এশিয়ার উপকারি উদ্ভিদ বাঁশ এবং বাঁশের বহুমুখী অর্থনৈতিক ও নান্দনিক ব্যবহার

বাঁশ হলো পোয়াসি পরিবারের (লাতিন: Poaceae) অধীনে একটি ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ মাত্র। বাংলাদেশসহ এশিয়ার মানুষ বাঁশকে বহুবিধ কাজে লাগিয়ে থাকে। বাঁশ গ্রামীণ গৃহের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। এছাড়াও বাঁশের বহুমুখী অর্থনৈতিক ও নান্দনিক ব্যবহার রয়েছে।

বাঁশের শতাধিক প্রজাতি রয়েছে এবং পূর্ব, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অংশে বড় বড় আকারে এরা বেড়ে ওঠে। বাঁশ গাছ সাধারণত একত্রে গুচ্ছ হিসেবে জন্মায়। এক একটি গুচ্ছে ১০-৭০/৮০ টি বাঁশ গাছ একত্রে দেখা যায়। এসব গুচ্ছকে বাঁশ ঝাড় বলে। তাই বলে এটি আমাদের পরিচিত অন্যান্য ঘাসগুলোর মতো নয়। তাই এটিকে মানুষে মাড়াতে পারে না। বাঁশের কান্ড শক্তিশালী।

কাঠ, পাথর, বালু, কাদামাটি এবং পশুর অংশগুলির পাশাপাশি বাঁশ ছিল প্রথম দিকের মানুষদের দ্বারা তৈরি প্রথম উপকরণগুলির মধ্যে একটি। সভ্যতার বিকাশ ঘনিষ্ঠভাবে বাঁশের উপকরণগুলিতে দক্ষতার বৃহত্তর মাত্রা বিকাশের সাথে জড়িত ছিল। কাঠের কাজ করার মতোই বাঁশ মূলত বাঁশের নির্মাণ, বাঁশের টেক্সটাইল, বাঁশ এবং কাঠের স্লিপ, বাঁশের বাদ্যযন্ত্র, বাঁশের বুনন এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল।

বাঁশের কাজ হচ্ছে বাঁশ দ্বারা বিভিন্ন দ্রব্য উৎপাদনের দক্ষতা

বাঁশের কাজ হচ্ছে বাঁশ থেকে স্বতন্ত্র বস্তু তৈরি করার ক্রিয়াকলাপ বা দক্ষতা এবং এতে স্থাপত্যকর্ম, কাঠের কাজ, আসবাব এবং ক্ষুদ্র কক্ষের কাজ, খোদাই, জোড়ের কাজ ও বয়ন অন্তর্ভুক্ত। এশিয়াতে ঐতিহাসিক কাল থেকে সহস্রাব্দ জুড়ে এটির শিকড় সংস্কৃতি ও সভ্যতায় বিস্তৃত রয়েছে।

মূল নিবন্ধ: বাঁশের কাজ হচ্ছে বাঁশ থেকে স্বতন্ত্র বস্তু তৈরি করার ক্রিয়াকলাপ বা দক্ষতা

কান্ড শক্তিশালী হওয়ায় এটি বিভিন্ন গঠনমূলক কাজে যেমন ঘরবাড়ির কাঠামো তৈরিতে কাজে দেয়। এছাড়া বাগানে লতানো সবজির জন্য টাল বা মাচা তৈরিতে কাজে লাগে। আমাদের গ্রাম বাংলার আর্দ্র আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে বাঁশ অধিক উপযোগী, এটি পানি প্রতিরোধী একটা টিম্বার যা অতি আর্দ্রতায়ও সহজে পচন ধরেনা বা বাঁকা হয়ে যায় না। এ কারণে মাছ ধরার বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে এটা বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় মাছ ধরার ফাঁদ বা বৈচ্না, চাঁই, টেটা, খারি প্রভৃতি।

রান্নাঘরেও রয়েছে বাঁশের পরশ, বাঁশ কঞ্চি এবং এর পাতা জ্বালানির কাজ করে। রাধুনীকে পোড়া বাঁশীর শব্দ দিয়ে দিনদুপুরে উতলা করা ছাড়াও রয়েছে বাঁশের আরো ভূমিকা৷ তাই বাঁশি শুনে আর কাজ নেই। করিমন মনের সুখ দুঃখ এক করে চুলা ধরায়ে বাঁশে ফু দিয়ে, তাতে মধুর রোমাঞ্চকর সূর না বেরুলেও মোটেও ভাববেন না তা ফাটা বাঁশ, এবং উনুন জ্বললে পেটে ভাত পরবে মানুষের পেটের চুঁচুঁ শব্দ শান্ত হবে এতে। চালন, কূলা, ডুলা পাতি, বাঁশের শেলফ ইত্যাদি যেদিকে হাত দিবেন শুধু বাঁশ আর বাঁশ। চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশেও অনুরূপ। আমার সবাই বাঁশের প্রতি প্রীতিতে একাত্ব।

