লজ্জাবতী গাছের ভেষজ উপকারিতা

লজ্জাবতী গুল্ম হলেও লতাটি মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে বেড়ে ওঠে,এ লতার গায়ে অসম্ভব বাঁকা বাঁকা কাঁটা থাকে সেটা আবার নীচের দিকে হয়। সব থেকে মজার ব্যাপার হলো এই লতাগাছ যেখানে থাকে, সাপ সেখানে প্রবেশ করে না; তবে এটা দেখা যায়। উত্তরবঙ্গ ও আসামে এই লজ্জাবতী লতার প্রাচুর্য আছে। পাতার বোঁটা এক থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা, পাতাগুলি ঠিক বিপরীতভাবে সন্নিবেশিত, পাতা স্পর্শ করলেই বিপরীত দিকের পাতাটি নেমে এসে জুড়ে যায়, মনে হয় যেন করজোড় করেছে, তাই এর নাম করপত্রাঞ্জলি। পুষ্পদন্ড ২ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা, ফুল তুলোর ন্যায় নরম ও ফিকে লালবর্ণ, পাতার গোড়া থেকে পুষ্পদন্ড বের হয়। বারমাসই ফুল ও ফল হয় তবে সাধারণত জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ফুল ও ফল বেশি হয়। প্রত্যেক শুঁটিতে ৩ থেকে ৪টি বীজ থাকে, ফলে ধূসরবর্ণ ছোট ছোট কাঁটা থাকে। এটির বৈজ্ঞানিক নাম Mimosa pudica Linn. পরিবার Fabaceae. হিন্দিভাষী অঞ্চলে একে বলে লাজবন্তী, লাজলু; উড়িষ্যার অঞ্চল বিশেষে বলে লাজকুলিলতা। ঔষধ হিসাবে ব্যবহার হয় মূল ও সমগ্র লতাপাতা।

ব্যবহার

১. হাত পায়ের জ্বালা: অনেক সময় তার সঙ্গে জ্বরও থাকে, এটা সাধারণত বর্ষা ও শরৎকালে পিত্তবিকারে দেখা দেয়। এক্ষেত্রে লাভজাবতীয় সমগ্নাংশ গাছ, মূল, পাতাসহ ১০ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে এই ক্বাথটা খেলে ঋতুগত পিত্তবিকারে ও সে সংক্রান্ত উপসর্গের উপশম হবে।

২. অর্শ রোগ: অর্শের বলিতে জ্বালা বেশি, মরিচ না খেয়েও যেন সেই রকম জ্বালাবোধ হয়, তার সঙ্গে রক্তস্রাবও প্রচুর হতে থাকে। এক্ষেত্রে গাছ ও মূল ১০ গ্রাম আন্দাজ ১ কাপ ও ৩ কাপ জল একসঙ্গে মিশিয়ে একত্রে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে নিয়ে এটা প্রতিদিন সকালে ও বিকালে দুইবার খেতে হবে; এক্ষেত্রে দুধ ছাগলের দুধ হলে ভালো হয় ; এর দ্বারা ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে।

৩. রক্তপিত্ত: গলাটায় মনে হয় কাঁটা ফুটেছে, এর সঙ্গে একটু কাসি আসে আর রক্ত পড়ে অথচ বুকে ও পিঠে যে ব্যথা আছে তা নেই, এমন কি অর্শ নেই, দাস্ত হওয়ার পর জ্বালা যন্ত্রণাও হয় না অথচ টাটকা রক্ত পড়ে; এক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে মাত্রা মতো ক্বাথ তৈরী করে ঐ ক্বাথাটা সকাল বিকাল দুইবারে খেলে রক্ত পড়া বন্ধ হবে।

আরো পড়ুন:  বীজতাড়ক লতা দক্ষিন এশিয়ার ভেষজ প্রজাতি

৪. যোনির ক্ষত: এটার প্রাথমিক স্তর মাঝে মাঝে অথবা প্রায় রোজই অল্প অল্প স্রাব চলতে থাকে, একটা আঁশটে গন্ধ, কখনও বা একটু লালচে স্রাব; এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক সাবধান করে থাকেন এটার পরিণামে ক্যানসার হয়ে যেতে পারে; এই রকম ক্ষেত্রে দুধে পানি দিয়ে সিদ্ধ করা লজ্জাবতীর ক্বাথ খেলে ওটা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। এই সঙ্গে আর একটা জেনে রাখা ভালো; এই গাছের ক্বাথ দিয়ে উত্তরবস্তি দিলে অর্থাৎ ডুস দিয়ে ধোয়ালে ওটা আরও শীঘ্র সেরে যাবে।

