ভূমিকা: মুলা বা মূলা বা মুলোর বোটানিকাল নাম Rephanus Sativus Linn, পরিবার Brassicaceae, হিন্দিভাষী অঞ্চলের মানুষ এটিকে মূলী বলে। এই কন্দ শাকটির পরিচিতির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না, যেহেতু এটি ভারত ও বাংলার প্রায় সর্বত্রই শাক ও তরকারি হিসেবে খাওয়ার জন্য চাষ করা হয়। শীতপ্রধান অঞ্চলে ১২ মাস চাষ হয়। এই গাছ ৮ থেকে ১০ হাজার ফুট উচ্চতায়ও চাষ হয়ে থাকে; তবে উষ্ণপ্রধান অঞ্চলে কেবল মাত্র শীতকালেই চাষ হয়। জৌনপুর অঞ্চলের এক একটি মূলা মানুষের উরুর মতো মোটা হতে দেখা যায়; হয়তো আবহাওয়া ও মাটির জন্যই এর এতটা বাড় বৃদ্ধি। পাশ্চাত্য উদ্ভিদবিজ্ঞানীগণ বলেন লাল রংয়ের মূলা নাকি বৃটেন থেকে এসেছে। মুলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন
মুলা বিভিন্ন পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ সবজি
শীতের শেষে মূলা গাছে ফুল, তারপর সরষের মতো শুঁটি ও বীজ হয়। এই বীজ পুনরায় চাষ হয়ে থাকে। মুলার ব্যবহারোপযোগী অংশ পাতা, মূল, ফুল ও বীজ।
মুলার লোকায়তিক ব্যবহার
১. শোথে: শোথ হলেই যে মূলোয় উপকার হবে তা নয়; যে শোথে কফের প্রাধান্য থাকবে, সেখানেই কেবল এর উপকার হয়। এটা যে কফজ শোথ, তার লক্ষণ হলো যেখানে শোথ হয়েছে, সেখানে টিপে দিলে বসে যায় আর সেটা স্বাভাবিক হতে একটু দেরি হয়। এই শোথে শুকনো মূলা ২০ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে, সেই ক্বাথটা দুই বেলায় খেতে হবে। একটা কথা জেনে রাখা ভালো এলার্জি বলে এখন যেটা প্রচলিত, সেটা আমাদের সংসর্গজ শোথ, এক্ষেত্রে উপরিউক্ত মুষ্টি যোগটি বিশেষ উপকারী।
২. হিক্কায়: খাদ্যনালীতে কোনো উত্তেজক দ্রব্যের সংস্পর্শ হলেই হিক্কার উদ্রেক হয়, যাঁদের হৃদ দৌর্বল্য থাকে, তাঁদের এই হিক্কার সঙ্গে শ্বাসেরও টান দেখা দেয়, যদিও সেটা সাময়িক। এই সময় একটু শুকনো মূলার ক্বাথ করে চুমুক দিলে ওটা কমে যাবে; শুকনো মূল পরিমাণ ৫ থেকে ৭ গ্রাম, জল ২ কাপ, সিদ্ধ হওয়ার পর থাকবে এক কাপ। সেটা ছেঁকে নিয়ে ৫ থেকে ৬ বারে একটু একটু করে খেতে হবে।
৩. আমাশয়: এর সঙ্গে প্রবল কোঁথানি, এক্ষেত্রে শুকনো মূলা ১০ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সমস্ত দিনে ৪ থেকে ৫ বারে ঐ ক্বাথটা খেতে হবে, এর দ্বারা ঐ কোঁথানি সেই দিনই চলে যাবে। আর আমাশাটা দুই এক দিনের মধ্যেই সেরে যাবে।
৪. বাতজ্বরে: এ জ্বরে কাঁপানি থাকবে আর তার সঙ্গে বকবক করার প্রবণতা ও চোঁচামেচিও বাড়ে এবং সঙ্গে থাকে মুষ্কের যন্ত্রণা যদি পুরুষ হয় সেক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে কচি মূলা ৫০ গ্রাম আন্দাজ ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছোঁকে সেই জুসটা কয়েকবারে একটু একটু করে খেতে দিলে ঐ বাতজ্বরের উপসর্গ গুলির উপশম হবে। তবে জ্বরের চিকিৎসা পথিক করতে হবে।
মূলা জ্বর, শ্বাসের রোগ, নাকের রোগ, গলার রোগ ও চোখের রোগ সারাবার ক্ষমতা রাখে।
