কমরেড ক্লারা জেটকিন (৫ জুলাই, ১৮৫৭ – ২০ জুন ১৯৩৩) ছিলেন জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক এবং ‘নারী অধিকার’ আন্দোলনের বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেত্রী। জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির এই নারী নেত্রী সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী হিসেবেও পরিচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজতন্ত্রই একমাত্র নারীকে মুক্তি দিতে পারে। তিনি বুর্জোয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং বুর্জোয়া একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও জার্মান সমাজের অভ্যন্তরে শ্রেণিবৈষম্য ও পুঁজিবাদ উৎখাতের লক্ষ্যে মার্কসবাদী দর্শন গ্রহণ করেছিলেন।
তার পুরো নাম ক্লারা জেৎকিন এইছ্নার। ১৮৫৭ সালের ১৫ জুলাই জার্মানির স্যাক্সোনি প্রদেশের উইডারউ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ক্লারা জেটকিনের পিতা গটফ্রাইড আইজেনার ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক এবং ধর্মপ্রাণ প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ সংগঠক। কিন্তু মা জোসেফিন ভিটালে আইজেনার ছিলেন লেইপজিগের সম্ভ্রান্ত এবং সুশিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।
তার জন্মের সময়গুলোতে জার্মানিতে মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ খুব বেশি ছিল না। তারপরেও তিনি লেইপজিগের একটি কলেজে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন। আর এ বিষয়ে তিন লেইপজিগের মাতৃকুল থেকে সহায়তা পেয়েছিলেন। শৈশবে জেটকিন শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করলেও, অচিরেই তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে উঠেন। ১৮৭৪ সালের দিকে তার সাথে বিশেষ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল জার্মানির নারী আন্দোলন এবং শ্রম-আন্দোলনের সাথে জড়িত সংগঠনগুলোর।
তিনি লিপজিগ শহরের ”স্টেইবার টিচারস্ কলেজ ফর ওম্যান” এ অধ্যয়ন করেন। উক্ত কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি তরুণ বয়স থেকেই একজন সোশ্যালিস্ট হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম লিবকনেটের লেকচার ক্লাসে তিনি নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন।
তিনি নিজেকে গড়ে তোলেন মার্কসবাদী দর্শন অনুযায়ী সমাজের আমূল রূপান্তর ঘটানোর লক্ষ্যে। তিনি বুঝেছিলেন পশ্চাৎপদ নারীদেরকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে হবে। নারীকে তার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত করতে না পারলে মানবজাতির সামগ্রিক মুক্তি সম্ভব নয়। সেই লক্ষ্যে তিনি নারীদের মাঝে ব্যাপকভাবে কাজ করেন। ফলে জার্মান ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনে ক্লারা এক অতি পরিচিত নারী ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী মুক্তির লক্ষ্যে ক্লারা ১৮৭৮ সালে জার্মানির সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক দলে যোগ দেন। এই দলটি গড়ে ওঠার এক ইতিহাস আছে। ১৮৭৫ সালে দুটি দল একত্রিত হয়ে এই দলটি গড়ে উঠে। দল দুটি ছিল ফার্ডিনান্ড লাসালে (১৮২৫ – ১৮৬৪) কর্তৃক গঠিত সাধারণ জার্মান শ্রমিক সংগঠন বা General German Workers’ Association বা সংক্ষেপে ADAV এবং আগস্ট বেবেল (১৮৪০ – ১৯১৩) ও ভিলহেল্ম লাইবনেখত (১৮২৬ – ১৯০০) কর্তৃক গঠিত জার্মানির সমাজগণতান্ত্রিক শ্রমিক দল বা Social Democratic Workers’ Party of Germany বা সংক্ষেপে SDAP. পরে ১৮৯০ সালে এই দলটির আধুনিক সংস্করণ তৈরি হয়েছিল এবং নাম গ্রহণ করেছিল জার্মানির সমাজ গণতান্ত্রিক দল বা Social Democratic Party of Germany বা সংক্ষেপে SPD.