৫. নাড়ী সরে আসা: বহু সন্তানের জননী অথবা প্রসবের সময় ধাত্রীর অসাবধানতায় নাড়ী সারে এসেছে, উচু হয়ে বসতে গেলে অস্বস্তি বোধ, এক্ষেত্রে গাছে মূল ১০ গ্রাম আন্দাজ গাছ ও পাতা নিয়ে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে প্রতিদিন খেলে, আর ঐভাবে ক্বাথ তৈরি করে উত্তরবস্তি বা ডুস দিতে হবে; এর দ্বারা নাড়ী আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে।

৬. আধাঁর যোনি ক্ষত: এই বিচিত্র রোগটি কৃষ্ণপক্ষে বেড়ে যায় আর শুক্রপক্ষে শুক্রতে থাকে; এই ক্ষতটি হয় সাধারণত হাঁটুর নিচে আর না হয় কুঁচকির দুইধারে। এক্ষেত্রে গাছ ও পাতা মূল বাদ দিয়ে ১০ গ্রাম শুধু জল দিয়ে ক্বাথ করে খেতে হয় এবং ঐ ক্বাথ দিয়ে মুছতে হয়, এর দ্বারা ঐ অসুবিধাটা চলে যায়।

৭. আমাশয়: অনেকদিনকার পুরনো, বেগ হলে আর দাঁড়ানো যায় না, গিয়ে প্রথমেই যা হলো তারপর আর হতে চায় না; আবার অনেকের আছে শক্ত মলের গায়ে সাদা সাদা জড়ানো আম। তাঁরা লজ্জাবতীর ডাঁটা পাতা মিলিয়ে ১০ গ্রাম সিদ্ধ করে ছেঁকে সেই ক্বাথটা খেয়ে ভালো হবে, আর যাঁদের আমযুক্ত গাঁজলা দাস্ত হয়, তাঁরা শুধু পাতা ৫ থেকে ৬ গ্রাম সিদ্ধ করে ছেঁকে ঐ জলটা খাবেন ।

৮. দমকা ভেদ: ২ থেকে ৩ দিন পেট স্তব্ধ হয়ে থাকে যাকে আমরা চলতি কথায় বলি পেট থুম মেরে আছে, হঠাৎ একদিন দমকা ভেদ হয়, একে বলা যেতে পারে। অগ্নিমান্দ্যজনিত অজীর্ণ; এক্ষেত্রে লজ্জাবতীর শিকড়ের ছাল ২ থেকে ৩ গ্রাম, এর সঙ্গে শুধু পাতা ৪ গ্রাম একসঙ্গে সিদ্ধ করে ছেঁকে জলটা খেতে হবে।

আরো পড়ুন:  পান পাতার নানাবিধ ভেষজ গুনাগুণ, উপকারিতা ও ব্যবহার

৯. মলের কঠিন্যে: মল গুঠেলে হয়ে যায়, দমদম বুলেটের মতো কয়েকটা বেরিয়ে গেল, আবার আর কিছুই নাই; এক্ষেত্রে মূল ৭ থেকে ৮ গ্রাম আন্দাজ থেঁতো করে সিদ্ধ করতে হবে এবং ছেঁকে ঐ জলটা খেতে হবে। জলের মাত্রা পূর্বে কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে।

১০. বিসর্পে: ক্ষত কিছুতেই সারছে না, বরং বেড়ে যাচ্ছে, লোকের সন্দেহ হয়তো বা ক্যানসার; এই রকম ক্ষেত্রে ৪ থেকে ৫ গ্রাম পাতা মিহি করে বেটে এক পোয়া আন্দাজ দুধে মিশিয়ে ওটা ছেঁকে নিয়ে খেতে হয়, ১৪ দিন এইভাবে খেতে হবে; এটাতে খুব দূষিত ক্ষতও ভালো হয়, তবে এই সময় লবণ বর্জন করে, দুধ ভাত খেয়ে থাকতে হয় এবং জল দিয়ে পাতা বেটে ঘায়ে লাগাতে হয়।

