; (b) Protein 6.6%. (c) Fat 0.4%; (d) Carbohydrates 38.4%. (e) Fibre 1.5%; (f) Mineral matter 1.5%. 3. Vitamin B. & B2. 4. Artostenone (a steroketone).[২]
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার), দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ১৬৪-১৬৫।
২. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৪, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ৪৭-৪৯।
৩. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা,১১২।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।