তার পিতা ছিলেন স্কুল শিক্ষক এবং মাতা ফরাসী বিপ্লবের একজন দৃঢ় সমর্থক। ১৮৭৪ সালে যদিও একজন নারীর জন্য তখন কোন রাজনৈতিক দলে যোগদান করা ছিল বেআইনি তবুও তিনি যোগ দেন উক্ত রাজনৈতিক দলে এবং ধীরে ধীরে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন। ১৮৭৮ সালে বিসমার্ক জার্মানিতে সমাজতন্ত্র-বিরোধী জরুরি আইন এবং সমাজতান্ত্রিক কাজকর্মের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে জেটকিন ১৮৮২ সালে জুরিখ চলে যান এবং সেখান থেকে প্যারিসে নির্বাসনে যান। প্যারিসে থাকাকালীন তিনি সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর কিছুদিন পর তিনি রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসা মার্কসবাদী বিপ্লবী এবং তার অন্যতম বন্ধু ওসিপ জেটকিনকে (১৮৫০ – ১৮৮৯) বিবাহ করেন এবং তার নামের জেটকিন অংশটুকু গ্রহণ করেন। ১৮৮৩ সালে প্রথম সন্তান ম্যাক্সিম জেটকিন জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় তিনি চিকিৎসক ছিলেন। দ্বিতীয় সন্তান কোনস্টানটিন জেটকিনের জন্ম হয় ১৮৮৫ সালে। ক্লারার সম্পাদিত নারী বিষয়ক পত্রিকায় Die Gleichheit (Equality) শেষের দিকে কোনস্টানটিন তাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন। ১৮৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে যক্ষ্মা রোগে তার স্বামী ওসিপ মৃত্যুবরণ করেন। পরে জেটকিন শিল্পী জর্জ ফ্রিডরিখ যুন্ডেলকে (১৮৭৫ – ১৯৪৮) বিয়ে করেন। যুন্ডেল ছিলেন তার চেয়ে আঠার বছরের ছোট এবং এই বিবাহ ১৮৯৯ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত ছিল।
এই দলে থাকাকালীন সময়ে তার সাথে রোজা লুক্সেমবার্গের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। জার্মানীর নারী আন্দোলনে তিনি এই বান্ধবীকে গভীরভাবে পেয়েছিলেন। রোজাও নারীর অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পক্ষে অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। তাছাড়া বিশ শতকে মার্কসবাদের উপর সংশোধনবাদের আক্রমণ বাড়লে গড়ে ওঠা বিতর্কে তিনি এবং রোজা এদুয়ার্দ বার্নস্তাইনের সংশোধনবাদী থিসিসকে আক্রমণ করেন।
আপাতদৃষ্টিতে ক্লারা ছিলেন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী একজন নারী। পেটি বুর্জোয়া পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ও প্রচলিত একাডেমি শিক্ষায় শিক্ষিত ক্লারা জার্মান সমাজের শ্রেণী বৈষম্য ও পুঁজিতন্ত্র কর্তৃক শ্রেণী শোষণের ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মার্কসবাদী মতবাদ গ্রহণ করেন। শ্রমিক শ্রেণীর মতবাদ মার্কসবাদ অনুযায়ী সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হলে পশ্চাৎপদ নারীদেরকেও যে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে হবে এ সত্য ক্লারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন এবং নারী জাতি তার শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্ত হতে না পারলে মানব জাতির সামগ্রিক মুক্তি সম্ভব নয় এ শিক্ষায় তিনি নিজেকে সুদৃঢ়ভাবে গড়ে তুলেছিলেন। নারীদের সমস্যা নিয়ে ব্যাপক প্রচার এবং বিশ্লেষণ করে দেখান যে জার্মান নারীরা কিভাবে পুঁজিবাদের শ্রম শোষণ এবং যৌন নিপীড়নের শিকার ও পুঁজিবাদ কিভাবে নারীকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করেছে।
ক্লারা জেটকিন ১৮৯৬ সালে অনুষ্ঠিত তার পার্টি কংগ্রেসে নারীদের সমস্যার উপর এক দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। কংগ্রেসে প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি বেকোফেন, মর্গান ও বুর্জোয়া নারীবাদীদের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি ঘোষণা করেন, ব্যক্তিগত মালিকানাই হচ্ছে নারী নিপীড়নের মূল উৎস এবং সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদই পারে নারী নিপীড়নের মূল শিকড় উপড়ে ফেলতে। তিনি নারীমুক্তির এই ধারনাকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেবার আহ্বান জানান এবং কিছু দিকনির্দেশনামূলক চিন্তা পেশ করেন। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখান নারীদেরকে শ্রেণি সচেতন করে তুলতে হবে, শ্রেণি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে, ট্রেড ইউনিয়নগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ আরো বাড়াতে হবে, বৃহত শিল্প ছাড়াও কুটির শিল্প ও কারখানার নারীদেরকে জাগিয়ে তুলতে হবে। উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ১৮৮৯ সালে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মঞ্চ থেকে কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন সর্বপ্রথম রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে পুরুষদের সাথে নারীর সমানাধিকারের দাবি তোলেন। এরকম একজন নারী নেত্রীই তাই বলতে পারেন, “পুঁজিবাদীদের কাছে স্বল্প মজুরিই নারীর শ্রমকে শুধু বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করেনি, নারীর অধিকতর আনুগত্যও তা করেছে।” ১৮৯৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট উইমেন্স অর্গানাইজেশন (ISWO)’র কোপেন হেগেন সম্মেলনে ক্লারা জেৎকিন ৮ মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস হিসাবে পালনের প্রস্তাব দেন। জার্মানীর ”আয়রণ চ্যান্সেলর” অটোভন বিসমার্ক জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করলে ক্লারা পার্টির জন্য গোপন কাজে সক্রিয় হন। গোপন জীবনে থাকাকালীন সময়ে উক্ত পার্টির কর্মী একজন রাশিয়ান মার্কসবাদী উড্ওয়ার্কার ওসিফ জেৎকিনের সাথে পরিচিত হন।
