সামন্তবাদ বা সামন্তবাদী সমাজ বা সামন্তীয় সমাজ (ইংরেজি: Feudalism) মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশের একটি পর্যায়। মানুষের সামাজিক বিকাশ তার জীবিকার উপায় এবং উৎপাদন সম্পর্কের বিকাশের ভিত্তিতে প্রধানত নির্দিষ্ট হয়। জমির কর্ষণ থেকে জীবন ধারণের প্রধান উপায় শস্য লাভের কৌশল মানুষের আয়ত্তে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন দাস সমাজের ভাঙনের মধ্য দিয়ে নতুন সামন্ত সমাজের উদ্ভব হয়।
সামন্ত সমাজের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি জমি। জমির মালিকানার ভিত্তিতে জমির প্রভু বা সামন্তপ্রভু সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই প্রাচীন দাস সমাজের পরে সামন্ত সমাজের বিকাশ ঘটেছে। মোদ্দাকথা ভূমি মালিকানার মাধ্যমে শােষণ-লুণ্ঠন করাই হচ্ছে সামন্তবাদী সমাজ। ভূ-স্বামী তথা জমিদাররা যখন দেশের একমাত্র হর্তাকর্তা বা শাসক হয়, বিপরীতে ভূমিদাস ও কৃষকদের সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত ও অধীনস্থ করে রাখা হয়। এ ধরনের রাষ্ট্র বা সমাজকে সামন্তবাদী সমাজ বা রাষ্ট্র বলে। সামন্ত বা ভূ-স্বামীরা নিজেরা উৎপাদনে অংশ নেয় না। কৃষকদের জমি বর্গা দিয়ে ফসলের এক অংশ বা বার্ষিক খাজনা আদায় করে। প্রধানভাবে ভােগের জন্য উৎপাদন করা হয়।[১]
সামন্ত সমাজে জমিই ছিল প্রধান উৎপাদনের উপায়। কিন্তু তার উপর মালিকানা ছিল সামন্ত ও রাজা-বাদশাদের। তবে কৃষক বা ভূমি দাসেরা সামন্তজমিদারের থেকে যেটুকু জমি পেত এবং যার উপর নির্ভর করে তাদের জীবনযাত্রা চলত তাকে তারা নিজেদের জমিই মনে করত। কারণ জমি তার দখলেই থাকত। উৎপাদিত ফসলের একটা বড় অংশ খাজনা হিসেবে জমিদার বা রাজাকে দিতে হত। কৃষি কাজই থাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রধান পেশা। কৃষকদের নিকট থেকে মৌসুমী ফসলের এক অংশ বা বার্ষিক খাজনা আদায় করে ভূ-স্বামী বা জমিদাররা চলতাে।
সামন্তবাদে জমির সাক্ষাৎ উৎপাদনকারী কৃষকের নিকট থেকে নানাপ্রকার কর আদায় করত। এই করের পরিমাণ অনেক সময় তার উৎপাদিত সমস্ত সম্পদকে গ্রাস করত। এমনকি, উৎপাদনের পরিমাণ নির্বিশেষে তার উপর খাজনা ধার্য হতো। ফলে অনেক স্থানে কৃষক দৈহিক যাতায়াতের স্বাধীনতা হারিয়ে ভূমির সীমানায় বন্দি ভূমিদাসে পরিণত হতো।
সামন্তবাদী সমাজে শ্রেণি ও বিরোধ
এই সামন্তবাদী সমাজে জমিদারদের নিচে কয়েকটি শ্রেণি ছিল। যেমন, কারিগর (শ্রমিক), কৃষক ও বণিক। এই সামন্ত সমাজের ভিতর থেকেই বণিকরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে এবং বিভিন্ন দেশের যােগাযােগ ব্যবস্থা আবিষ্কারের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থের মালিক হয়। এই নতুন অর্থের মালিক বণিক বা ব্যবসায়ীদের একটি অংশ গড়ে তুললাে হস্তশিল্পকারখানা। আর কলকারখানার কাজের জন্য বন্ধনমুক্ত লােকের প্রয়ােজন দেখা দেয়। কিন্তু ভূমিদাস কৃষকেরা জমির সাথে আষ্টেপৃষ্টে বাধা। তাই এই নতুন ব্যবসায়ীদের সামনে সামন্তবাদ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই বিকাশের জন্য চাই রাষ্ট্রক্ষমতা। কিন্তু সংখ্যালঘু হবার ফলে তাদের একার পক্ষে সামন্তদের নিকট থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নেয়া সম্ভব ছিল না। তাই “সব মানুষ সমান”, “সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা”ই আমাদের লক্ষ্য- এসব বুলির আড়ালে শ্রমিক-কৃষকদের সাথে ঐক্য গড়ে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে যারা তাদের বলা হয় বুর্জোয়া।
সামন্ত সমাজের শাসক ও শোষক শ্রেণি রাজা, সামন্ত-প্রভু, জমিদার এবং ধর্মযাজকদের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। কিন্তু সমাজ শ্রেণি-বিরোধ শূন্য ছিল না। শাসক শ্রেণিসমূহ অর্থাৎ রাজা, সামন্তপ্রভু ও ধর্মযাজক এদের মধ্যে যেমনি নিরন্তর ক্ষমতার অন্তর্বিরোধ চলত, তেমনি সমগ্র শাসক শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিত কৃষক সমাজের বিদ্রোহের প্রয়াস সামন্ত সমাজের ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।[২]
পৃথিবীতে প্রথম ইউরােপে সামন্তবাদের পতন হয় এবং বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রক্ষমতার মালিক হয় এবং উৎপাদন যন্ত্রগুলাে বুর্জোয়াদের ব্যক্তিগত অধিকারে নিয়ে যায়। যার ফলে শ্রমিক-কৃষকদের দেয়া প্রতিশ্রুতি– “সব মানুষ সমান”, “সাম্য মৈত্রী” আর স্থাপিত হয় না।
উৎপাদনের উপায়ের নতুনতর বিকাশে সামন্ত সমাজের স্থানে আধুনিক কালে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পুঁজিবাদের পরবর্তী ঐতিহাসিক পর্যায় হচ্ছে সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রও পৃথিবীর একাধিক দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সমাজের বিকাশ ও রূপান্তর যান্ত্রিক নয়। সমাজতন্ত্রের যুগেও তাই অনেক দেশে সামন্তবাদের রেশ দেখতে পাওয়া যায়। ইউরোপে ফরাসি বিপ্লব অর্থাৎ ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত সামন্তবাদের স্থায়িত্বের কাল ধরা হয়।
তথ্যসূত্র:
১. রায়হান আকবর, রাজনীতির ভাষা পরিচয়, আন্দোলন প্রকাশনা, ঢাকা, জুন ২০২০, পৃষ্ঠা ২৯-৩০।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৭১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।