পরিচয়: কেলি কদম রুবিয়েসি পরিবারের মিত্রজিনা গণের একটি উদ্ভিদ। এটি বহুশাখা বিশিষ্ট পত্রমোচী গাছ। এ গাছের প্রচলিত আরও কয়েকটি নাম ‘গিরিকদম্ব’, ‘হরিদ্রু’, ‘গৌরকদম্ব’, ‘ছোট হলদু’ প্রভৃতি।
বর্ণনা: কেলিকদম গাছ সাধারণ কদম গাছের চেয়ে আকারে ছোট। একটি কেলিকদম গাছ ৩০ মিটার বা তার বেশিও দীর্ঘ হতে পারে। আসলে কেলি কদমের সবকিছুই সাধারণ কদমের চেয়ে ছোট। গাছ, পাতা, ফুল বা ফল সবই ছোট। কেলিকদম গাছের কাঠ শক্ত, রং হলুদ। গাছের ছাল সাদা বা হালকা বাদামী রঙের এবং পুরু। কদম গাছের পাতা বড় এবং লম্বা। কিন্তু কেলিকদমের পাতা খাটো এবং ছোট ও শক্ত। পাতার মাঝখানটা চওড়া, অনেকটা হৃদয় (heart) আকৃতির মত। পত্রের বোটা ১০ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে থাকে। শরৎকালে গাছের পাতা থাকে না। শীতের সময় পাতা গজায়। পাতা গজানোর সময় অঙ্কুরোদ্গম হয়। বসন্ত কালে ফুল ফোটা শুরু হয়। সাধারণ কদম ফুল বর্ষাকালে ফুটে। কিন্তু কেলিকদম ফুল বসন্ত ও গ্রীষ্মে ফোটে। বসন্তকালে ফুল ফোটা শুরু হয় বলে কেলিকদমের আর এক নাম বসন্তপুষ্প। ফুল ছোট, বৃত্তাকার। ফুলের মৌসুমে গাছের ডালে প্রচুর পরিমাণে কলি আসে। কলির রং সবুজ। ফুলের রং হলুদ। ফুল সুর্গন্ধ বিশিষ্ট। বর্ষাকালে ফল হয়। ফল পীত বর্ণের। একটি ফলে অনেক বীজ থাকে। বীজ এবং কলমের মাধ্যমে নতুন গাছ উৎপাদন করা যায়।
বিস্তৃতি: কেলি কদম এশিয়া এবং আফ্রিকার ক্রান্তীয় ও উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। এশিয়ার প্রজাতিটি রেইনফরেস্ট (rainforest) এলাকার এবং আফ্রিকার প্রজাতিটি জলাভূমি (swamp forest) এলাকার। এশিয়ার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়াতে কেলিকদম গাছ আছে। আমাদের দেশে এই গাছ প্রায় নাই বললেই হয়। বলধা গার্ডেনের সিবিলী অংশের পুকুরের পূর্ব-দক্ষিণ কোনায় একটি গাছ আছে। যশোরের মনিরামপুরের একটি দিঘিতে চারটি গাছ আছে। এছাড়াও বাংলাদেশের আরও কয়েকটি অঞ্চলে এই গাছ আছে বলে শুনেছি। গাছ স্বল্পতার কারণে সাধারণ কদমের মত কেলিকদম গাছ সকলের কাছে পরিচিত নয়। আমাদের দেশে কেলিকদম গাছ কম থাকলেও ভারতে এই গাছ পাওয়া যায়। ভারতের অধিকাংশ স্থানে এটি জন্মে। হিমালয় সংলগ্ন নিম্নভূমি, দক্ষিণ ভারতের জঙ্গল সহ ভারতের অন্যান্য অংশেও এই গাছ আছে। সেখানে অযত্ন অবহেলায়ই এই গাছ বেঁচে থাকছে। তবে ছায়াদানকারি বৃক্ষ হিসেবে এটি ভারতের অনেকস্থানে লাগানো হয়। সাধারণ কদমের মত কেলিকদমের ফুলের সৌন্দর্যও কম নয়।
ব্যবহার: কদমের মত কেলিকদমও ঔষধি গুণসম্পন্ন গাছ। বহু আগে থেকেই কেলিকদম গাছের পাতা, কুঁড়ি, ছাল বা বাঁকল, শিকড় ইত্যাদি ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমাদের দেশে এই গাছ না থাকার এর ব্যবহার কম। ভারত বা শ্রীলংকায় কবিরাজী বা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় কেলিকদম গাছ ব্যবহার করা হয়। গাছের ছাল রক্ত সংক্রান্ত রোগের জন্য ব্যবহার করা হয়। জ্বর সারানো জন্যও গাছের ছাল ব্যবহার করা হয়। ছালের রস ক্ষতস্থানে লাগালে ক্ষতের জীবানু নষ্ট হয়ে যায়। পেটের ব্যথা এবং সর্দি সারাতেও গাছের ছাল ব্যবহৃত হয়। কামোদ্দীপক হিসেবেও গাছের ছাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কেলিকদম গাছের পাতা ব্যথা উপশম করে থাকে। কৃমির চিকিৎসাতেও এই গাছ ব্যবহৃত হয়। ব্রণ জনিত চিকিৎসায় কেলিকদমের পাতা ব্যবহার করা হয়।
এর তাজা পাতাগুলোতে আদিবাসী অন্ধ্র প্রদেশের গন্ডুর জেলার চেনচাস, যেরুকালাস, ইয়ানাদিস এবং সগলিয়াস আদিবাসী জনগণ জন্ডিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করেন। এছাড়া আরও অনেক রোগের ক্ষেত্রে কেলিকদম গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কেলিকদম নিয়ে প্রাচীন কবিরা বহু কাব্য রচনা করেছেন। বিশেষত কৃষ্ণভক্তদের কাছে কেলিকদম নামটি খুবই আকর্ষণীয়। প্রাচীন রস-সাহিত্যিক বা অলঙ্কারিকগণ কেলি শব্দটিকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। কেলিকদম সম্পর্কে আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য মহাশয় বলেছেন ‘কদম্ব নামটাই যেন আমাদের মনে একটা সুখ-দুঃখের আবহাওয়া সৃষ্টি করে-এটা মানব মনের একটা বিশেষ অবস্থা; কিন্তু কদম্বের পূর্বে কেলি এসে যখন বসলো, তখন কিন্তু শব্দটি রসবাচকের পর্যায়ে গিয়ে পড়লো।’ বাংলা সাহিত্যে কেলিকদমের ব্যবহার খুবই কম। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় কেলিকদম সম্পর্কে জানা যায়। বিভূতিভূষণ আরণ্যক গ্রন্থে বেশ কয়েকবার এ গাছের প্রসঙ্গ এনেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘কেলিকদম্ব গাছের সেগুন পাতার মতো বড় বড় পাতায় বাতাস বাঁধিয়া শন শন শব্দ হইতেছে (পৃ. ১২৫)।’ ‘পাহাড়ের জঙ্গলে কেলিকদম্ব গাছের বড় বড় পাতার আড়ালে শুক্র ও বৃহস্পতি জ্বল জ্বল করিতেছে (পৃ. ১২৬)।’ ‘কেলিকদম্ব কদম্বফুলের গাছ নয়, কেলিকদম্ব ভিন্নজাতীয় বৃক্ষ, সেগুনপাতার মতো বড় বড় পাতা, চমৎকার আঁকাবাঁকা ডালপালাওয়ালা বনস্পতিশ্রেণীর বৃক্ষ (পৃ. ১৩৯)।’
তথ্যসূত্র: আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি, এবং আরণ্যক।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।