উপনিবেশবাদের ফলাফল হচ্ছে বিশ্ব সমাজের পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী রূপ

উপনিবেশবাদের ফলাফল থেকে বের হয়ে আসে বিশ্ব সমাজের পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী রূপ। আজকের দিনে বসে দুনিয়াকে বুঝতে হলে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসকে ভালো করে বোঝা দরকার। পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত ছিল উপনিবেশবাদের স্বর্ণযুগ। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এসে অধিকাংশ উপনিবেশগুলোতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয় এবং শোষণ ও লুটপাটকারী দেশগুলো সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধে ইউরোপের ঔপনিবেশিক দেশগুলোরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোকে মোকাবেলা করতে গিয়ে দেশে দেশে সাম্যবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে।

এই সব বিভিন্ন কারণে ১৯৬০-এর দশকে পৌঁছে আমরা দেখি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো হার মানছে। পৃথিবীর অধিকাংশ উপনিবেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে এবং পূর্ণ মর্যাদায় জগতসভায় আসন নিতে সচেষ্ট হচ্ছে। কিন্তু অনেক সমাজতত্ত্ববিদেরাই মনে করেন যে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়ে যাওয়া মানেই এই ঔপনিবেশিক ইতিহাস শেষ হয়ে যাওয়া নয়। বরং ঠিক উল্টোটাই। উপনিবেশবাদ পৃথিবীর ওপর গভীর ছাপ ফেলেছে। বিভিন্ন অর্থে, নানা অপরিবর্তিত বা পরিবর্তিত রূপে সে ইতিহাস এখনও এক চলমান শক্তি হিসেবে বর্তমানের গতি প্রকৃতিকে নির্ধারণ করে চলেছে। তাই তাকে আমাদের বোঝা এবং চেনা দরকার। উপনিবেশবাদ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও বহু বিতর্ক রয়েছে। আমাদের ইতিহাসে উপনিবেশবাদকে আমরা কতদূর নির্ধারক হিসেবে দেখব তাই নিয়ে তর্ক রয়েছে। স্বল্প পরিসরে হলেও আমরা সেই বিষয় ও বিতর্কগুলোকে ছুঁয়ে যাব।[১]

আজকে আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি সেটা বিশ্ব স্তরে ক্ষমতার সম্পর্কে সংগঠিত। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যা এই ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে জড়িয়ে নেই। এই যে গোটা পৃথিবীকে একটা ক্ষমতার সম্পর্কে নিয়ে আসা এটা কিন্তু অনেক দূর পর্যন্ত উপনিবেশবাদের জন্যই ঘটেছে। উপনিবেশবাদের সময়ই পৃথিবীর অধিকাংশ ভূখণ্ড ইউরোপের কোনো না কোনো দেশের অধীন হয়ে পড়ার ফলে একটা আন্তর্জাতিক ক্ষমতার কাঠামোর অংশ হয়ে ওঠে, আজকের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কাঠামো তারই কিছুটা পরিবর্তিত উত্তরসূরী। অনেকের মতে এই বর্তমান কাঠামোতেও প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর প্রাধান্য খুব ক্ষুন্ন হয় নি। আজ আমরা যে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা এবং নির্বাচনভিত্তিক সংসদীয় শাসনব্যবস্থা দেখি তাও প্রথম দেখা দিয়েছিল ইউরোপেই। সেখান থেকেই উপনিবেশবাদের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা উপনিবেশগুলোতে ছড়ায়। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে এই ধারণাগুলোর পেছনে কাজ করেছিলো এক ধরনের মানবতাবাদ, যে মত শাসকদের দৈব ক্ষমতার ওপর মানুষের বোধকে, অধিকারকে স্থান দেওয়ার কথা ভেবেছিলো। এই বোধ থেকেই সমস্ত মানুষের জন্য সমান ন্যায়, নাগরিকত্ব ইত্যাদি বোধের জন্ম হয়। ইতিহাসের পরিহাস এটাই যে এই মানবতা আর সাম্য কিন্তু উপনিবেশের মানুষদের তার হিসেবের মধ্যে ধরে নি, তারা মনুষ্যেতর হিসেবেই গণ্য হয়েছে।[২]