৫. মূত্রকৃচ্ছ্র: যে কৃচ্ছ্রতা বায়ুর জন্য এসেছে, সেক্ষেত্রে এর লক্ষণ হলো অল্প অল্প প্রস্রাব হয়, দাঁড়িয়ে বা বসে যেভাবে প্রস্রাব করতে যান না কেন, কোনোটাতেই সুবিধা হচ্ছে না, এক্ষেত্রে মূলার বীজ চূর্ণ এক বা দেড় গ্রাম জল দিয়ে খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে। এটি ব্যবহার করলে আর একটি রোগকে আটকে দেওয়া যায়; সেটি হলো পাথুরী রোগ।
মুলা পাতার রসে একটু সোডি-বাই-কার্ব মিশিয়ে খাওয়ালে প্রস্রাব পরিষ্কার হয় এবং কোনো কারণে প্রস্রাব জমে থাকার কষ্ট (মূত্রাবরোধ) দূর হয়।
কচি মুলার পাতা বেটে নিয়ে সোরা মিশিয়ে নাভির চারপাশে প্রলেপ দিলেও পরিষ্কার প্রস্রাব হয়ে যায়।
৬. কষ্ট রজে: মাসিক বা ঋতুস্রাব হওয়ার প্রাককালে কোমরে বা তলপেটে অসম্ভব যন্ত্রণা এবং স্রাবের স্বল্পতা, কোনো কোনো সময় মাথায় যন্ত্রণা, মুখেও অরুচি, এই অবস্থায় পড়লে মূলার বীজ চূর্ণ এক বা দেড় গ্রাম জলসহ সকালে ও বিকালে কিছু খাওয়ার পর খেতে হবে।
৭. পাথুরী রোগে: মূত্রথলিতে হবে যে পাথুরী, কেবলমাত্র সেইখানেই কাজ করবে; এই মুষ্টি যোগটি আরও ভালো হয় যদি মূলাশাক বেঁটে রস করে সেটাকে একটু গরম করে সকালে ও বিকালে দুইবার জল মিশিয়ে খাওয়া যায় তাহলে ভালো হয়, রসের মাত্রা ৩ থেকে 8 চা চামচ।
মুলা পাতার রসে সোরা (পটাশিয়াম নাইট্রেট) মিশিয়ে খাওয়ালে পাথরি সারে। ৮ চা চামচ মুলার বীজ আধ লিটার জলে ফুটিয়ে নিয়ে জল কমে অর্ধেক হয়ে গেলে সেই জল পান করালেও পাথরি রোগ (কিডনি বা গলস্টোনে পাথর হওয়া) সারে।
৮. ছুলিতে: দেশগাঁয়ে একে বলে ধূলোটে ছুলি, একটু র’গড়ে দিলে ধূলোর মতো পড়ে, এই রোগকে আয়ুর্বেদে বলা হয় ‘সিধ্ম কুষ্ঠ’। এক্ষেত্রে মূলার বীজ ৫ থেকে ৭ গ্রাম জলে বেটে গায়ে চন্দনের মতো লাগাতে হয়, এর দ্বারা আপাতঃদৃষ্টিতে ঐ ছুলিটা মিলিয়ে যাবে বা সেরে যাবে।
আবার মুলার বীজ বেটে নিয়ে মধুর সঙ্গে মিশিয়ে মুখে লাগালে মুখের কালো দাগ দূর হয়। মুলার বীজ পেঁয়াজের রসের সঙ্গে মিশিয়ে শরীরের সাদা দাগে লাগালে উপকার পাওয়া যায়।
৯. কান কটকটানিতে: এ রোগ উর্ধ্বাগত বায়ুতে পুঁজ শুকিয়ে গিয়েও হয়,আবার কানের পর্দায় যে স্নেহপদার্থ থাকে সেটাও এই বায়ু বিকারে শুকিয়ে তার জন্যও হয়। এই পরিস্থিতিতে মূলার রস একটু গরম করে দুই বা এক ফোঁটা করে দুইবেলা কানে দিতে হবে আর কাঁচা মূলা না পাওয়া গেলে শুকনো মূলা জলে সিদ্ধ করে একটু চেপে অথবা একটু থেঁতো করে, নিংড়ে ঐ রস দুই বা এক ফোঁটা কানে দিলে ঐ কুটকুটানি সেরে যাবে।
১০. অর্শ রোগে: অর্শ রোগীরা মুলার পাতা (শাক) বা মুলার শাকের রস খেলে উপকার পাবেন। এই রোগে মুলা খেলে উপকার পাওয়া যায়।
মুলার পাতার ও মুলার সাদা শাঁসের আর পাতার নীচের সবুজ অংশের রস পিষে বের করে নিন। এতে একটু ভাল ঘি মিশিয়ে খান- অর্শ ও রক্ত-পড়া অর্শ (রক্তা) সেরে যাবে।
শুকনা মুলার সুপ খাওয়ালে এবং শুকনা মুলা একটা কাপড়ের পুঁটলিতে বেঁধে তার সেঁক দিলেও অর্শের কষ্টে আরাম পাওয়া যায় ।
১১. টাক সমস্যায়: মাথায় ঘষলে চুলের বৃদ্ধি হয়। টাকে লাগালে নতুন চুল গজায়।
১২. পেটের সমস্যায়: দুপুর বা রাতে গুরু-পাক ভোজনের পরে মুলার রসে পাতিলেবুর রস মিশিয়ে খেলে পেটের ব্যথা ও গ্যাস কমে যায়।
কচি মুলার ঝোলে পিপুল চূর্ণ মিশিয়ে খেলে খিদে বাড়ে, বদহজম সারে, বদহজমের জন্যে বহ্নি বমি হয় বা পেটের অসুখ করে তাও সারে।