১১. দাঁতের মাড়ির ক্ষত: ১০ থেকে ১২ গ্রাম আন্দাজ লজ্জাবতী গাছের পাতা সিদ্ধ করে, ছেঁকে ঐ ক্বাথ কবল ধারণ করতে হবে অর্থাৎ মুখে ১০ থেকে ১৫ মিনিট রেখে ফেলে দিতে হয়, এর দ্বারা ঐ মাড়ির ক্ষত সেরে যাবে।

১২. বগলের দূর্গন্ধে: কারও কারও জামায় বা গেঞ্জিতে হলুদ দাগ লাগে, এক্ষেত্রে লজ্জাবতী গাছের ক্বাথ করে বগল ও শরীরটা মুছে ফেলতে হবে; এর দ্বারা ঐ দোষ ও দূর্গন্ধটা চলে যাবে।

১৩. দুষ্ট ক্ষত: মাংস পচে খসে যাচ্ছে, এক্ষেত্রে লজ্জাবতীর ক্বাথকে একটু ঘন করে দিনে অন্তত ৩ থেকে ৪ বার দিতে হবে, এই রকম কয়েকদিন ব্যবহারে ঘায়ের পচানিটা উঠে যাবে এবং পুজও জমতে দেবে না।

১৪. পোড়া নারেঙ্গায়: প্রথমে গায়ে ফোস্কার মতো হয়, অত্যন্ত জ্বালা থাকে, এর সঙ্গে জ্বরও হয়। এক্ষেত্রে ঐ লজ্জাবতীর ক্বাথ দিয়ে ঘি পাক করে সেই ঘি লাগালে ওটা সেরে যায়।

১৫. হারিশো: মলত্যাগের সময় যাদের সরলান্ত্র (Large intestine) বেরিয়ে আসে, এই লজ্জাবতী গাছ সিদ্ধ ক্বাথের সাথে তেল দিয়ে পাক করে সেই তেল ঐ সরল্যান্ত্রে লাগিয়ে দিতে হয়, কয়েকদিন লাগালে ওটা আর বেরিয়ে আসবে না। এই রোগটা সাধারণত শিশু বা বালকদের বেশি হতে দেখা যায়।

আরো পড়ুন:  বড় বেত দক্ষিণ এশিয়ায় জন্মানো উপকারী লতা

১৬. কানের পুঁজে: এই তেল কানে এক ফোঁটা দিলে কানের পুঁজ পড়া বন্ধ হবে এবং ক্ষত সেরে যাবে।

১৭. রমণে অতৃপ্তি: কয়েকটি সন্তান হওয়ার পর প্রসবদ্বারের শৈথিল্য হয়েছে, সেটার অনেকটা মেরামত করে দিয়ে থাকে। এই লজ্জাবতীর ক্বাথের ডুস নেওয়ায় আর ওর গাছ পাতা সিদ্ধ ক্বাথ দিয়ে তৈরী তেলে ন্যাকড়া ভিজিয়ে পিচুধারণ করানো (Vaginal plugging).

১৮. মিথুন দণ্ডের শৈথিল্যে: লজ্জাবতীর বীজ দিয়ে তৈরি তেল লাগিয়ে আস্তে আস্তে মালিশ করলে ওটা দঢ় হয়।

১৯. গ্রন্থিবাত ও কুজ্জতায়: এই লজ্জাবতীর ক্বাথ ও দুধ দিয়ে ঘি পাক করে সেই ঘি খেলে ও মালিশ করলে এটি সেরে যাবে।

২০. সংগ্রহ গ্রহণী রোগে: দিনেই বার বার দাস্ত হতে থাকে, রাত্রে প্রায় যেতেই হয় না; একেহ বলা হয় সংগ্রহ গ্রহণী; এক্ষেত্রে লজাবতীর ক্বাথ খাওয়ালে ঐ দোষটা চলে যাবে।

রাসায়নিক গঠন:

(a) Alkaloids viz., mimosine, other bases. (b) Steroidal components. (c) Waxy material. (d) Crocetin dimethyl ether tannin, mucilage, fatty acids.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ  

১ আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি‘ খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ২২৮-২৩১।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: RaffiKojian

Leave a Comment

error: Content is protected !!