রুসা ঘাস-এর নানাবিধ ভেষজ গুণাগুণের প্রয়োগ

রুসা ঘাস বা তৃণটি ভারতের উষ্ণ অঞ্চলে কোথাও কোথাও অযত্নসম্ভূতভাবে জন্মে, আবার কোন কোন স্থানে এটির চাষও হয়। পাঞ্জাব থেকে বর্মা বরাবর স্থান সমূহের কোন। কোন স্থানে, মধ্যপ্রদেশ ও বিহারের কোথাও কোথাও এটিকে পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে খুব অল্পই পাওয়া যায়, বাগানেও লাগানো হয়ে থাকে।

এটির সংস্কৃত নাম রৌহিষ, রোহিষ, দীর্ঘ রোহিষ, কতৃণ প্রভৃতি। হিন্দী ভাষাভাষী অঞ্চলে এটি রাস ঘাস, রুসা ঘাস, সৌন্ধিয়া, রোহিষ, গন্ধে জঘাস নামে পরিচিত। মহারাষ্ট্রে এর নাম বাটুরোহিমু। বাংলায় এটি অগ্য ঘাস, রুসা ঘাস, গন্ধবেণা প্রভৃতি নামে পাওয়া যায়।

রাজনিঘণ্টকার রোহিষ ও দীর্ঘ রোহিষ নামে দু’প্রকার কতৃণের উল্লেখ করেছেন। রোহিষ তৃণের বোটানিক্যাল নাম Cymbopogon schoenanthus (Linn.) Spreng., পূর্বে এটির নাম ছিল Andropogon schoenanthus Linn., এটি Gramineae ফ্যামিলীভুক্ত। এটির দুটি Var. পাওয়া যায়।

১. Cymbopogon schoenanthus Var. caesius Hack (Cymbopogon caesius Stapf.) এটি রোহিষ তৃণ। সুগন্ধযুক্ত ঘাস, ৩ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে দেখা যায়। পাতা ০.১ থেকে ০.৩ ইঞ্চি চওড়া হয়। পাতা লম্বা, অগ্রভাগ ক্রমশঃ সরু। বর্ষাকালে ফুল ও শীতকালে ফল হয়। মাদ্রাজ, মহীশূর, ত্রিবান্দ্রম, গুজরাট প্রভৃতি স্থানে পাওয়া যায়। এর থেকে যে তেল পাওয়া যায়, তাকে Kachi grass Oil বলে।

২. Cymbopogon schoenanthus Var. martini Hook. f. (Cymbopogon martini (Roxb.) Wats.) এটিও রোহিষ, তবে দীর্ঘ রোহিষ বা দীর্ঘ রোহিষক। ইংরেজিতে এটিকে Rosha/Rusa grass বলে। দীর্ঘপত্রী, মিষ্টগন্ধযুক্ত ঘাস, ৫-৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের পার্বত্য অঞ্চল, গাভোয়াল, আলমোড়া, সিংভূম, মধ্যপ্রদেশ, রাজপুতনা, বোম্বে ও দক্ষিণ ভারতের অঞ্চল বিশেষে এটি জন্মে। এর আবার দু’টি জাতি আছে—(১) মতিয়া, (২) সোফিয়া। মতিয়া ঘাস থেকে যে তৈল পাওয়া যায়, সেটিকে Palmarosa oil বলে, তবে এটি Rusa oil or East Indian Geranium oil নামে পরিচিত। সোফিয়া ঘাস থেকে যে তৈল উৎপন্ন হয়, তাকে বলা হয় Ginger grass oil, তবে এটি মতিয়া ঘাস থেকে তৈরী তৈলের ন্যায় মূল্যবান নয়। এ দুটি ঘাসকে সহজে পৃথক করা যায় না, এজন্য অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই ঘাসের চাষ হচ্ছে এবং তা থেকে তৈল উৎপাদনও চলছে। ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশ: ঘাস, মূল ও তৈল।