কচি মুলা চিনি মিশিয়ে খেলে বা মুলা পাতার রসে চিনি মিশিয়ে খেলে অ্যাসিডিটি বা অম্বলের দরুন মুখ টক হয়ে যাওয়ায় আরোগ্য লাভ হয়।
মুলার বীজ বা সরু সরু সিমের মতো ফল (গুজরাটে মুলার বীজ খাওয়ার খুব প্রচলন আছে) উষ্ণ, কফ ও বায়ু সারায়। প্রস্রাব বৃদ্ধি করে, পেট পরিষ্কার করায় এবং শরীরের ভেতরকার পাথর গলিয়ে বের করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
১৩. ত্রিদোষ নাশে: তবে ছোট ছোট কচি মুলা হালকা, সহজে হজম হয়, ত্রিদোষ (কফ, বাত ও পিত্তের দোষ) নাশ করে গলার আওয়াজ বা স্বর ভাল করে। বড় মুলার কিন্তু এত গুণ নেই বরঞ্চ তা শরীরে ত্রিদোষ অথাৎ কফ বাত ও পিত্তের দোষ সৃষ্টি করে। অবশ্য এ ব্যাপারটা ঘটে কাঁচা মুলা খেলে। ঘি বা তেলে রান্না করে খেলে বড় মুলাও কফ, পিত্ত বা বাত নাশক হয়। মুলার ফুলও কফ, পিত্ত নাশ করে।
১৪. শরীর ফোলা কমাতে: মুলা আর তিল একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে শরীর-ফোলা কমে আর যদি ত্বকের নিচে কোনো কারণে জল জমে তাও সেরে যায়। মুলার পাতার ৫ থেকে ৬ চামচ রস খাওয়ালেও ফুলা তাড়াতাড়ি কমে যায়।
১৫. খিচুনিতে: শুকনা মুলার ঝোল রান্না করে এক ঘণ্টা অন্তর আধকাপ করে গরম গরম পান করালে খিচুনি সারে।
মুলার ক্ষার: মুলার গুণাবলী আলোচনা প্রসঙ্গে মুলার ক্ষারের কথাটা এসেছে। মুলার ক্ষার খুব উপকারী। খাওয়া-দাওয়ার পর সামান্য পরিমাণে মুলার ক্ষার খেলে হজম শক্তি বেড়ে যায়। মুলার রসের চেয়ে মুলার ক্ষার বেশি উপকার দেয়। মুলার ক্ষার কবিরাজি দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। খাঁটি জিনিসটা পেতে হলে একটু কষ্ট করে বাড়িতেও তৈরি করে নেওয়া যায়—এখানে সেই পদ্ধতি বলা হলো।[২]
মুলার ক্ষার তৈরি করার পদ্ধতি:
১. প্রথমে মুলা টুকরা টুকরা করে কেটে বা মুলার পাতা ভাল করে রোদে শুকিয়ে নিন। ২. শুকিয়ে গেলে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে নিন। ৩. এই ছাই বেশ খানিকটা পরিষ্কার জলে চারদিন ভিজিয়ে রাখুন একদম নাড়াচাড়া করবেন না। ৪. এবারে সাবধানে ওপরের পরিষ্কার জলটুকু ঢেলে নিন। ৫. সব হলে মাটির হাঁড়িতে তা না হলে অ্যালুমিনিয়াম বা স্টেনলেসস্টিলের পাত্রে জ্বাল দিয়ে জলটা শুকিয়ে ফেলুন। শুকিয়ে ফেলবার পর যা অবশিষ্ট থাকবে সেইটেই হলো মুলোর ক্ষার বা লবণ। ঠাণ্ডা হলে পরিষ্কার শিশিতে ভরে রাখবেন। প্রায় ২৫০ গ্রাম মুলার ছাই থেকে প্রায় ১০০ গ্রাম মুলার ক্ষার পাওয়া যাবে এবং এক কেজি মুলার পাতার ছাই থেকে প্রায় ২০০ গ্রাম মুলার ক্ষার বা লবণ পাওয়া যাবে।
রাসায়নিক গঠন:
(a) Carbohydrates, Protein. (b) Glucoside, enzyme and methyl mercaptan. (c) Ascorbic acid, Vitamin-A, Thiamine, Riboflavin, Nicotinic acid, Vitamin-C.
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ১১৬-১১৮।
২. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা ৯০-৯৫।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Le grand Cricri
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।