আরো পড়ুন:  অক্ষশক্তি একটি সামরিক জোট যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল

অর্থনৈতিক দিক থেকেও উপনিবেশবাদ আমাদের ইতিহাসকে নতুন ভাবে সংগঠিত করেছে। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য চলে এসেছে, কিন্তু উপনিবেশবাদ বিশ্ব-বাণিজ্যকে ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রাধান্যের স্বার্থে নতুন করে সংগঠিত করে। উপনিবেশগুলোর কাঁচামাল ইউরোপের দেশগুলোতে গিয়ে সেখানকার কল কারখানায় বিভিন্ন পণ্যে পরিণত হয় এবং তারপর বিশ্ববাজারে বিক্রি হতে আসে। এই বন্দোবস্ত ছিল অসম। উপনিবেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নিয়ে, সেখানকার শিল্পগুলোকে ধ্বংস করে, কোটিরও বেশি দাস শ্রমিককে নিয়ে এসে ইউরোপ ও আমেরিকা ফুলে ফেঁপে ওঠে। ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লব সফল হয় এই মুনাফায়। বলা বাহুল্য এই ঋণ শোধ করার কোনো প্রয়োজন ইউরোপ বা আমেরিকা কখনোই বোধ করে নি অথচ আজ আবার এই বিশ্বায়নের বাজারে এই ধনী দেশগুলোই ইচ্ছেমত শর্ত অনুযায়ী এই প্রাক্তন উপনিবেশ দেশগুলোকে চড়া সুদে ঋণ দিয়ে নতুন করে টাকা লুটছে।[৩]

মার্কসবাদ আমাদের শিখিয়েছে আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসকে পুঁজিবাদের উত্থানের ইতিহাস হিসেবে দেখতে। পুঁজিবাদের উত্থানের ফলে ইউরোপীয় দেশসমূহ দেশে দেশে বিস্তারবাদের সাহায্যে গোটা দুনিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন শুরু করে। ১৮৫০-এর দশকে ইউরোপের নেতৃস্থানীয় বুর্জোয়া রাজনীতিবিদেরা ছিলো উপনিবেশ নীতির বিরোধী। কিন্তু ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানির বেলায় উপনিবেশ দখলের বিপুল প্রসারের যুগ হচ্ছে উনিশ শতকের শেষ চার দশক। লেনিন এবং হেনরি সি. মরিস দেখিয়েছেন যে পুঁজিবাদের অবাধ প্রতিযোগিতার যুগ শেষ হলেই কেবল উপনিবেশ দখলের তোড়জোড় বেড়েছে। ‘একচেটিয়া পুঁজিবাদে, ফিনান্স পুঁজিতে পুঁজিবাদের উৎক্রমণের সংগে’ বিশ্বের আঞ্চলিক ভাগ-বাটোয়ারার জন্যে সংগ্রাম হয়ে উঠেছে অসাধারণ তীক্ষ্ণ। উনিশ শতকের শেষে দুই বর্বর ইতর সিসিল রোডস এবং জোসেফ চেম্বারলেন, খোলাখুলিই সাম্রাজ্যবাদের প্রচার করে এবং সাম্রাজ্যবাদী কর্মনীতি চালায় একান্ত নির্লজ্জভাবে।[৪]

