পরিচয়: আম বাংলাদেশের প্রধান ফল এবং আম গাছ হচ্ছে জাতীয় বৃক্ষ। আম বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল। আমকে এদেশে ফলের রাজাও বলা হয়। আমের ইংরেজি নাম Mango. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ যাবৎ আমের ৪১টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশ চাষকৃত ভালো জাতই অ্যানাকার্ডিয়েসী পরিবারের Mangifera indica L. প্রজাতির অন্তর্গত। বাকিগুলোর অধিকাংশই বন্য প্রজাতি।
ভেষজ গুণ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন আমের ঔষধি গুণাগুণ
আমগাছ একটি বৃক্ষজাতীয় বহুবর্ষী উদ্ভিদ। প্রধান মূল বেশ দীর্ঘ ও মজবুত হয়। গাছের তরু ক্ষীর আঠালো, কাণ্ড শক্ত, মোটা ও দীর্ঘ হয়ে থাকে। প্রধান কাণ্ড থেকে শাখা প্রশাখা বহির্মুখীভাবে বিস্তৃত হয়ে ছাতার মতো ঝোপ গড়ন তৈরি করে। আম গাছ সাধারণত ৩৫-৪০ মিটার বা ১১৫-১৩০ ফুট লম্বা এবং সর্বোচ্চ ১০মিটার বা ৩৩ ফুট ব্যাসার্ধের হয়ে থাকে। আম গাছ বহু বছর বাঁচে, এর কিছু জাতকে ৩০০ বছর বয়সেও ফলবতী হতে দেখা যায়। এর প্রধান শিকড় মাটির নীচে প্রায় ৬ মিটার বা ২০ ফুট গভীর পর্যন্ত যেতে দেখা যায়।
আম গাছের পাতা চিরসবুজ, সরল, পর্যায়ক্রমিক, ১৫-৩৫ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ৬-১৬ সেন্টিমিটার চওড়া হতে দেখা যায়। আমের কচি পাতা দেখতে লালচে-গোলাপী রং এর হয়। পাতা সরল, লম্বাটে পত্রফলকবিশিষ্ট ও একান্তর।
প্রশাখা বা ডালের অগ্রভাগ থেকে শীর্ষক ছড়ায় পুষ্পমঞ্জরী উৎপন্ন হয়। ডগাসমূহ পরিমিত মাত্রায় পূর্ণতা লাভের পরই কেবল তাতে পুষ্পমঞ্জরী উৎপন্ন হয়। আমের মুকুল বের হয় ডালের ডগা থেকে, মুকুল থেকে শুরু করে আম পাকা পর্যন্ত প্রায় ৩-৬ মাস সময় লাগে। এজন্য আমের অধিকাংশ জাতের গাছই এক বছর পর পর অধিক ফল হতে দেখা যায়। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে সাধারণত প্রশাখার অগ্রভাগে কুঁড়ির দেখা যায়। জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাসে মুকুল বের হয় এবং পুষ্পমঞ্জরী দু ধরনের ফুল ধারণ করে। পুরুষ ও উভয়লিঙ্গী গাছে ফুল ফোটে তবে মাঝে মাঝে নিরপেক্ষ ফুলও দেখা যায়। পুষ্পধারণকাল সাধারণত ২ থেকে ৩ সপ্তাহের বেশি হয় না। ফুল আকৃতিতে খুব ছোট। বৃতি ও পাঁপড়ি সাধারণত ৫টি। পুংকেশর সাধারণত ১০টি এবং তা দুটি আবর্তে সজ্জিত। এই ফলটি একটি অতিমাত্রায় পরপরাগায়িত উদ্ভিদ। কীটপতঙ্গ ও বাতাসের সাহায্যে আম গাছের পরাগায়ন ঘটে থাকে। প্রাকৃতিকভাবে অর্ধেকেরও বেশি ফুল পরাগরেণু গ্রহণ করতে পারে না। পুষ্পমঞ্জরী ছড়ার অগ্রভাগে সাধারণত উভলিঙ্গী ফুল্গুলো অবস্থান করে। এজন্য ফল সর্বদাই ছড়ার অগ্রভাগে ঝুলতে থাকে। ফল একক সরস শ্রেণীর ডুপ জাতীয় এবং অমরাবিন্যাস অক্ষীয়।
আম-এর জাত:
ভারতে ৪২০ জাতের আম থাকলেও বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ১৫০ জাতের। ফাগুনে বা বসন্তকালে আমের বনে ফুল ফোটে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা কি আমাদের ১৫০ জাতের আম রক্ষা করতে পারব? এখনো আমরা সব জাতগুলোকে রক্ষার জন্য একটি জার্মপ্লাজম কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারিনি। আমার স্বপ্ন কি কখনো পূরণ হবে? আমরা কি সমস্ত উদ্ভিদের একটি সংরক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারি না। ভারত ৪২০ জাতের আমের বিশাল জার্মপ্লাজম সেন্টার গড়ে তুলেছে। আর আমরা কি করেছি? কোনোদিন তো কোনো পত্রিকায় দেখলাম না বাংলাদেশের কতগুলো আম বিলুপ্ত হলো তা নিয়ে খবর করতে।
বিস্তৃতি:
আম আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল এবং একে ফলের রাজা’ বলা হয়ে থাকে। আম বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা যায়। বাণিজ্যিকভাবে আম বাংলাদেশের নওয়াবগঞ্জ, ভোলাহাট, শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর প্রভৃতি এলাকায় বড় বড় আমবাগান গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া রাজশাহী, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা ও যশোরের কিছু বাণিজ্যিক বাগান রয়েছে। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আমই সর্বোক্তৃষ্ট। বাংলাদেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমের জন্য বিখ্যাত। ‘কানসাট আম বাজার’ বাংলাদেশ তথা এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ আম বাজার হিসেবে পরিচিত। মকিমপুর, চককির্ত্তী, লসিপুর, জালিবাগান, খানাবাগান সহ বিশেষ কিছু জায়গায় অত্যান্ত সুস্বাদু এবং চাহিদার পর্যাপ্ত আম পাওয়া যায়।
