নীল অপরাজিতা হচ্ছে একটি আলংকারিক লতা জাতীয় উদ্ভিদ। এই লতার বৈজ্ঞানিক নাম: Clitoria ternatea. এদের অন্যান্য সমনাম হচ্ছে Clitoria albiflora Mattei, Clitoria bracteata Poir., Clitoria mearnsii De Wild., Clitoria tanganicensis Micheli, Clitoria zanzibarensis Vatke, Clitoria ternatea L. var. alba hort. নিচে এই লতার ভেষজ উপকারিতা ও ব্যবহারের পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো।
নীল অপরাজিতা একটি আলংকারিক ভেষজ লতা
১. মূর্ছায় (Hysteria): মূর্ছায় না অপস্মার? হিষ্টিরিয়া না এপিলেপিসি? কোন রোগ এটা বিচার হয়—যদি রোগাক্রমণের পূর্বে বা মধ্যে অথবা হওয়ার পরই প্রস্রাব হয়ে যায়, তবে বুঝতে হবে এটা অপস্মার, নইলে সেটা মূর্ছা; এই মূর্ছার ক্ষেত্রে বা আক্রমণের সময় যদি এর মূল, গাছ ও পাতা থেতো করে, ছেকে ১ চা চামচ আন্দাজ রস কোনো রকমে খাইয়ে দেওয়া যায়, তৎক্ষণাৎ ওটা ছেড়ে যাবে।
২. শূল ব্যথায়: খাওয়ার ২/৩ ঘণ্টা বাদে ব্যথা ধরে, বুক পিঠ যেন সেটে ধরতে থাকে, এক্ষেত্রে ৩/৪ গ্রাম অপরাজিতার মূলের ছাল বেঁটে একটু, ঘি, মধু ও চিনি মিশিয়ে সকালে ও বিকালে দুবার করে খেলে ৭/৮ দিনের মধ্যে এর উপশম হবে।
৩. গলগণ্ডে: এর মূল ৫/৬ গ্রাম বা আধ তোলা আন্দাজ নিয়ে ঘি দিয়ে শিলে পিষে, অল্প মধু মিশিয়ে খেলে এটা সেরে যায়।
৪. স্থির শোথে: যে ফুলো ঔষধে কমছে না, লবণ ছাড়লেও যাচ্ছে না। অথচ শ্লীপদের বা ফাইলেরিয়া লক্ষণও নেই, সেক্ষেত্রে নীল অপরাজিতা গাছের মূল বেঁটে অল্প গরম করে ঐ ফুলোয় লাগাতে হয় এবং আরও একটু উপদেশ দেওয়া আছে—এই গাছের মূল ৪/৫ গ্রাম এবং ৫টি গোল মরিচ একসঙ্গে বেটে কাঁচা দুধ দিয়ে প্রত্যহ একবার করে খেতে হবে।
৫ . ঘন ঘন প্রস্রাবে: অনেক বালকেরও দেখা যায় যে নড়েচড়ে আর প্রস্রাব করে, অথচ পরিমাণে অল্প, আবার বড়োকালেও এটা দেখা যায়; এক্ষেত্রে সাদা বা নীল যাই পাওয়া যাক, গাছে-মূলে নিয়ে, রস করে ১ চা চামচ আন্দাজ প্রত্যহ ২ বার একটু দুধ মিশিয়ে খেতে হয়। এটি কিন্তু পূর্ণমাত্রা।
৬. মেধা বৃদ্ধিতে: সকলের মুখে মুখে চলে আসছে ব্রাহ্মীঘৃত এর একমাত্র ঔষধ, কিন্তু এই শ্বেত অপরাজিতা মূলের কল্ক আর গাছপাতার ক্বাথ দিয়ে আয়ুর্বেদীয় ঘৃত প্রস্তুত পদ্ধতিতে ঘৃত প্রস্তুত করে খেতে দিতে হয়। এটি ব্যবহারের নিয়ম ভাত খাওয়ার প্রথম গ্রাসের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে, এর সঙ্গে লবণ মাখানো চলবে না,এটাতে প্রত্যক্ষ ফল উপলব্ধি হবে। তবে বৈদ্য ভিন্ন সাধারণের পক্ষে প্রস্তুত করা সম্ভব নয়।
৭. পূঁজ মেহে: সম্ভোগে অস্বস্তি, শিশ্নাগ্রে ব্যথা বোধ; কোনো কোনো সময় টিপলে একটু পুঁজের মতো বেরোয়; সেক্ষেত্রে এর মূলের রস ১ চা চামচ আধ গ্লাস মিছরির সরবতের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে।
