গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র নদী বিধৌত সমভূমির গড়ে উঠার সাথেই জড়িয়ে আছে সুন্দরবনের উৎপত্তির কাহিনী। প্রাচীনকালে গঙ্গা নদীর মূল প্রবাহ সমুদ্রে পড়ত বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদী দিয়ে। যদিও সে সময়ও গঙ্গার শাখানদী পদ্মা দিয়ে মাঝারি ধারার একটি প্রবাহ মেঘনা নদীর সঙ্গমে বঙ্গোপসাগরে পড়ত। তবে পদ্মার সঙ্গে যোগ হয়েছিল ব্রহ্মপুত্রের। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের মিলিত প্রবাহে যুক্ত হয় মেঘনা। এদের সম্মিলিত প্রবাহ গিয়ে পড়ে বঙ্গোপসাগরে। আদি গঙ্গার মোহনা থেকে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত এলাকায় গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনার অনেক দক্ষিণ প্রবাহিনী শাখানদীও সাগরে বিলীন হয়। ফলে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এলাকা পর্যন্ত গড়ে ওঠে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মোহনা অঞ্চল। বৃহত্তমটি দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন মোহনা অঞ্চল। তবে আমাজন মোহনা বিস্তারে বড় হলেও দৈর্ঘ্যে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা মোহনাই গরীয়ান।
১৫৫৮ সালের ভূমিকম্পসহ মারাত্মক সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে গঙ্গার মূল প্রবাহ পদ্মা দিয়ে বইতে থাকে। এ মোহনার বিস্তৃতি প্রায় ৩০০ মাইল। গোয়ালন্দকে এই ত্রিভুজাকার মোহনার শীর্ষবিন্দু ধরলে এলাকাটির আয়তন দাঁড়ায় ২০ হাজার বর্গমাইল। এই পুরো এলাকা গড়ে উঠেছে মূলত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রবাহিত পলিতে। এই এলাকায় এবং এর উত্তরাংশে বছরে গড় বৃষ্টি হয় ৮০ থেকে ১২০ ইঞ্চি; অর্থাৎ একেকটি অঞ্চলে প্রায় ১২ ফুট জলস্তরের সমান জল পড়ে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় হাওয়াই দীপপুঞ্জের কাউই দ্বীপের পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট ওয়েলিতে। পরিমাণ বছরে ৪৭১.৬৮ ইঞ্চি। এর পরই ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার চেরাপুঞ্জির স্থান। বছরে এখানে গড় বৃষ্টি হয় ৪৩৬.৫৩ ইঞ্চি।
উত্তরাঞ্চলের এই বিপুল বৃষ্টিপাতে প্রবল ভূমিধস ও নদীভাঙনে জমির উপরিভাগের মাটির স্তর থেকে মিহি পলি নিয়ে বর্ষার গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের জল যখন সমুদ্রে আসে, তখন এর প্রতি ঘন গজে পলি থাকে ২৫০ গ্রামের মতো। ওপর থেকে আসা মিষ্টি পানির চেয়ে সমুদ্রের পানির আপেক্ষিক ঘনত্ব বেশি। ফলে এই পলিমাটির প্রবাহ সমুদ্রে মিলিত হতে পারে না। তার ওপর সমুদ্রের জোয়ারের জোর নেমে আসা পানির চেয়ে বেশি হওয়ায় এ পলিমাটি আবার উত্তরে