কার্ল মার্কস-এর সাথে দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন। একেবারে প্রথম থেকে তিনি কি বলতে চাচ্ছেন, কেমন করে আর কেন বলতে চাচ্ছেন তার হদিস শুদ্ধু। বদলানোর তাগিদ আমাদের তাড়াহুড়োতে ফেলে দিয়েছে। তার সাথে জুড়েছে আলসেমি। ফলে মার্কসের জ্ঞান রাজ্যে না ঢুকে আমরা তার কড়ি-বরগা গুণে সময় কাটিয়েছি বেশি। তিনি দিতে চেয়েছিলেন বিশ্লেষণের পদ্ধতি, আর আমরা তার বিশ্লেষণটাই নিয়ে বসে আছি। জুতোর মাপে পা বানাতে গিয়ে পা টাই জখম হবার জোগার।
কার্ল মার্কস আমাদের মাটিতে জন্মান নি। কিন্তু তার জন্মটা হয়েছিল আঞ্চলিক ইতিহাস বিশ্ব ইতিহাসে রূপান্তরিত হবার কলে। ম্যানচেষ্টারের কাপড়ের সাথে তিনি আমদানি হন নি; ফলে সাহেবী কাপড় পরার যে অভ্যেস আমরা চিন্তার সাথে জুড়ে নিয়েছি, ঐ প্রক্রিয়ার সাথে মার্কস অধ্যয়ন ও প্রয়োগের একটা প্রভেদ থাকার কথা। তা বুঝে নিলে পাল্টানোর কাজটা ঠিকঠাক মতো এগোবে। নইলে- থোড়বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। মোদ্দা কথা, কার্ল মার্কস যেহেতু কোনো প্রেরিত পুরুষ হয়ে নাজেল হননি সেহেতু তার প্রেক্ষাপট তার মত হবার কারণ ছিল। তার অবধান না রেখে আমরা যদি খামচে খামচে তাকে অধ্যয়ন করি, তাতে আখেরে কোনো ফায়দা হবে না, হয়ও নি। তার জন্য মার্কসের তরুণ বয়সের লেখা অধ্যয়নের একটা প্রস্তাবনা এখানে রাখা হচ্ছে।
কেন? কারণ মার্কস কেমন করে একটা কালপর্বের অনেকগুলো মত, পদ্ধতি বা প্রক্রিয়ার মাঝে শোষণকে নাকচ করার স্বপ্নের প্রতীক হয়ে উঠেছিল, তা বুঝতে হলে খোদ তার বেড়ে ওঠার স্তরগুলোই বুঝে নেয়া জরুরী। তাহলে একটা সম্পূর্ণ মার্কসকে পাওয়া যাবে। যে পাঠ্যক্রম মেনে এতদিন বিপ্লবী রাজনীতি হয়ে এসেছে, তা যে আর আগের আকারে রাখলে চলছে না- তা তো প্রমাণিত হয়ে গেছে। দুধ দিয়ে ঘোল না সন্দেশ বানাবো তা সিদ্ধান্ত নিতে হলে তো আগে দুধটাকেই চিনে নিতে হয়। নইলে জ্ঞপিটুলি গোলা জল খাইয়াও দুধ খেয়েছি- দুধ খেয়েছি বলে অশ্বত্থাম্মার মত বেকুব হতে হবে। আমরা বুঝবো না যে, মার্কস-এঙ্গেলস, লেনিন যখন শ্রেণির একনায়কতন্ত্রের কথা বলেন, তা কোনো পার্টি বা গোষ্ঠীর একনায়কতন্ত্রের কথা নয়। তা হল শ্রেণির একনায়কতন্ত্র। আর মার্কস তার তরুণ বয়সেই পষ্ট করে বলেছেন যে, প্রতিটা সমাজেই শাসক শ্রেণির চিন্তাই হলো ঐ সমাজের শাসক চিন্তা। তারা সমাজে বস্তুগত সম্পত্তির মালিকানার খাতিরেই জ্ঞানের একটা কাঠামো তৈরি করে, যার অধীনে ঐ সমাজে মোটা স্রোতের জ্ঞান চর্চাটা হয়। জ্ঞানকাঠামোর বা চিন্তা কাঠামোর ওই একনায়কতন্ত্রে মার্কস অনুসারীরা মোটেই পাত্তা দেয় নি। ফলে আজকে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো’র ভাবগম্ভীর জ্ঞান-জাগতিক জোয়ালের কথা শুনে আমাদের আহ্লাদিত হতে হয়। ফলে মিশেল ফুকো’র সমর্থকরা আদৌ মার্কসকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবার যোগ্যতা রাখেন কিনা- তা আর বোঝা যায় না। এও খামচে ধরে মার্কস পাঠের ফল।