আমকে কয়েক হাজার বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে চাষ করা হচ্ছে। পূর্ব এশিয়াতে আমের প্রচলন হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫ম-৪র্থ শতাব্দী থেকে এবং এর চাষাবাদ আরম্ভ হয় আরো পরে দশম শতাব্দীর সময়। বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ ছাড়াও পৃথিবীর অন্য যেসব দেশে ভারতীয় উপমহাদেশের মত জলবায়ু রয়েছে সেসব দেশে অনেক পরে আমের চাষ শুরু হয়েছে। যেমন ব্রাজিল, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ বা মেক্সিকোতে আরো অনেক পরে আমের প্রচলন ও উৎপাদন শুরু হয়। মরোক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা চতুর্দশ আমের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত উষ্ণ প্রধান জলবায়ুর অঞ্চলগুলোতে আমের ফলন হয়। এর মধ্যে অর্ধেকের কাছাকাছি আমের উৎপাদন হয় শুধুমাত্র ভারতেই। এর পর অন্যান্য যেসব দেশ আম উৎপাদন করে তার মধ্যে আছে চীন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর-দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ-পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকা প্রভৃতি।
আগে থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে আমের উৎপত্তিস্থল বলে বিবেচনা করা হয়। তবে নানা গবেষণা পড়ে জানা যায় বার্মা, থাইল্যান্ড, ইন্দো চীন, মালয় পেনিনসুলা আমের বিভিন্ন প্রজাতি গঠনের মূল কেন্দ্রস্থল। পরবর্তীতে জাভা, সুমাত্রা, ব্রুনাই, ফিলিপাইন প্রভৃতি স্থানসমূহকে আমের দ্বিতীয় উৎপত্তিস্থল ভাবা হয়। পাক ভারত উপমহাদেশ ছাড়াও ১৫ ও ১৬ শতকের দিকে বিভিন্ন মুসলিম মিশনারি, স্প্যানিশ অভিযাত্রী ও পর্তুগিজদের দ্বারা গ্রীষ্ম ও অগ্রীষ্মমণ্ডলীয় বিভিন্ন দেশে আমের বিস্তার ঘটে। বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, বার্মা, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ফিজি, অস্ট্রেলিয়ার উষ্ণমণ্ডল, মিশর, ইসরায়েল, সুদান, সুমাত্রা, সোমালিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, তাঞ্জানিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজার, জায়ার, নাইজেরিয়া, মাদাগাস্কার, ফ্লোরিডা, হাওয়াই, পোর্টেরিকা, ভেনিজুয়েলা, মেক্সিকো, ব্রাজিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রভৃতি দেশে আম চাষ করা হয়।[১]
চাষ পদ্ধতি:
আম গাছ বীজ থেকে জন্মে আবার কলম চারাও করা যায়। বীজ থেকে চারা করে সে গাছ থেকে ফল পেতে সময় লাগে বেশি। তবে কলম চারা থেকে ফল পাওয়া যায় লাগানোর পরের বছর থেকে। দো-আঁশ, এঁটেল মাটিতে এই গাছ ভালো হয়। ভালো ফল পাওয়ার ও গাছকে সুস্থ রাখার জন্য সার, পানি দিয়ে ইত্যাদিভাবে পরিচর্যা করতে হবে।
ব্যবহৃত অংশ:
ফলের মধ্যতৃক তবে আচার হিসাবে ত্বকসহ মধ্যত্বক এবং ভেষজ হিসাবে বীজ ব্যবহৃত হয়। আমকে বলা হয় ফলের রাজা। সারা বিশ্বে আম ফলের চাহিদা অনেক। আমে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন এ, বি, সি আর উল্লেখয্যোগ্য পরিমাণে খনিজ লবণ ও খাদ্যশক্তি। পাকা আম থেকে তৈরী চাটনী, আমসত্ব, স্কোয়াস ইত্যদি খাবার তৈরি করা কাঁচা আম থেকে তৈরী জ্যাম, জেলি, আচার, চাটনী, আমচুর ইত্যাদি খাদ্য তৈরি করা হয়।[২]
দারুবৃক্ষ:
আম গুরুত্বপূর্ণ একটি দারুবৃক্ষ। আম কাঠ মাঝারি ভারি ও নরম। ফলে সরু বাটালি দিয়ে নকশা কাটা যায় এবং কাঠ খসখসে। আমের কাঠ সস্তা আসবাবপত্র, দরজা ও জানালার প্যানেল তৈরিতে ব্যবহূত হয়। সারা দেশে বসতবাড়িতে জন্মে।
তথ্যসূত্রঃ
১. মৃত্যুঞ্জয় রায়; বাংলার বিচিত্র ফল, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা, ৫৭-৫৯।
২. গ্রিন মিজানুর রহমান; রোগ-শোক-ক্ষুধা মুক্তিতে বাংলার উদ্ভিদ, ফেসবাংলা লিমিটেড, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ৫ জুন ২০১৪ তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ ৫ জুন ২০১৫ পৃষ্ঠা, ৬ অধ্যায়।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।