ক্লারা জেটকিন নারীদের সমস্যা নিয়ে ব্যাপকভাবে লেখালেখি করেন। নারীর রাজনীতি এবং নারীর ভোটাধিকার ও সমানাধিকার নিয়ে তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি জার্মানিতে সমাজ-গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলন বিকশিত করেন; ১৮৯১ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত জার্মানির সমাজ গণতান্ত্রিক দলের পত্রিকা সমতা বা Die Gleichheit সম্পাদনা করেন। লেখালেখির মাধ্যমে তিনি বিশ্লেষণ করে দেখান যে, জার্মান নারীরা পুঁজিবাদের শ্রম শোষণের শিকার এবং যৌন নিপীড়নের শিকার, পুঁজিবাদ নারীকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করেছে। “গৃহে স্বামী বুর্জোয়া ও স্ত্রী সর্বহারা শ্রেণি গঠন করে” _ ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের (১৮২০ – ১৮৯৫) এই বিখ্যাত উক্তিকে তিনি জোরালোভাবে আঁকড়ে ধরে তার ব্যাখ্যা করেন। এছাড়াও তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, এটা শুধু জার্মান নারীদের সমস্যা নয়, শ্রেণিবিভক্ত সমস্ত দেশের নারীদেরই এটাই সমস্যা।
জেৎকিনের একজন ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন ফ্রেডারিক এঙ্গেলস। তিনি গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন বেবেলের “Women and socialist” পড়ে। যেখানে বলা হয়েছে, “There can be no liberation of mankind without the independence and equality of sexes” ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ফাউন্ডিং কংগ্রেসের তিনি প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। কংগ্রেসে ক্লারা বক্তব্য রাখেন নারীদের সমঅধিকার নিয়ে এবং সেই সাথে যুক্ত করেন ভোটাধিকার এবং সমান কাজে সমান মজুরির দাবি। ১৮৯০ সালে বিসমার্ক এটা খারিজ করে দেয়। জেৎকিন জার্মান ফিরে আসেন। ১৮৯২ সালে তিনি ইকুয়ালিটি (Die Glei chheit) পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯১৭ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ঐ একই পদে বহাল ছিলেন। কারখানার শ্রমিক ধর্মঘট, শ্রমিক নারীদের কর্মতৎপরতা এবং সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের প্রধান ইস্যুগুলিই ছিল পত্রিকাটির প্রতিপাদ্য বিষয়।
১৯০৭ সালে দলের নারী বিষয়ক বিভাগ “Women’s Office” প্রতিষ্ঠিত হলে, ইনি এই বিভাগেরনেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক শহরের শ্রমিক নারীরাতাদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে এক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন করেন। ১৯১০সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কর্মজীবী নারী সম্মেলনঅনুষ্ঠিত হয় কোপেনহেগেন শহরে। এই সভায় ১৭টি দেশের শতাধিক নারী-প্রতিনিধিযোগদান করেন। এই সম্মেলনে জার্মানির সমাজতান্ত্রিক দলের নারী-কার্যালয়ের (Women’s Office) নেত্রী হিসাবে তিনি যোগদান করেন এবং ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিকসর্বহারা ও নিপীড়িত নারীদের অধিকার আদায়ের প্রতীক দিবস করার একটি খসড়াপ্রস্তাব পেশ করেন। কংগ্রেস ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রস্তাবে তিনি বলেন, প্রতি বৎসরে একই দিনেপ্রত্যেকটি দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করতে হবে। একই সাথে তিনি ৮ মার্চকে “আন্তর্জাতিক নারী দিবস” হিসেবে নিজে পালনকরেন। এরপর থেকেই পৃথিবীব্যাপী ৮ মার্চআন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়ে আসছে।