বিক্ষিপ্ত হতে গিয়ে মোহনায় থিতিয়ে পড়ে। জন্ম নেয় চরাঞ্চল। পলি জমতে জমতে চরগুলো উঁচু ভূমিতে পরিণত হয়, তাতে আশপাশের গাছপালার বীজ আশ্রয় নিয়ে সৃষ্টি করে বনাঞ্চলের। এসব বনাঞ্চলের নাবালো অংশগুলোয় জেগে ওঠে শত শত নদীনালা ও খাল। কোনো কোনো অঞ্চলে চরাভূমির কোনো স্তর সম্পূর্ণ বালুর হলে নাবালো খাল বা নদী চোরাস্রোতে ও সাইক্লোনে নদীর গতিপথে চাপ পড়লে বালুর স্তর ধুয়ে যায়। গাছপালাসহ সেই চর দেবে গিয়ে তখন জন্ম হয় বিলাঞ্চলের।[১]
পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বা প্যারাবন বাংলাদেশের সুন্দরবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর নদী, যা জালের মতো ঘিরে রেখেছে এই অরণ্যভূমিকে। সুন্দরবনের নদীর উল্লেখ আছে পুরাণ কাহিনিতে, সাহিত্য, গল্পে, কবিতায় সেই আদিযুগ থেকে। সুন্দরবনের বাঘ আর সুন্দরী গাছ যদিও পৃথিবী বিখ্যাত কিন্তু এর নদীনালার সঙ্গে আছে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক, যা বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প চিত্রকলায় সমৃদ্ধি লাভ করেছে। সুন্দরবনের ভূ-গঠনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এবং এদের বাহিত পলি। সুন্দরবনকে ঘিরে রাখা নদীগুলো যুগ যুগ ধরে অনুপ্রাণিত করেছে শিল্পী-সাহিত্যিকদের।আর নদীর নামও কী চমৎকার পশুর, সিপসা, রাইমঙ্গল, বলেশ্বর, আরো কত কী।[১]
সুন্দরবন অঞ্চলের খাল গাং ও নদীমালা আছে প্রায় দু শতাধিক। এখানে এসব খাল, গাং ও নদীসমূহের মোট ১৭৭টি নাম দেয়া হলো।[২] এসব নদী হচ্ছে বলেশ্বর, সুপতি, ছাপড়াখালি, বড় শেওলা, হরিণটানা, শরনখোলা, আমবাড়ে, চান্দেশ্বর, কাপা, কালিদা, সঠকা, জাভো, মরা পসুর, ডাংমারি, বিলে, ছুতোরখালি, চালৈ বগি, হরমহল, বেড়ি আদা, বাকির খাল, আড়ো শিবসা, হড্ডা, মহিষে, ছাছোন, হোগলা, মজ্জাত, শাকবাড়ে-সিঙ্গা, গোলখালি, কুকুমারি, কলাগাছে, ডোমরখালি, হংসরাগ, কাগা, নীলকমল, খেজুরদানা, সেজিখালি, বাইনতলা, বাঙ্গাবালী, দোবেকি, ফিরিঙ্গি, মানদো, কেওড়াসুতী, বন্দো, ধকোলা, লতাবেড়ি, ভেটুইপাড়া, বালুইঝাঁকি, কালিকাবাড়ি, বেকারদোনে, আন্ধারমানিক, ঝালে, পাটকোষ্টা, বাসে, গোলভকসা, ধানিবুনে, হরিখালি, মনসার বেড়, পুষ্পকাটি, গঙ্গাসাগর, কালী লাই, বগী চেঁচানে, কুড়েখালি, ভূয়ের দনে, কাঠেশ্বর, সোনারুপাখালি, দুধমুখ, লাঠিকারা, তেরকাটি, ধানঘরা, আড়বাসে, দক্ষিণচরা, সাপখালি, কদমতলি, বুড়ের ডাবুর, লক্ষ্মী পশর, মানকি, আশাশুনি, তালতক্তা, ধ্বজিখালি, মণ্ডপতলা, নেতোখালি, ভায়েলা, বাগানবাড়ি, ঝাড়াবাগনা, বগাউড়া, বকশখালি, চাইলতাবাড়ি, সিঙ্গড়তলি, মাথাভাঙা, নারায়ণতলি, কইখালি, মথুরা, খাসিটানা, আগুন জ্বালা, ফুলঝুরী, মালাবগা, খামুরদানা, উবদে, গুবদে, সোনাইপাঁঠী, ধোনাইর