আরো পড়ুন:  বড় রূপাতোলা বাংলাদেশের অরণ্যে জন্মানো লতা

বাঁশের টিম্বারটা আঁশ প্রযুক্ত হওয়ায় এর যথেষ্ট নমনীয়তা আর প্রসারণশক্তি আছে যার দরুণ এটা সহজে ভাঙে না আর পূর্ণবয়স্ক হলে সহজে ফাটেও না। একে ইচ্ছেমতো বাকিয়ে পচ্ছন্দসই কাঠামো দেওয়া যায়। শহুরে জীবনেও বাঁশের আসবাবপত্রের ছোঁয়া রয়েছে।

বাঁশের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের বনজ সম্পদের চাহিদা পূরণ ছাড়াও পরিবেশ সংরক্ষণ করা যায়। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং প্রয়ােজনীয় পরামর্শের মাধ্যমে বাঁশের কম্পােজিট প্রােডাক্টস তৈরিতে শিল্প উদ্যোক্তাগণ উৎসাহিত হবে বলে আশা করা যায়। বাঁশের কম্পােজিট প্রােডাক্টস তৈরির মাধ্যমে ব্যক্তি ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। এ ব্যপারে শিল্প উদ্যেক্তাদের সক্রিয় উদ্যোগ অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।

রন্ধন কাজে বাঁশের ব্যবহার

এবার বাঁশ খাওয়া নিয়ে আলোচনা করা যাক। না না এ এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। বাঁশের কচি কুড়ুল বা কুরুলি খুব পছন্দ করে নিজের বাগানে উৎপন্ন করে অনেকে আগ্রহ সহকারে খায়। এটা প্রচুর পুষ্টি গুণসম্পন্ন, প্রচুর আমিষ রয়েছে, জাপানী বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করে এতে এমন উপাদান পেয়েছে যা ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। নিয়মিত সেবনে ক্যান্সার দূরে থাকে। এতে ভিটামিন বি আছে, রয়েছে প্রচুর রোগপ্রতিরোধী শক্তি।

latiflorus প্রজাতির বাঁশের কুরুলী উত্তোলন থেকে শুরু করে কিভাবে প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়ার উপযোগী করে তোলা হয় সেটার ধাপে ধাপে একটা সচিত্র প্রতিবেদন এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ সব বাঁশেই কম বেশি taxiphyllin নামক একটা toxin থেকে থাকে। এটা একটা cyanogenic glycoside যেটা পরিপাকতন্ত্রে গিয়ে cyanide বিষ এ পরিণত হয়, পাণ্ডা বা লেমুর জাতীয় প্রাণী সারাদিনে যে পরিমাণ বাঁশ পাতা খায় তাতে একটা মানুষ মারা যাবে cyanide poisoning হয়ে। কিন্তু এতে ওরা অভ্যস্ত ….. তাইতো বলা হয় বাঁশ খেয়ে হজম করতে পারাটা একটা গুণ।

এই বিষাক্ত যৌগটিকে নিষ্ক্রিয় করতে বাঁশের কুরুলিকে নুন্যতম এক থেকে দেড় ঘন্টা জ্বাল দিতে হয়। আমাদের দেশের মানুষেরা বাঁশের কুরুলীর মিহি কুচি করে হলুদ লবণ দিয়ে জ্বাল দিয়ে পরে পানিটা ফেলে দিয়ে মাংসের মসল্লা দিয়ে ভাজি করে কিংবা চিংড়ি দিয়ে রান্না করে, কেউ কেউ নারিকেলের দুধ দিয়েও রাধে।

আরো পড়ুন:  ঘোল বাংলার একটি পরিচিত উপকারি পানীয়

জাপানী পদ্ধতিটা আরো সহজ, মাঝ বরাবর বাঁশের কুরুলীটাকে ফেড়ে তারপর বড় হাড়িতে জ্বাল করে কুড়া এবং লবন দিয়ে, সামান্য চিনি দেওয়া যায়, ১.৫ ঘন্টা জ্বাল হলেই হয়, পরে তা ছুলে কুচি করে প্রয়োজন মত ব্যবহার করে। এক টুকরা চেখে দেখে যদি তেতো মনে হয় তাহলে পুনরায় আরো ২৫ মিনিট জ্বাল দিলেই হয়। এই প্রক্রিয়াটিতে বেশির ভাগ প্রজাতির toxin দূর হয়ে খাওয়ার উপযোগী ও উপাদেয় হয়ে উঠে। এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার যে বাঁশের কুরুলী কিন্তু খেতে কচকচে। এটাই এর বিশেষ বৈশিষ্ট।