৮. স্বরভঙ্গে: এ ক্ষেত্রটি যক্ষ্মার স্বরভঙ্গে নয়, অতিরিক্ত শক্তিক্ষয়জনিতও নয়, অথবা গরম ঠান্ডা জল খেয়েও নয়; কেবলমাত্র যে স্বরভঙ্গিটা শ্লেষ্মার দ্বারা অধিজিহ্বাকে (Larynx) দূষিত করে সৃষ্ট হয়, সেই ক্ষেত্রেই এটি কার্যকর হবে। কি করতে হবে? সমগ্র লতাপাতা আন্দাজ দশ গ্রাম থেতো করে ৪/৫ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে, সেই জলে কবল ধারণ করা, আর গরগরা বা গারগেল করা; অন্ততঃ ১৫ মিনিট ধীরে এটা করতে হবে, এর দ্বারা ৪/৫ দিনের মধ্যে ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে।
৯. গলক্ষতে: সাদা পরদা পড়ে আছে, অথবা লাল, ক্ষতের পূর্বাবস্থা, এমনকি কোনো জায়গায় ক্ষতও দেখা দিয়েছে, সেক্ষেত্রে ঘিয়ের চারগুণ ওজনের গাছকে ভাল ভাবে থেতো ও গাছের ৮ গুণ জলে সিদ্ধ করে সেই জলের সিকিভাগ অর্থাৎ চতুর্থাংশ থাকতে নামিয়ে ছেকে নিয়ে সেই ক্বাথ দিয়ে ঘি তৈরী করতে হবে, তারপর অল্প ঠান্ডা হলে সেই ঘি ছেকে নিতে হবে। এই ঘি প্রত্যহ দুবার করে তুলি দিয়ে লাগালে ভালো হয়ে যাবে।
১০. শুষ্ক কাসিতে: একে আমরা চলতি কথায় শুকানো কাসি বলি। কাসিই হয়, কিন্তু কিছু বেরোয় না, যদিও বেরোয় সেটা আঠার মত সাধারণত এলার্জির কাসিতে এই রকম বেরোয়, এক্ষেত্রে অপরাজিতা মূলের রস আন্দাজ ১ চা চামচ আধ কাপ অল্প গরম জলে মিশিয়ে, সেই জল মুখে নিয়ে ১০/১৫ মিনিট বসে থাকতে হয় একে বলে কবল ধারণ করা আর মুখটা উচু করে এমনভাবে গরগরা করতে হয় যেন গাল তালুতে লাগে; এর দ্বারা ঐ অসুবিধেটা চলে যাবে।
১১. আধকপালে: এর আয়ুর্বেদিক নাম অধাবভেদক। এই রোগে এক টুকরো মূল ও গাছ একসঙ্গে থেতো করে ওটার রসের নস্যি নিতে হবে। এর দ্বারা ২/৩ দিনের মধ্যে ঐ আধকপালের ব্যথাটা সেরে যাবে।
১২. খোস পাঁচড়ায়: যেসব খোস পাঁচড়া পৌষ মাসের শেষে দেখা দেয়, সেই ক্ষেত্রে এই গাছপাতায় ক্বাথ দিয়ে তৈরী তেল গায়ে মাখলে ওটা সেরে যায়। ষেভাবে তৈরী করতে হবে: সরষের তেল কড়ায় চড়িয়ে নিষ্ফেন হলে বা গাঁজা মরে গেলে ঐ সিদ্ধ ক্বাথ তেলে মিশিয়ে নেড়ে নেড়ে পাক করতে হবে, জলটা শুকিয়ে গেলে কড়াইয়ের তলায় একটা চিটচিটে আঠার মত জড়িয়ে যাবে, সেই সময় নামাতে হবে। পরিমাণ হলো;— যতটা তেল তার ৪ গুণ গাছে-মূলে, আর গাছের ৮ গুণ জল দিয়ে ক্বাথ করতে হবে, অবশিষ্ট থাকবে জলের চতুর্থাংশ অর্থাৎ সিকি ভাগ।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা, ৯০-৯৫।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Joydeep
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।