চালমুগড়া বা ডালমুগরি পাহাড়িঞ্চলে জন্মানো ভেষজ বৃক্ষ

চালমুগড়া

বৈজ্ঞানিক নাম: Hydnocarpus kurzii (King) Warb. in Engl. & Prantl. Pflanz. 3(6a): 21 (1893). সমনাম: Hydnocarpus heterophyllus Kurz (1877), Taraktogenos kurzii King (1890). ইংরেজি নাম: Chaulmoogra. স্থানীয় নাম: চালমুগড়া, ডালমুগরি।
জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ/রাজ্য: Plantae. বিভাগ: Tracheophytes. অবিন্যাসিত: Eudicots. বর্গ:  Malpighiales. পরিবার: Achariaceae. গণ: Hydnocarpus প্রজাতির নাম: Hydnocarpus kurzii

ভূমিকা: চালমুগড়া বা ডালমুগরি (বৈজ্ঞানিক নাম: Hydnocarpus kurzii) এক প্রকারের ভেষজ বৃক্ষ। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে সংকটাপন্ন।

চালমুগড়া বা ডালমুগরি-এর বর্ণনা :

চালমুগড়া বা ডালমুগরি চিরসবুজ, পত্রঝরা বৃক্ষ। তবে পুং পুষ্পে কিছু সংখ্যক উভলিঙ্গ পুষ্প থাকে। উচ্চতায় ১৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। যা সরু মুকুটাকার ও ঝুলন্ত শাখাযুক্ত, বাকল ধূসর, বাদামি বা বাইরের দিকে প্রায় কালো, প্রায় সাদা দাগযুক্ত, ভেতরের দিক হলুদ বা হলুদাভ-বাদামী। বিটপ, অপরিণত পত্র এবং পুষ্পবিন্যাস তামাটে রোমাবৃত।

পত্র সরল, ৯-২৫(-৩০)× ৩-৭ (-১০) সেমি, পরিবর্তনীয়, ঝিল্লিময়, বল্লমাকার, আয়তাকার- বল্লমাকার বা উপবৃত্তাকার-আয়তাকার, প্রায় চর্মবৎ, অখন্ড, খাটো স্থূলাগ্র বা হঠাৎ লম্বা দীর্ঘাগ্র, নিম্নে পৃষ্ঠের গৌণ শিরা লক্ষণীয়, প্রগৌণ শিরা অনুপ্রস্থ এবং সমান্তরাল, অসংখ্য পত্রবৃন্ত প্রসারিত এবং উপরের প্রান্ত সামান্য ১-৩ সেমি লম্বা।

পুং পুষ্প: ৮-১২ মিমি চওড়া, ফিকে হলুদ, সাধারণ মঞ্জরীদণ্ডের শীর্ষে দুটি ঘন গুচ্ছের প্রতিটিতে ৩-৫ টি সজ্জিত, ৭-১৫ মিমি লম্বা, মঞ্জরীদণ্ড ২-৩ মিমি লম্বা, পুষ্পবৃন্ত ৭-১০ মিমি লম্বা, সবগুলি শক্ত, ক্ষুদ্র, তামাটে রোমশ, বৃত্যংশ প্রায় ৫ × ৪ মিমি, ডিম্বাকার-গোলাকার, তামাটে রোমাবৃত, দল প্রায় ৪ মিমি লম্বা, প্রশস্ত ডিম্বাকার থেকে ডিম্বাকার-গোলাকার, ২ সারিতে বিন্যস্ত, সিলিয়াযুক্ত, প্রত্যেকের গোড়াতে রসালো রোমশ গ্রন্থিযুক্ত, শীর্ষে সাদা ঘন কোমল দীর্ঘ রোমযুক্ত, পুংকেশর ১৭-২৪টি, প্রায় ৪ মিমি লম্বা, মুক্ত, পুংদণ্ড দীর্ঘ রোমযুক্ত, বন্ধ্যা পুংকেশর ৫- ৯টি।