গাঙ, কানাইকাঠি, মরিচঝাঁপি, নেতাই, তালপাঠী, ধনপতি, রাগাখালি, মুক্ত বাঙাল, আরিজাখালি, দুলোর টেক, যিনগিলি, বিবির মাদে, টেকখালি, দেউর যাদে, চামটা কামটা, কুঞ্চে মাঠে, ব্যয়লা কয়লা, মাদার বাড়ে, বয়ার নলা, হান কে, ধঞ্চের নদী, কলাগাছে, মূল্যে মেঘনা, বাইলো, বেতমুড়ি, বুড়িগোল্লি, চুনকুড়ি, মায়াদি, ফুলবাড়ি, তালতলি, আংড়া কনা, গাড়ার নদী, বাদাম তলি, ভুতের গাং, বৈকুণ্ঠ হানা, করপুরো, ছায়া হলড়ি, আড়া ভাঙা, তালকপাঁঠী, খেজুরে কুড়ুলে, ছোটো শেওলা, কাঁচিকাটা, দাইর গাং, বৈকিরী, জালঘাটা, ইলিশমারী, ঝলকি, সাতনলা, মুকুরনি, হেলার বেড়, কালিন্দে, শাকভাতে, গোন্দা, পালা, তেরবেঁকি, তালবাড়ে, হেড় মাতলা, ভূড়ভূড়ে, ছদনখালি, ফটকের দনে, ভরাকুণ্ডে, কেঁদাখালি, নওবেঁকি, কলসের বালি, পানির খাল, কুলতলি, বলবাড়ে, মুকুলে, মধুখালি, পাশকাটি, গোছরা, ঘাট হারানো, গাবান্দারা, লোকের ছিপী, বাহার নদীপার, বড় মাতলা, পেয়েরা ঠুনী, কালবেয়ারা, ঢুকুনী, পারশেমারী।[৩]
সুন্দরবনে প্রবেশের আগে সিবসা নদী ভদ্রা নদী হয়ে পশুর নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। মালঞ্চ নদীকে সুন্দরবনের বাইরে চুনের নদীও বলা হয়। এটি সুন্দরবনে ঢোকার আগে ইছামতি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। আবার কদমতলি দিয়ে মালঞ্চ নদী সুন্দরবনে ঢুকেছে। ভারতের সুন্দরবন আর বাংলাদেশের সুন্দরবনের সীমানা চিহ্নিত হয়েছে কালিন্দী নদী দিয়ে। কালিন্দী বারবার এসেছে সাহিত্যে ও পুরাণ কাহিনীতে।[৪]
আরো একটি চমৎকার নদী এসেছে কাহিনির অলঙ্কার হিসেবে। তা হলো ফুলজোড়। করতোয়ার শাখা নদী ফুলজোড় নিয়ে আছে চমৎকার উপাখ্যান । আবার করতোয়াকে নিয়েও রচিত হয়েছে হিন্দুদের অবতার কাহিনি । নদী এভাবে বারবার সমৃদ্ধ করেছে শিল্প সাহিত্যকে।[৫]
তথ্যসূত্র:
১. খসরু চৌধুরী, সুন্দরবনের বাঘ, প্রথমা ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, এপ্রিল, ২০১১, পৃষ্ঠা ৩২।
২. মানিক, মোহাম্মদ রাজ্জাক (ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)। বাংলাদেশের নদনদী: বর্তমান গতিপ্রকৃতি। ঢাকা: কথাপ্রকাশ। পৃ: ৪৬১-৪৬২। আইএসবিএন 984-70120-0436-4।
৩. Alam, Mohd Shamsul; Chowdhury, Masud Hasan (2012). “River”. In Islam, Sirajul; Jamal, Ahmed A. Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh (Second ed.). Asiatic Society of Bangladesh.
৪. ড. অশোক বিশ্বাস, বাংলাদেশের নদীকোষ, গতিধারা, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃষ্ঠা ৪০৭-৪০৮, আইএসবিএন ৯৭৮-৯৮৪-৮৯৪৫-১৭-৯।
৫. মানিক, মোহাম্মদ রাজ্জাক, পূর্বোক্ত।
৬. মানিক, মোহাম্মদ রাজ্জাক, পূর্বোক্ত।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।