আরো পড়ুন:  ছোট পঙ্খীরাজ বাংলাদেশের সর্বত্রে জন্মানো পরাশ্রয়ী প্রজাতি

রুসা ঘাস-এর প্রয়োগ

ঘাস: উদ্দীপক, সুগন্ধযুক্ত, কটু, তিক্ত, সংকোচক ; জ্বর, বেদনা, কুষ্ঠ, হৃদরোগ, মুখরোগ, মৃগী (শিশুদের) ও ফুসফুস নলিকা প্রদাহে ব্যবহার্য। মূল ও কাণ্ড বেটে লাগালে বৃশ্চিকের হুল ফোটানো যন্ত্রণার লাঘব হয়।

ঘাসের ক্বাথ: জ্বরনাশক, সর্দিতে হিতকর, কফনিঃসারক, স্তন্যজনন, মূত্রজনন, হৃদয়োত্তেজক, ঘর্মকারক, অজীর্ণ নাশক।

ঘাসের তৈল: বাতে ও স্নায়ুশূলে ব্যবহার্য। ইন্দ্রলুপ্ত রোগে বিশেষ হিতকর, অজীর্ণ ও জ্বরে ব্যবহৃত হয়। নতুন আমবাতে ও গেঁটে বাতে মালিশ করলে ভাল কাজ হয়, পুরাতন হলে বিশেষ লাভ হয় না। এটি উষ্ণ, ঘর্মকারক, মূত্রল, জ্বরঘ্ন ও উত্তেজক।

১. শ্লেষ্ম জ্বরে: জ্বর, সেই সঙ্গে সর্দি, কাসি ; শ্লেষ্ম বুকে জমে যাচ্ছে, উঠতে চাইছে, হাত-পায়ের গাঁটে গাঁটে যন্ত্রণা, মাথা ভার, এই জ্বরটিকে আমরা এক কথায় চিনতে পারবো, যখন একে ইনফ্লুয়েঞ্জা বলে বলবো। এক্ষেত্রে ২৫ গ্রাম মূল সমেত ঘাস ৫/৬ কাপ জলে সিদ্ধ করে, ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, হেঁকে, সেটিকে ১ কাপ মাত্রায় সারা দিনে ৪ বারে খেতে হবে। এর দ্বারা ঘাম দিয়ে জ্বর কমবে, কফ তরল হয়ে উঠে যাবে এবং হাতে-পায়ের যন্ত্রণা থাকবে না। এসব ক্ষেত্রে সাধারণতঃ ক্ষুধা থাকে না, অজীর্ণ দেখা দেয়, কিন্তু এটির ব্যবহারে ও দু’টি সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে। জ্বর একেবারে না ছাড়া পর্যন্ত ৩/৪ দিন খেতে হবে। জ্বর ছেড়ে গেলেও আরও ৩/৪ দিন খাওয়া প্রয়োজন। যদি ৪/৫ দিনের মধ্যে জ্বর না ছাড়ে, তাহলে এর দ্বারা কাজ হবে না, অন্য ঔষধের ব্যবস্থা করতে হবে।

২. সর্দিতে: হঠাৎ ঠাণ্ডা লেগে জলের মতো সর্দি, সেইসঙ্গে ঘন ঘন হাঁচি, কোনকিছু খেতে অরুচি লাগে, এক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে প্রস্তুত রুসা ঘাস-এর ক্বাথ ২/৩ দিন খেলেই সবগুলা অসুবিধেই চলে যাবে।