১৯০৮ সালে জার্মান সরকার নারীদের রাজনৈতিক দলে অর্ন্তভুক্ত করার অনুমতি দিলে তিনি নারীদের জন্য পার্টিতে আলাদা ফোরাম গঠনের প্রয়োজন অনুভব করেন। তিনি মনে করতেন, শুধু পুরুষদের দ্বারা দল পরিচালিত হলে সেখানে নারীদের দাবি যথাযথ গুরুত্ব পাবে না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে দল থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কোনো আন্দোলন করা যাবে না। এর প্রতিবাদে ইনি, কার্ল লিবনেখত (১৮৭১-১৯১৯), রোজা লুক্সেমবার্গ এবং দলের আরও কিছু প্রভাবশালী সদস্যবৃন্দ জার্মানির সমাজ গণতান্ত্রিক দল বা SPD থেকে সরে আসেন। কারণ যুদ্ধের সময় দলের কিছু সদস্য সরকার ও বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আন্দোলন না করার সুবিধাবাদী নীতি গ্রহণ করে। ফলে বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধবিরোধী কার্যক্রম ও আন্দোলন করার জন্য তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হন। ১৯১৪ সালের ৭ নভেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে জার্মান সোশ্যালিস্ট ডেমোক্রেটিক পার্টি বিরোধিতা করে। সেখানে জেৎকিন বলেছিলেন, যদি অধিক সংখ্যক নারীরা যুদ্ধ প্রতিরোধের জন্য শ্লোগান দেয় তাতেই জনগণের শান্তি নিশ্চিত হতে পারে। এটাই ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক বিরোধিতা। সম্মেলন শেষ হবার পরেই তিনি গ্রেফতার হন। যুদ্ধবিরোধী কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে বার্লিনে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারীদের নিয়ে যুদ্ধবিরোধী সম্মেলন করেন। ১৯১৬ সালে স্পার্টাকাসপন্থী লিগের তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
১৯১৭ সালে জার্মানির সমাজ গণতান্ত্রিক দল বা SPD ভেঙে Independent Social Democratic Party of Germany বা সংক্ষেপে USPD গঠিত হলে এটিরও তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি বা Communist Party of Germany বা সংক্ষেপে KPD প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর সাথে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯২০ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত রাইখস্ট্যগে ( Reichstag) এই দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯২০ সালে তিনি লেনিনের একটি সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারটির শিরোনাম ছিলো— The Women’s Question. ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসের সদস্য ছিলেন। ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯২১ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বা কমিন্টার্নের এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য পদে ছিলেন। এসবের ভিতরেই ১৯২৫ সালে জার্মান বাম সংগঠন Rote Hilfe বা “লাল সাহায্য”-এর সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন। ১৯৩২ সালে প্রবীণ সদস্য হিসাবে রাইখস্ট্যাগের চেয়ার-ওম্যান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি জাতীয় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। ক্লারা জেটকিন রুশ বিপ্লবের মহান নেতা কমরেড লেনিনের সাথে বহুবার সাক্ষাত করেছেন। কমরেড লেনিন ক্লারা জেটকিনের নারী প্রশ্নে কিছু ভুল দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছেন এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়েছেন। ক্লারা জেটকিন কমরেড লেনিনের সমালোচনা, পরামর্শগুলো গুরুত্বসহকারে শুনেছেন এবং গ্রহণ করেছেন।
জীবনের শেষ কয়েক বছর ক্লারা জেটকিন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ায় কাটিয়েছেন এবং সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণ পর্যবেক্ষণ করেছেন। সোভিয়েত যৌথখামারের নারীদের মাঝে তিনি ছিলেন অতি প্রিয়জন।
জার্মানিতে এ্যাডলফ হিটলারের National Socialist German Workers Party ক্ষমতায় এলে রাইখস্ট্যাগের জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ১৯৩৩ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে পুনরায় নির্বাসনে চলে যান। এর কিছুদিন পর শারীরিক অসুস্থতা উপেক্ষা করে তিনি জার্মানির রাইখস্টাগে বক্তৃতা দিতে যান। ১৯৩২ সালের ৩০ আগস্ট ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বের বিরুদ্ধে তিনি বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতায় তিনি শ্রমজীবী সর্বহারা নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন;—মনে রেখ বোনেরা, ফ্যাসিবাদ চায় তোমাদের শুধু দাসি ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বানাতে। ভুলো না সেই নারী যোদ্ধাদের যারা ফ্যাসিবাদীদের হাতে প্রাণ দিয়েছে এবং কারাগারের অন্তরালে আছে। রাইখস্টাগে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ভাষণ দেয়ার সময় তিনি জার্মান ফ্যাসিস্ট বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং তাদের অত্যাচারে ১৯৩৩ সালের ২০ জুন ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৩৮ সালের ৮ মার্চ নারী মুক্তির মহান নেত্রী ক্লারা জেটকিনকে “অর্ডার অব লেনিন”— এই মর্যাদাপূর্ণ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
তথ্যসূত্র ও টিকাঃ
১. এই লেখাটির অধিকাংশ তথ্য ইংরেজি উইকিপিডিয়া এবং বিপ্লবী নারীমুক্তির মুখপত্র নারীমুক্তি’র দ্বিতীয় সংখ্যা ফেব্রুয়ারি, ২০০৪ থেকে নেয়া হয়েছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।