স্ত্রী পুষ্প : ৫ মিমি লম্বা মঞ্জরীদণ্ডের উপরে ঘন গুচ্ছাকার, কদাচিৎ লুপ্ত হয়ে একল, পুষ্পবৃত্তিকা প্রায় ১২ মিমি লম্বা, শক্ত ক্ষুদ্র তামাটে রোমশ, গর্ভাশয় ডিম্বাকার, ৬- ৭টি অস্পষ্ট সভঙ্গ বিশিষ্ট, ঘন তামাটে রোমাবৃত, গর্ভমুণ্ড ৪টি। ফল বেরী, গোলাকার, কখনোও প্রশস্ত শীর্ষক, ১.৫ সেমি পর্যন্ত আড়াআড়ি পত্রবৃন্তের উপর ৫ সেমি পর্যন্ত চওড়া, ফলত্বক গ্রন্থিময়, তামাটে-মখমল সদৃশ। ফলত্বক লালচে-বাদামি। বীজ ১২-১৬টি, প্রায় ২.৫ সেমি লম্বা, বিষম ডিম্বাকার, মণ্ডাকার অংশে অন্তঃনিহিত।

আরো পড়ুন:  ছায়া উষ্ণমণ্ডলী অঞ্চলে জন্মানো ঔষধি বিরুৎ

ক্রোমোসোম সংখ্যা : ২০ = ২৪ (Fedorov, 1969, Taraktogenos kurzii King এর অধীনে)।

আবাসস্থল ও বংশ বিস্তার:

চিরসবুজ পাহাড়ী বনাঞ্চল। ফুল ও ফল ধারণ সময় জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি মাস। বীজ থেকে বংশ বিস্তার হয়।

বিস্তৃতি:

ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে পাওয়া যায় যেমন আসামের উপরাংশ, মনিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড এবং পেনিনসুলার মালয়েশিয়া। বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রাম জেলার বনাঞ্চল, কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত (Das and Alam, 2001)।

অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:

১৯৪৬ সালে সালফা ড্রাগ উৎপাদনের পূর্ব পর্যন্ত এর বীজ বানিজ্যিক চাউলমুগরা তেলের উৎস যা কুষ্ঠব্যাধি চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর। চাউলমুগরা তেল একটি স্থায়ী তেল যা গ্লিসারাইডের সাইক্লোপেনটেনাইল ফ্যাটি এসিডের ন্যায় হাইড্রোকারপিক এসিড (৪৮%), চাউলমুগরিক এসিড (২৭%), গোরলিক এসিড (২৩%), অলিক এসিড (১২%) এবং পালমিটিক এসিড (৬%) ধারণকৃত, তেলে উপস্থিত ফ্যাটি এসিড Mycobacterium leprae (কুষ্ঠ রোগের জন্য দায়ী অণুজীব) এবং M. tuberculosis যা সুনির্দিষ্ট একটি বিষাক্ততা সৃষ্টি করে। চীন এবং আর্জেটিনায় এই তেল ক্যান্সার রোগের প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয় (Ghani, 2003)।

চালমুগড়া বা ডালমুগরি-এর জাতিতাত্ত্বিক ব্যবহার:

বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট এবং চট্টগ্রাম জেলার বনাঞ্চলের আদিবাসীরা বিভিন্ন ত্বক সংক্রান্ত রোগ, ডায়রিয়া এবং বাতজনিত রোগে এই চাউলমুগরা তেল ব্যবহার করে। মায়ানমার এবং থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসকরা এর বীজ চর্মসংক্রান্ত রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করেন।

অন্যান্য তথ্য:

বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ০৮ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) চালমুগড়া প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, উদ্ভিদের মাত্রাতিরিক্ত আহরণ এবং আবাসস্থল ধ্বংসের কারণ বাংলাদেশে এটি সংকটাপন্ন হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে চালমুগড়া সংরক্ষণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, কিছু বনাঞ্চল এবং বাংলোর আঙ্গিনায় ব্যতীত সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটি বীজ থেকে চারা গজাতে হবে এবং সিলেট এবং চট্টগ্রাম বনাঞ্চলে ব্যাপকভাবে বনায়ন করতে হবে।

আরো পড়ুন:  কদবেল বা কৎ বেল গাছ ও ফলের দশটি ভেষজ ব্যবহার ও প্রয়োগ

তথ্যসূত্র:

১. এম এ হাসান এবং এম আজিজুর রহমান লস্কর (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ০৮ম (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২২৮। আইএসবিএন 984-30000-0286-0

Leave a Comment

error: Content is protected !!