৩. মূত্রকৃচ্ছ্রে: নানা কারণে মূত্রকৃচ্ছ্রতা আসতে পারে, তবে যে ক্ষেত্রে মূত্রকৃচ্ছ্রতার কারণ প্রোস্ট্রেট গ্লাণ্ডের (পৌরুষ গ্রন্থির) বৃদ্ধি এবং যেক্ষেত্রে কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, আবার প্রচণ্ড গরমের ফলেও কারো কারো মূত্রকৃচ্ছতা দেখা দেয়, কখনো কখনো হঠাৎ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লেগেও হয়, এসব ক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে প্রস্তুত রুসা ঘাস-এর ক্বাথ কয়েকদিন ব্যবহার করলে উপকার হবে। তবে মূত্রপাথুরীর জন্য মূত্রকৃচ্ছু হচ্ছে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার, পাথুরী হলে অন্য ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

আরো পড়ুন:  পাহাড়ি হলকুশা বাংলাদেশের পার্বত্যঞ্চলে জন্মানো বিরুৎ

৪. স্তন্যহ্রাস: কারো কারো প্রথম থেকেই বুকে দুধ কম, কারো আবার প্রসবের কিছুদিন পর থেকে বুকের দুধ কম হতে থাকে; প্রথম প্রসূতা হঠাৎ করে বুঝতে পারেন না যে, তাঁর বুকের দুধ কম হচ্ছে, ক্রমাগত শিশুর কান্না ও অস্থিরতা থেকে খেয়াল হয়। এসব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মায়েরই পেটের গোলমাল থাকে, কারো অজীর্ণ, কারো অম্ল, কারো পেটফাঁপা, কারো ক্ষুধামান্দ্য; কারো আবার এই সঙ্গে হৃদ্দৌর্বল্যও থাকে। এসব ক্ষেত্রে এই ভেষজটির ক্বাথ উপরিউক্ত পদ্ধতিতে তৈরী করে প্রসূতাকে কিছুদিন খাওয়াতে হবে, বুকের দুধের স্বাভাবিকতা ফিরে এলেও যতদিন অন্যান্য উপসর্গগুলা চলে না যায়, ততদিন খাওয়া দরকার। ২/৩ মাসের অধিক খাওয়ার প্রয়োজন হলে তখন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। যদি কোন মায়ের রক্তহীনতা থেকে থাকে, সেজন্য এইসঙ্গে অন্য ঔষধেরও ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। খাওয়া-দাওয়ার দিক থেকে এসময় মায়েদের কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

৫. বৃশ্চিকের হুলের জ্বালায়: মূল ও ঘাস একত্রে বেটে প্রলেপ দিলে যন্ত্রণার উপশম হয়।

৬. আমবাতে ও সন্ধিবাতে: এ দুটিই কষ্টসাধ্য রোগ, যাপ্য বললে অত্যুক্তি হয় না। রোগের প্রথম অবস্থায় এই ঘাসের তৈল দিনে ২ বার করে মালিশ করলে ভাল কাজ হয়। অবশ্য সেইসঙ্গে নিয়মিত ভাবে কিছুদিন অন্য ঔষধ সেবন করা বিশেষ প্রয়োজন। তখন কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শানুসারে ঔষধ নির্বাচন করতে হবে।

CHEMICAL COMPOSITION

1.Cymbopogon schoenanthus Var. caesius Hack (Cymbopogon caesius

stapf.) Whole plant and flower heads contain: essential oil (geraniol, perillic alcohol, d-limonene) and dipentene.

2. Cymbopogon schoenanthus Var. martini Hook. f. (cymbopogon martini (Roxb.) Wats.) Leaves of motia grass contain: moisture 28%, oil 0.3% (geraniol 78-94% in Indian oil and 94-96% in Java oil), acetic acid and its ester, caproic acid and its ester, dipentene, methyl heptanone and farnesol. Leaves of sofia grass contain: moisture 13%, oil 0.4% (Geraniol 39.24-48.1%), d-a-phellandrene, d-limonene, perillic alcohol, an aldehyde and traces of carvone.

আরো পড়ুন:  নলিকা-এর নানাবিধ ভেষজ প্রয়োগ

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৯, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৫, পৃষ্ঠা, ২৭৪-২৭৭।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Pau Pámies Grácia

Leave a Comment

error: Content is protected !!