চীনা, জাপানি, থাই, ভিয়েতনামীয়, মালয়ী রান্নাতে stirfry, broth, curry, spring roll-এ এই বাঁশের কুরুলী ব্যবহৃত হয়। বাঁশ বাগানে লাগানোর সময় উল্লেখ্য এই clumping variety বাঁশ লাগাবেন, তাতে বাঁশ ঝাড় এক জায়গাতে বেড়ে উঠবে, অন্যত্র দ্রুত ছড়াবে না, running variety এর বাঁশ লাগালে তা দ্রুত চারিপাশে ছড়াবে ও পরে বাগানে বাঁশের ঝাড়ের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবেন, আগাছার মত ছড়াবে। আমাদের oldhamii প্রজাতি (calcutta bamboo নামে পরিচিত) টা বেশ লক্ষী, এক জায়গায় বিস্তার করে। latiflorus প্রজাতিগুলোও তাই।

বড় বাঁশের ডাঁটার ফাঁকা অংশটুকু প্রায়শই অনেক এশিয়ান সংস্কৃতিতে খাবার রান্না করতে ব্যবহৃত হয়। সরাসরি আগুনের উপরে বাঁশের তাজা ডাঁটার ফাঁকে স্যুপ সিদ্ধ করা হয় এবং ভাত রান্না করা হয়। একইভাবে, বাষ্পযুক্ত চা তৈরিতে মাঝে মাঝে বাঁশের ফাঁপা অংশকে পি-এরহ চায়ের সংকুচিত ধরনগুলি তৈরি করতে কাজে লাগানো হয়। বাঁশগুলিতে খাবার রান্না করা খাবারটিকে নিগূঢ় তবে স্বাদযুক্ত বলে মনে হয়।

এছাড়াও, বহু সংস্কৃতির মধ্যে বাঁশকে রান্না করার জন্য ঘন ঘন ব্যবহার করা হয় এবং চপস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক যুগে, কেউ কেউ বাঁশের সরঞ্জামগুলিকে অন্যান্য উৎপাদিত পাত্রের থেকে পরিবেশগতভাবে বিকল্প হিসাবে দেখেন।

বাঁশের গণ পুষ্পায়ন প্রকৃতি

মূল নিবন্ধ: বাঁশের পুষ্পায়ন বা বাঁশের ফুল

আরো পড়ুন:  মাখন ও ঘি খাওয়ার উপকারিতা ও এগুলোর ব্যবহার ও প্রয়োগবিধি

বাঁশের পুষ্পায়ন বা বাঁশের ফুল (ইংরেজি: Bamboo blossom) একটি প্রাকৃতিক ঘটনা যেখানে কোনও অবস্থানে থাকা বাঁশগুলি প্রস্ফুটিত হয় এবং বাঁশের বীজের সাথে ঝুলে থাকে। এটি সাধারণত চীন, মিয়ানমার এবং ভারতে দেখা যায়। অতি প্রয়োজনীয় এই বাঁশ গাছটির শুধু অবয়বে নয় স্বভাবেও এদের পুষ্পায়ন একটি অদ্ভুত আচরণ। নানা প্রকার বাঁশঝাড়ে নানা সময়ে ফুল ধরে; কোনোটিতে ফি-বছর, কোনোটিতে ৩ বছর, কোনোটিতে ৫০ বছর, কোনোটিতে বা একশো-সোয়াশো বছর পরেও।

বাঁশগুলিতে প্রায় ৪০ থেকে ৮০ বছর বয়সে একটি জীবনচক্র থাকে, যা বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে পার্থক্য অনুসারে পরিবর্তিত হয়। ভারতের নিজোরাম রাজ্য, বার্মার চিন আর বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে Melocanna baccifera নামে একপ্রকার মুলি বাঁশ জন্মে যাতে ৪৮ বছর পরে ফুল ধরে। এদিকে জাপানী বাঁশ Phyllostachys bambusoids ১৩০ বৎসর পর পর্যন্ত ফুলবতী হতে পারে। তিমুর দ্বীপের কালো বাঁশের ফুল ধরে ১২০ বছর অন্তর।

রচনাকাল: ২২ মার্চ ২০১৫

Leave a Comment

error: Content is protected !!