উপনিবেশবাদ সাংস্কৃতিক দিক থেকেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আগেই বলেছি যে উপনিবেশগুলোতে অন্য ধরনের সমাজ-সংস্কৃতির মুখোমুখি হয়ে ঔপনিবেশিকরা তাদের অসভ্য, অনাধুনিক বলে চিহ্নিত করল এবং সভ্যতার নামে এই মানুষদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে, দেশ দখল করে, সম্পদ লুটে নিয়ে রাজত্ব করল। কিন্তু ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর সাফল্য এই যে তারা শুধু গায়ের জোরে এই কাজ করে নি। আন্তোনিও গ্রামসি যাকে ‘হেজিমনি’ বলে অভিহিত করেন, সেই সম্মতি নিমার্ণও করতে পেরেছিলো। উপনিবেশেরও বহু মানুষ মনে করেছিল যে এই শাসন তাদের পক্ষে ভালো, ইউরোপীয় পদ্ধতিতে শিল্পায়ন, বাজারের বিকাশই সমৃদ্ধির পথ, আধুনিকতার পথ। আজকে যখন এই শিল্পায়নের বিপদগুলো বুঝতে পারা যাচ্ছে, যখন মুনাফার লোভে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার, কিছু মানুষের স্বার্থে বহু মানুষকে একেবারে নিংড়ে নেওয়ার ফলগুলো টের পাওয়া যাচ্ছে, তখনও কিন্তু এই শিল্পায়ন, পণ্যের ভোগের মধ্যে দিয়ে জীবনের মান উন্নয়নের হাতছানি আধুনিকতার নামে আমাদের আকর্ষণ করে চলেছে। এই আধুনিকতার ধারণা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়াও কিন্তু উপনিবেশবাদেরই কৃতিত্ব।[৫]

আরো পড়ুন:  ভারতে বৃটিশ শাসন

মার্কসবাদী দর্শন এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে পুঁজিবাদের উত্থান দুনিয়াকে বদলে দিয়েছে। এই দর্শনের গুরুত্ব স্বীকার করেও সমালোচকরা আজকে বলছেন যে কেন্দ্র ও উপনিবেশগুলোর বিকাশের মধ্যে যে পার্থক্য তাকে দুনিয়া-জোড়া পুঁজিবাদের সর্বজনীন ইতিহাস হিসেবে বোঝা যায় না। উপনিবেশবাদের ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে বা দেশগুলোর মধ্যেও যে সামাজিক বদলগুলো ঘটেছে, ঘটছে এবং ইতিহাসকে প্রভাবিত করে চলেছে, তার ওপর আরো জোর দিতে হবে, তা না হলে সত্যিকার বোধ তৈরি হবে না।[৬]

এইসব প্রভাবিত ইতিহাসের সব দিক বিশ্লেষণ করে দেখলেই আমরা সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের লড়াইগুলোর ন্যায্যতাকে দেখতে পাব। বুর্জোয়া যুগকে ‘এক মহান সামাজিক বিপ্লব’বা সাম্যবাদী বিপ্লব জয় করবে এবং পুঁজি জনগণের সাধারণ নিয়ন্ত্রণাধীন হবে তখন পুঁজির উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে জড়িত অমানবিক বর্বর বিকটাকৃতি রূপটি লোপ পাবে বলে মার্কস মনে করেন। তিনি বলেন, “… কেবল তখনই মানব-প্রগতিকে সেই বিকটাকৃতি আদিম দেবমূর্তির মতো দেখাবে না যে [দেব] নিহতের মাথার খুলিতে ছাড়া সুধা পান করতে চায় না।”[৭]

তথ্যসূত্র:

১. চক্রবর্তী, রংগন. বুদ্ধিজীবীর নোটবই. চক্রবর্তী সুধীর সম্পাদিত, প্রথম নবযুগ সংস্করণ, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ পৃষ্ঠা ১৫৯-১৬১।

২. চক্রবর্তী, রংগন. পূর্বোক্ত।

৩. চক্রবর্তী, রংগন. পূর্বোক্ত।

৪. লেনিন, ভি আই. সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়, অধ্যায় ৬, “বৃহৎ শক্তিসমূহের মধ্যে বিশ্বের ভাগ বাটোয়ারা”, ১৯১৬, নির্বাচিত রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড (বার খণ্ডে) প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১০৩-১০৪।

৫. চক্রবর্তী, রংগন. পূর্বোক্ত।

৬. চক্রবর্তী, রংগন. পূর্বোক্ত।

৭. কার্ল মার্কস, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল, ২২ জুলাই ১৮৫৩, কার্ল মার্কস ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, বারো খণ্ডে, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৫১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!