জার্মান ভাবাদর্শ লেখবার বারো বছর পর মার্কস জানান, আমি এই সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হয়েছিলাম যে, বৈধ সম্পর্ক, তার সাথে রাষ্ট্রের আঙ্গিক খোদ ঐ আঙ্গিক বা সম্পর্ক দিয়ে বোঝা যাবে না, তথাকথিত মানব মনের সাধারণ অগ্রগতি দিয়েও তা ব্যাখ্যা করা যাবেনা। বরং তাদের শেকড় গাড়া আছে জীবনের বস্তুগত অবস্থায়, যাকে হেগেল বলেন…..সিভিল সমাজ। সিভিল সমাজের ব্যবচ্ছেদ খুঁজতে হবে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রে (রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের সমালোচনায় সংযোজন-এ উদ্ধৃত)। এই সিভিল সমাজ আজকে যে কি কিম্ভূত রূপ নিয়েছে তা আর বলে দিতে হয় না। যারা ধারণাটির স্বার্থপ্রণোদিত অপপ্রয়োগ করেন, তাদের সামনে মার্কস অনুসারীরা তাত্ত্বিক বা প্রায়োগিক কোনো বাহাস ছুঁড়ে দিতে পারেননি। যদিও মার্কস-এঙ্গেলসের জার্মান ভাবাদর্শের প্রথম অংশে তার ঝকঝকে ব্যাখ্যা আছে। ফলে আলসেমির কারণে মার্কসের তত্ত্ব মার্কস অনুসারীদের পিঠে ছোরা হয়ে বসলো।
যা হোক, মার্কসের ওপরের বয়ানে এটাতো স্পষ্ট যে, মার্কসের রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র আসলে সমাজের, রাষ্ট্রের ভেতরকার প্রতিটা সম্পর্ক ব্যাখ্যার ডিকশনারী; অনেকে যাকে ডিসকোর্স নামে ডাকলে খুশি হবেন। ভিন্ন সব জ্ঞান কাঠামো বা অভিজ্ঞতাকে নির্বিচারে প্রয়োগ করার যে প্রবণতা, তা আমাদের মাঝে বয়ে যাওয়া ঔপনিবেশিক জ্ঞান কাঠামোর দাপটেরই ফল। এদের সবাইকে আমাদের মানব জমিনের আশা আকাঙ্খার সাথে মিলমিশ খাবার পরীক্ষায় উতরে আসতে হবে, যে কথা মার্কসের ব্যাপারেও প্রযোজ্য। তাদের পোস্ট-মডার্নিজম বা পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম- যে নামই দেই না কেন। কারুর উপরই নির্বিচার আস্থা বা অনাস্থা আনা যাবে না, খোদ মার্কসের উপরও নয়। বরং আমরা যদি মনে রাখি যে, মার্কসের লড়াইটাই ছিলো ন্যায়-অন্যায় নির্বিচারে শোষক শ্রেণির লাভটাকে র্যাশনালাইজ করার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আজকের ইতিহাসে সব চাইতে বড় বিপ্লবী প্রস্তাবনা; তাহলে, তিনি আর আমাদের কাছে বুদ্ধিবাদী থাকবেন না। শোষণ আর শোষকের বিরুদ্ধে লড়তে হলে আগেই তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠা জরুরী- এও শোষকদের বুদ্ধিবাদী ছেঁদো কথা। বিপ্লবের ডাক শোষণের বিরুদ্ধে নৈতিক ডাক; সেই ডাককে তত্ত্ব দেয় ন্যায্যতা, কৌশল। নতুন জ্ঞানকাণ্ডগুলোর কিছু অংশ সে দিকে আমাদের সহায়ক হতে পারে বেশ ভালোভাবেই; তবে একথা মনে রেখে যে, ওই উপাংশগুলোর যে দাবি করে তার অনুযায়ী তারা বিশ্ব ব্যবস্থার সম্পর্ক শাস্ত্র দাখিল করতে পারছে কিনা!
আমাদেরকে ফিরে আসতে হবে মানুষের কাছে। যাদের শুধু একক বা শুধু সমগ্র আবার শুধু বাহ্যিক বা শুধুই অন্তর্গত দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। শ্রী চৈতন্য যেমন শুষ্ক তর্ক বাদ দিয়ে প্রেমে নেমেছিলেন, তেমনি মার্কসও সব দার্শনিক কচকচি ছেড়ে বাস্তব, জীবন্ত মানুষ থেকেই তার দর্শনের যাত্রা শুরু করেন। সেই গুরুত্বের কথা জানাতেই এই ভাষান্তরখানির প্রস্তাবনা। তবে শুধু বইয়ে তো কিছু হয় না — মানুষের আর্তনাদের শব্দ শুনতে জানতে হয়, ভালোবাসতে হলে ঘৃণাও করতে হয়। ফকির লালন শাহ্ তো সোজা করে বলেই রেখেছেন— ‘যার শরীরে মোহর মারা সে বুঝবে কিসে’!
ঋত্বিক ঘটক (জন্ম : ৪ নভেম্বর, ১৯২৫ – মৃত্যু : ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬) একজন বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম বহুবার বহুভাবে উচ্চারিত। তিনি পরিচালনা করেছেন নাগরিক (১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০) কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭) প্রভৃতি চলচ্চিত্র।